রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন যখন শুরু হলো, তখন আমাদের দাবি ছিল উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি রক্তস্নাত পরিণতির মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা স্বীকৃত হয়েছে বটে, তবে সেই পরাধীন পাকিস্তান থেকে এমনকি এই স্বাধীন বাংলাদেশেও বাংলা ভাষার অবস্থার কোনো বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেনি। বিশেষত স্বাধীন দেশে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে যে মর্যাদা বাংলার পাওয়ার কথা, তা সে পায়নি। ভাষা আন্দোলনের ৭০ বছরে দাঁড়িয়ে কথাটি এখনো অক্ষেপ নিয়ে বলতে হচ্ছে।
বাংলা যে আজও তার সঠিক মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হতে পারল না, এর পেছনে দেশে একই সঙ্গে তিন ধারার শিক্ষাব্যবস্থা বর্তমান থাকা, উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহার না হওয়া, সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রয়োগের কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়া ইত্যাকার নানাবিধ কারণের কথা বলা যাবে। তবে মূল কারণ অন্বেষণের জন্য আমাদের আরেকটু গভীরে তাকাতে হবে।
পাকিস্তানি শাসন আমলে পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের মধ্যে দ্বন্দ্বটা ছিল খুবই মৌলিক। আদতে পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ নামে কোনো জাতীয়তাবাদ তৈরিই হয়নি। কারণ, এখানে একসঙ্গে ছিল পাঁচটি জাতীয়তাবাদ। বাঙালি, পাঞ্জাবি, সিন্ধি, বেলুচ, পাঠান—এই পাঁচ জাতি একসঙ্গে হওয়ার বা এক মোহনায় মেলার কোনো সুযোগ ছিল না। কেননা, এদের প্রত্যেকের ভাষা আলাদা। বাঙালি জাতীয়তাবাদ বাংলা ভাষার ওপর নির্ভরশীল। ফলে প্রত্যেকের মধ্যে যে ভাষিক ভিন্নতা ও দ্বন্দ্ব বিদ্যমান ছিল, তা মীমাংসার কোনো উপায় ছিল না।
বলা যায়, পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়াতেই পাকিস্তান ভেঙে গেছে।
কিন্তু আমরা যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করলাম, তার মধ্যে একটা দুর্বলতা ছিল। সেটা হলো এই, পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ পুঁজিবাদ প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছিল, বাঙালি জাতীয়তাবাদও শেষ পর্যন্ত ওই পুঁজিবাদের পথেই অগ্রসর হলো। বাঙালি জাতীয়তাবাদের মধ্যে প্রতিশ্রুতি ছিল গণতান্ত্রিক তথা সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজ গঠনের। আমরা সেটা করতে পারিনি। আমরা জাতীয়তাবাদেই থেমে গেছি। স্বাধীন বাংলাদেশে আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজ এখনো আগের রাষ্ট্রের মতোই পুঁজিবাদী রয়ে গেছে। এর আমলাতান্ত্রিক চারিত্র্যও বদলায়নি। ফলে সাংবিধানিকভাবে বাংলা রাষ্ট্রভাষা হয়েছে ঠিকই, তবে রাষ্ট্র ও সমাজের ভাষা এখনো পুরোপুরি বাংলা হয়নি। এটাই আমাদের বড় ব্যর্থতার জায়গা।
ভাষা আন্দোলনকে পেছন ফিরে যদি দেখি, নিজের জীবনের ভেতর দিয়ে যদি দেখতে যাই, টুকরো টুকরো অনেক স্মৃতি এসে ভিড় করে মনের আয়নায়। ১৯৫২ সালে আমি ছিলাম উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের ছাত্র, সেন্ট গ্রেগরিজ কলেজে (এখন নটর ডেম কলেজ) পড়তাম। ফেব্রুয়ারি মাসের ৪ তারিখে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে একটি মিছিল হয়েছিল। সেই মিছিলে আমি ছিলাম। মিছিল থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আওয়াজ উঠেছিল, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। তখন সংগঠকদের মধ্যে একজন ছিলেন যুবলীগ নেতা অলি আহাদ। তিনি দ্রুত ছুটে এসে সবাইকে বলছিলেন, ‘আওয়াজ হবে, “অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।”’ কিন্তু অন্যতম রাষ্ট্রভাষা নয়, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ বলে ছাত্রদের যে স্বতঃস্ফূর্ত জাগরণ সেদিন ঘটেছিল, মূলত এর মধ্যেই নিহিত ছিল বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা।
সত্যি বলতে, এ আন্দোলন কত দূর যাবে বা যেতে পারে, আমরা সেটা তখন একেবারেই বুঝতে পারিনি। উর্দু আমাদের ওপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে, এতে আমরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত হব—এই ছিল আমাদের প্রাথমিক উপলব্ধি। আমরা অনেক কষ্ট করে ইংরেজি শিখেছি, এখন আবার উর্দুও শিখতে হবে; দেখা যাবে যে উর্দুভাষীরাই আমাদের ওপর চেপে বসছে—শঙ্কার জায়গা ছিল এটাই। এ বাস্তবতায় আমরা ভাবলাম, তাহলে তো আমাদের স্বাধীনতাই ব্যর্থ হয়ে যাবে। এ প্রেক্ষাপটে চলে এল একুশে ফেব্রুয়ারি।
১৯৫২ সালে আমাদের সেন্ট গ্রেগরিজ কলেজ তখনো স্কুলেরই একটা সম্প্রসারণ—স্কুল থেকে মাত্র কলেজে উন্নীত হয়েছে। ছাত্রসংখ্যা এক শর বেশি নয়। আমরা ছিলাম কলেজের দ্বিতীয় ব্যাচ। সে সময় কলেজটি ছিল পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে। তাই একুশে ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় যে ছাত্র জমায়েত ছিল, সেখানে আমরা কলেজ থেকে যাইনি। গিয়েছি আমাদের মহল্লা থেকে। আমরা তখন থাকতাম আজিমপুরে সরকারি কর্মচারীদের আবাসিক কলোনিতে। এখানে আমরা অনেক ছাত্রই ছিলাম। আমি কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র, কিন্তু আমাদের ওপরের ক্লাসে—বিশ্ববিদ্যালপড়ুয়া অনেকেই ছিলেন, অন্য কলেজের ছাত্ররাও ছিল। সব মিলিয়ে দলটা ভারীই ছিল।
মনে আছে, একুশে ফেব্রুয়ারির দিন আমরা কয়েকজন এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় উপস্থিত হলাম। সবার মধ্যেই একটা চাপা উত্তেজনা। তবে আমরা মোটেই বুঝিনি—আদতে কেউই বোঝেনি—কী ঘটতে যাচ্ছে। সরকার ১৪৪ ধারা জারি করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের রাস্তায় এবং গেটের বাইরে পুলিশ টহল দিচ্ছে। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সিদ্ধান্ত ছিল যে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হবে না। কিন্তু ছাত্রসমাজ তাৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত নিল, ১৪৪ ধারা ভেঙে রাস্তায় নামবে তারা। স্থির হলো, ১০ জন ১০ জন করে প্রতিটি দল গেট খুলে বের হবে এবং জগন্নাথ হলের দিকে যাবে। কারণ, জগন্নাথ হল মিলনায়তনেই ছিল প্রাদেশিক ব্যবস্থাপক পরিষদের সভা। সেদিন সেখানে সভা চলছিল। ছাত্রদের সিদ্ধান্ত ছিল, ওই সভাস্থলে গিয়ে রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে দাবি জানানোর।
১০ জন করে একেকটি দল যখন বেরোতে থাকল, তখন মেডিকেল কলেজ অবধি পৌঁছানোর আগেই পুলিশ তাদের ট্রাকে করে তুলে নিয়ে যাওয়া শুরু করল। পরে যে সময় বহু ছাত্র বেরিয়ে গেছে, ছাত্রীরাও বেরিয়েছে; সেই সময় টিয়ার গ্যাসের সেল ছুড়তে শুরু করল পুলিশ। টিয়ার সেল বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলা ও আশপাশের এলাকায় বিষাক্ত ধোঁয়া ছড়াতে লাগল। এর মধ্যে সেই গ্যাস আমাদের চোখেও এসে লেগেছে। চোখ জ্বালা করছে। এ অভিজ্ঞতা আমাদের জন্য একেবারেই নতুন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই প্রাঙ্গণে সে সময় একটি পুকুর ছিল। সেখান থেকে রুমালে পানি ভিজিয়ে চোখের যন্ত্রণা দূর করার চেষ্টা করছিলাম আমরা। আর তখনো আমাদের মনে এই বিশ্বাস ছিল যে যা ঘটেছে, এর চেয়ে বেশি কিছু আর ঘটবে না। আজিমপুর থেকে আমরা যে কয়েকজন এসেছিলাম, সবাই চোখ মুছতে মুছতে পেছন দিক দিয়ে রেললাইন ধরে নিজেদের মহল্লায় ফিরে এলাম।
চূড়ান্ত খারাপ সংবাদটি পেলাম দুপুরবেলা। শুনলাম, ছাত্রদের ওপর পুলিশ গুলি চালিয়েছে এবং তাঁরা শহীদ হয়েছেন। একজনের নাম জানতে পারলাম, বরকত। মুহূর্তেই বুকটা হু হু করে উঠল। ঘর থেকে বেরিয়ে আমরা মেডিকেল কলেজের দিকে চলে এলাম, আগের মতোই রেললাইন ধরে। এখানে এসে শুনি, শুধু বরকত নন, রফিকও শহীদ হয়েছেন। আর সালাম নামের একজন আহত হয়েছেন; পরে তিনি মারা যান।
সে সময় ছাত্ররা মেডিকেল কলেজের চিকিৎসাকেন্দ্রটি ঘিরে রেখেছিল এই আশঙ্কা থেকে যে যেকোনো মুহূর্তে পুলিশ এসে নিহত বরকত, রফিক ও আহত সালামকে নিয়ে যেতে পারে। ছাত্রদের ওপর পুলিশের গুলি চালানের ঘটনায় আমাদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। চর্তুদিকে স্লোগান, ক্ষোভ-বিক্ষোভ চলছিল। মেডিকেল কলেজের ছাত্রাবাস থেকে মাইকে খবর ও স্লোগান দেওয়া হচ্ছে, সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে মাইক বসিয়ে স্লোগান দেওয়া হচ্ছে, চলছে বক্তৃতা। এভাবেই পার হলো ১৯৫২-এর রক্তাক্ত একুশে ফেব্রুয়ারি।
পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি, ভাষাশহীদদের জন্য গায়েবানা জানাজা হলো। তাতেও আমরা যোগ দিয়েছিলাম। পরে ২৩ ফেব্রুয়ারি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ডাকে হরতাল পালিত হয়। আমরা যেহেতু সরকারি কলোনিতে থাকতাম, তাই ওই সময় হরতালের সমর্থনে আমরাও কলোনির অনেককে অফিস যাওয়া থেকে বিরত রাখতে চেষ্টা করি।
২১ ফেব্রুয়ারি ছিল একটা ক্রান্তিকাল। পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ ত্যাগ করে বাঙালি জাতীয়তাবাদে পৌঁছানোর একটা প্রান্তিক সময়। এটা আমরা সেদিন বুঝিনি, বুঝেছি আরও খানিকটা পরে। ২১ তারিখের মর্মন্তুদ ঘটনার পর শ্রেণি-পেশা নির্বিশেষে যে যার অবস্থান থেকে এ আন্দোলনের পক্ষে সমর্থন দিতে থাকে। ফলে ছাত্রসমাজের আন্দোলন গণ-আন্দোলনে পরিণত হতে আর সময় লাগেনি। এমনকি ঢাকা শহরের স্থানীয় মানুষ—যাঁদের অনেকে নিজেদের উর্দুভাষী মনে করতেন এবং ভাষা আন্দোলনকে সমর্থন করেননি—তাঁরাও একেবারে বদলে গিয়ে অন্দোলনের পক্ষে চলে এসেছিলেন। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের প্রতি সবারই একটা সহানুভূতি ছিল। আদতে ছাত্রহত্যাকে সবাই—স্থানীয়রাও তাঁদের ওপরেই আক্রমণ বলে মনে করছিলেন। ফলে দৃশ্যপট দ্রুতই বদলে গেল। জনসাধারণের মানসিকতায় একটা বড় রকমের পরিবর্তন ঘটল, যা থেকে পরবর্তী আন্দোলনগুলো শক্তি সঞ্চয় করেছে। কেবল তা–ই নয়, এসব আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ধাপে ধাপে আমরা স্বাধীনতার দিকে ধাবিত হয়েছি।
উচ্চমাধ্যমিক পাস করে ওই ’৫২ সালেই আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। ভাষা অন্দোলনের অনুভব তখন আমাদের সবার মধ্যেই খুব জীবন্ত। সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে প্রতিবছর ছাত্র সংসদ নির্বাচন হতো। ১৯৫৩ সালে যে নির্বাচন হয়, তাতে দেখা গেল যে সব আবাসিক হলেই মুসলিম লীগবিরোধী ছাত্ররা জয়ী হয়েছে। তখন সলিমুল্লাহ মুসলিম হলেই প্রথম গণতান্ত্রিক যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। এর পরের বছর মুসলিম লীগবিরোধী যুক্তফ্রন্টের ধারণা যে দানা বাঁধল, তার প্রথম প্রকাশ সলিমুল্লাহ হলের নির্বাচনেই ঘটেছিল। বলাবাহুল্য, এ নির্বাচনে প্রার্থীদের জয়-পরাজয়ের পেছনে ভাষা আন্দোলনই বড় প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছিল। এই গণতান্ত্রিক যুক্তফ্রন্টের একজন প্রার্থী হিসেবে আমিও নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলাম; এবং আগেই বলেছি, আমাদের সবারই বিপুল ভোটে জয়লাভ ঘটেছিল। এখানে মুসলিম লীগ–সমর্থিত ছাত্ররাও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল। তবে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বলতে গেলে তারা একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে যা ঘটবে, এ ছিল তারই পূর্বাভাস।
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন শুধু ভাষার মর্যাদা রক্ষার আন্দোলন ছিল না, এটা ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রথম অভ্যুত্থান। সেদিন পুলিশ যেভাবে ছাত্রদের ওপর গুলি ছুড়েছিল, একাত্তরে এসে সেটাই গণহত্যায় রূপ নিয়েছে। বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি প্রথমবারের মতো আমাদের একটা পরিবর্তনের বার্তা দিয়েছিল, আমরা জেগে উঠেছিলাম। আর আমাদের পরম সৌভাগ্য যে ওই পরিবর্তনজাত জাগরণের ঐতিহাসিক সময়টাতে আমরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলাম। আমরা যারা এই ঘটনার সাক্ষী, তাদের জীবনে এই স্মৃতি অমলিন হয়ে থাকবে। কেননা, এই একুশে ফেব্রুয়ারিই হলো আমাদের সমস্ত ঐক্যের ভিত্তি, বাঙালির সংহতির অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু।
ফেব্রুয়ারি ২০২২