সব করোনা রোগীকে সুস্থ করে বাড়ি পাঠিয়েছেন তাঁরা
গত ফ্রেব্রুয়ারির মাঝামাঝি উহানফেরত এক শিক্ষার্থী করোনাভাইরাসের উপসর্গ নিয়ে যান বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে। কিন্তু করোনাসম্পর্কিত কোনো প্রশিক্ষণ না থাকায় তখন সেখানে আতঙ্ক ছড়ায়। কিন্তু ভয় পাননি হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের একমাত্র বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক কামরুল আজাদ। তিনি ওই শিক্ষার্থীকে হাসপাতালে ভর্তি করে নেন। এরপর তাঁকে হাসপাতালে আইসোলেশনে রেখে চিকিৎসা দেওয়া শুরু করেন। এভাবেই বরিশাল বিভাগে প্রথম আইসোলেশন ওয়ার্ডের গোড়াপত্তন।
একপর্যায়ে বরগুনা ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতালে গড়ে তোলা হয় ৫০ শয্যার করোনা ওয়ার্ড। এর দায়িত্ব দেওয়া হয় চিকিৎসক কামরুল আজাদকে। তাঁর নেতৃত্বে ওয়ার্ডের চিকিৎসা সেবা দল চিকিৎসা দিয়ে সব করোনা রোগীকে সুস্থ করে বাড়ি পাঠিয়েছে। এটি বরিশাল বিভাগের প্রথম কোনো হাসপাতাল, যেখান থেকে সব করোনা রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি গেছেন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, করোনা ওয়ার্ডের চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের আন্তরিক চেষ্টার কারণেই এটা সম্ভব হয়েছে।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, গত ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে ৫ মে পর্যন্ত করোনা উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে আসা ১৪৬ জনকে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়।
তাঁদের মধ্যে ৭৫ জনকে ব্যবস্থাপত্র দিয়ে হোম কোয়ারেন্টিনে (সঙ্গনিরোধ) পাঠানো হয়। হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হয় ৭১ জনকে। তাঁদের মধ্যে করোনা পজিটিভ ছিলেন ১১ জন।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, ফেব্রুয়ারিতে হাসপাতালে আসা উহানফেরত ওই শিক্ষার্থীকে ৭ দিন আইসোলেশনে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হয়। এরপর পরীক্ষায় জানা যায়, তিনি করোনা নেগেটিভ। তারপরও ঝুঁকি এড়াতে ১৪ দিন প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে রেখে তাঁকে সেবা দেন চিকিৎসক কামরুল। এরপর কামরুল আজাদের আগ্রহে ১৩ ফেব্রুয়ারি হাসপাতালে অনানুষ্ঠানিকভাবে করোনা ওয়ার্ড চালু হয়। পরে ১২ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে ওয়ার্ডটি উদ্বোধন করা হয়।
সূত্র জানায়, ২৪ এপ্রিল দুজন করোনা রোগীকে সুস্থ হওয়ার পর বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হয়। এরপর ২৬ এপ্রিল দুজন, ২৮ এপ্রিল একজন, ২৯ এপ্রিল চারজন, ১ মে একজন এবং সর্বশেষ ৪ মে এক রোগীকে সুস্থ করে বাড়ি পাঠায় করোনা ওয়ার্ডের চিকিৎসাসেবা দল।
>মেডিসিন বিশেষজ্ঞ কামরুল আজাদের হাত ধরে ওয়ার্ডের যাত্রা শুরু। চিকিৎসায় নেতৃত্বও দিয়েছেন এই চিকিৎসক।
এক প্রশ্নের জবাবে চিকিৎসক কামরুল আজাদ গতকাল বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, 'ভাইরাসটি নতুন। তাই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা দিতে গিয়ে আমাদের খুব সতর্ক থাকতে হয়েছে। সেটা কেবল রোগীদের নিয়েই নয়, আমাদের নিজেদের নিয়েও।' আর সাফল্যের কারণ হিসেবে বলতে গিয়ে এই চিকিৎসক বলেন, 'আমাদের দলের সব সদস্যের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল। পাশাপাশি প্রত্যেক রোগীকে আলাদা আলাদা করে পর্যবেক্ষণে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।' কামরুল আজাদ আরও বলেন, 'আমি মনে করি, এসব রোগীর মূলত প্রথমেই যেটা দরকার, তা হলো মানসিক দৃঢ়তা বাড়ানো। যে কাজটা আমরা খুব গুরুত্বের সঙ্গে করেছি। পাশাপাশি সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নেওয়ার চেষ্টা করেছি। কারও পুষ্টিজনিত ঘাটতি থাকলে তাঁকে পুষ্টিকর খাবার দিয়েছি।'
জানতে চাইলে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক সোহরাব উদ্দীন বলেন, 'আমাদের চিকিৎসাসেবা প্রদানকারী দলের প্রত্যেক সদস্যের নিজ নিজ কাজের প্রতি একাগ্রতা এবং প্রয়োজন অনুযায়ী তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নিতে পারার কারণেই এমনটা সম্ভব হয়েছে।' তিনি চিকিৎসাসেবা দলের প্রত্যেক সদস্যকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, 'পরবর্তী সময়েও তাঁরা এমন কাজের স্বাক্ষর রাখবেন বলে আমার বিশ্বাস।'
আর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বরিশাল বিভাগীয় সহকারী পরিচালক শ্যামল কৃষ্ণ মণ্ডল বলেন, 'বরিশাল বিভাগে এটাই প্রথম কোনো হাসপাতাল, যেখান থেকে চিকিৎসাধীন সব রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। এটা অবশ্যই আমাদের জন্য খুবই আশার খবর। আমরা এই চিকিৎসাসেবা দলকে অভিনন্দন জানাচ্ছি।'
প্রসঙ্গত, বরিশাল বিভাগের ছয় জেলায় গতকাল পর্যন্ত ১৩৯ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছেন। এর মধ্যে মারা গেছেন ছয়জন। বিভাগের বরিশাল জেলায় ৪৬ জন, বরগুনায় ৩৪ জন, পটুয়াখালীতে ৩০ জন, ঝালকাঠিতে ১৩ জন, পিরোজপুরে ১১ জন এবং ভোলায় ৫ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছেন।