সন্তানের চোখে বাবাই তার কাছের পৃথিবী
সন্তানের চোখে বাবাই হচ্ছে সবচেয়ে কাছের পৃথিবী। সেই শৈশবে বাবার আঙুল ধরে শুরু হয় পথচলা, কৈশোরের দুরন্তপনার সঙ্গী, যৌবনে সাহসের জোগানদার আর সংসারজীবনে একজন দায়িত্ববান পুরুষের ভূমিকা। একজন আদর্শবান বাবার চোখেই তাঁর সন্তান দেখতে শেখে পৃথিবীর আলো আর অন্ধকারের মতো মানুষের জীবনের সুখ–দুঃখের ক্ষণস্থায়ী বিচরণ, একজন আদর্শবান বাবার মস্তিষ্কেই তাঁর সন্তান অনুভব করতে শেখে পৃথিবীর প্রতিটি মানুষেরই সম-অধিকারে বেঁচে থাকার প্রাপ্যতা আছে। অনুরূপভাবে একজন আদর্শবান বাবার কারণেই সন্তান শুনতে শেখে তার চারপাশের সৎ এবং সত্য মানুষগুলোর তৃপ্তির হাসি অপর দিকে অসততা ও মিথ্যাপুষিত জীবনের আহাজারি।
বাবার শরীর দিয়েই একটি সন্তান অনুভব করতে শেখে যে এই পৃথিবীটা বেঁচে থাকার তাগিদে কতটা শ্রম আর কতটা ঘাম ঝরাতে হয়।
একজন বাবা শুধু তাঁর নিজের স্বপ্নের বাহক নন, তাঁকে পরম মমতা ও যত্নের সঙ্গে লালন করতে হয় পরিবারের প্রতিটি স্বপ্নকে। সন্তানের কাছে বিশ্বাসের আরেক নাম হচ্ছে বাবা, যাঁর হাত ধরে পৃথিবীর সব দুর্গম পথেই পা রাখা যায় অতি আস্থার সঙ্গে। প্রতিটি সন্তানের কাছেই তার বাবাই হচ্ছে সবচেয়ে সাহসী মানুষ, যে কিনা তাদের প্রতিটি চাওয়াকেই ছিনিয়ে আনতে পারে। বাবা হচ্ছে সন্তানের কাছে আয়নার মতো, যেখানে প্রতিফলিত হয় তার আদর্শ, বিবেক ও ভালোবাসার প্রতিচ্ছবি। ছোটবেলা থেকেই একটি সন্তানের চোখে বাবা যে রঙিন স্বপ্নের পৃথিবী এঁকে দেন, তার বাস্তবায়নেই বাবাদের জীবনে শত চেষ্টা। বিসর্জনের ভেলায় ভাসিয়ে দিয়ে নিজের সব স্বাদ, আহ্লাদ শুধু সন্তানের স্বপ্ন চাওয়াকে আলিঙ্গন করেই যে তৃপ্তি সুখের হাসি, তা শুধু বাবাদের মুখেই মানায়। জীবনসংগ্রামের এক অকুতোভয় সৈনিক তিনি, লাঞ্ছনা–বঞ্চনা কিংবা দুর্ব্যবহার জীবন-জীবিকা চক্করে ঘটে চলেছে হরহামেশাই, তবু সব ভুলে দিন শেষে মুচকি হেসে সন্তানদের বুকে জড়িয়ে ধরতে শুধু বাবারাই পারেন। আদর্শ আর শাসনের বুননে তৈরীকৃত যে চাদরে একজন বাবা তাঁর সন্তানকে জড়িয়ে রাখেন, তা একটি সন্তানের কাছে ক্ষণিকের ভালো না লাগার অনুভূতি হলেও জীবনের দীর্ঘ পথচলায় একসময় ঠিকই উপলব্ধি চলে আসে যে কতটুকু ভালোবাসার আবিরমিশ্রিত ছিল সেই অনুশাসন।
বাবার সঙ্গে সন্তানের ভালোবাসা ও বন্ধুত্বের গভীরতা অঙ্কনের প্রয়াসেই একটি বাস্তব জীবনের গল্প তুলে ধরলাম। গ্রামের একটি ছিমছাম ছোট ও সুখী পরিবার, সংসারে সদস্য বলতে মাত্র তিনজন, মা–বাবা আর একমাত্র ছেলেসন্তান। বাবা একজন সরকারি ব্যাংকের ব্যাংকার ছিলেন, এই তো কিছুদিন আগেই অবসর নিয়েছেন। একমাত্র সন্তান হওয়ায় বাবা ও ছেলে পরস্পরের প্রতি ভালোবাসায় ছিল না ভাগ। মাঝেমধ্যে মনে হতো প্রকৃতির আপন পৃষ্ঠপোষকতায় তৈরি হওয়া এই বাবা ও ছেলের বন্ধুত্ব। তা দেখে অনেকের মধ্যে একধরনের হিংসাও কাজ করত। কারণ, ভালোবাসা ও বন্ধুত্ব এই দুইয়ের প্রতি মানুষের লোভ অসীম। ছেলের শৈশব থেকে শুরু করে বাবা কখনোই তার নাম ধরে ডাকেননি, বাবাও ছেলেকে বাবা বলেই ডাকতেন, ছেলের প্রতি বাবার যে শাসন, সেখানেও ছিল না উচ্চস্বর কিংবা চোখ রাঙানো। বাবার দেখানো পথের শেখানো ভাষায় ছেলে বড় হতে থাকে, ছেলে বড় হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তার চিন্তা–চাহিদাগুলো বড় হতে থাকে, অপর দিকে বাবার নিবেদিত সামর্থ্য ছেলেকে কখনোই অপূর্ণতার স্বাদ গ্রহণ করতে দেয়নি। ছেলেকে ঘিরেই বাবার স্বপ্নের পৃথিবী, কল্পনার পাতায় পাতায় এঁকে রেখেছে শতশত সুখের আলপনা। যেমন, ছেলে ভালো রেজাল্ট করবে, ভালো একটি চাকরি করবে, আরও হয়তো অনেক অব্যক্ত অনুভূতি। ছেলেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য পাড়ি জমাতে হবে শহরে, কিন্তু বাবার আবেগি হৃদয় বাস্তবতা গ্রহণ করতে পারলেও অন্তরের চাপা কান্না তো থেমে থাকার নয়, নিজের অজান্তেই চোখের কোনায় এক ফোঁটা জল চলে আসে। তারপরও জীবনযুদ্ধের বাস্তবতায় নিজের শত অনিচ্ছাকে লুকিয়ে রেখে হলেও বাবা বাধ্য হন ছেলেকে শহরে পাঠাতে, যে ছেলের মুখ না দেখে হয়তো তিনি কখনো অফিসে যাননি, একটি দিনও কাটেনি বাবার যে ছেলের সঙ্গে অন্তত এক বেলা হলেও একসঙ্গে খাওয়া হয়নি। শহরের বুকে ছোট্ট একটি মেসে থাকা, অচেনা পরিবেশ, অপরিচিত সব বন্ধুর সঙ্গে মেলামেশা, চারপাশের সমাজে ঘটে যাওয়া নানা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা সব মিলিয়ে বাবার মনের মধ্যে এক দুশ্চিন্তার পাহাড়, এভাবেই কাটতে থাকে অগণিত নির্ঘুম রাত, তারপরও ছেলের ওপর বাবার অগাধ বিশ্বাস, সে মানুষের মতো মানুষ হবে, বড় একটি চাকরি করবে, সব মিলিয়ে একটিই চাওয়া, জীবনের শেষবেলায় যেন তার কাঁধে হাত রেখে হাঁটতে পারেন, কিন্তু তিনি কখনো চাননি তাঁর ইচ্ছাপূরণের বাড়তি বোঝা তাঁর ছেলেকে বহন করতে হোক, একবার ভাবুন তো ভালোবাসার গভীরতা কতটা থাকলে একটি মানুষ এইভাবে চিন্তা করতে পারেন, একটি বাবার পক্ষেই শুধু এটা অনুভব করা সম্ভব। একসময় ছেলেটি তার পড়ালেখা শেষ করে এবং ছোট একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে যোগ দেয়, বাবার চোখ তখন খুশির জলে ছলছল, তিনি কাকে রেখে কাকে জানাবেন এই খুশির খবর, সেই আনন্দে দিশেহারা, ছেলের সাফল্যে বাবার বুকটা তখন গর্বে ভরে ওঠে। এভাবেই এগিয়ে যেতে থাকে জীবন-সংগ্রামের দিনগুলো, একসময় বাবার পছন্দেই অনেক ধুমধাম করে বিয়ে করে ছেলেটি, তাদের কোলজুড়ে চলে আসে তৃতীয় প্রজন্মের কর্ণধার। ছেলে, বউমা ও নাতিকে নিয়ে বাবা যেন খুঁজে পান এক স্বর্গ সুখের স্বাদ। কিন্তু আলো-আঁধারের মতো মানুষের জীবনেও সুখ–দুঃখগুলো যে চিরস্থায়ী নয়, তা এই বাবার জীবনের গল্পেই প্রমাণিত। চাকরি থেকে একটি দিন ছুটি পেলেই ছেলেটি ছুটে আসত তার বাবাকে এবং নবজাতক ছেলেকে দেখতে, পৃথিবীর কোনো দুর্যোগই বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি এই ছুটে আসার পথে, দেড় বছরের ছেলেটি কেবল মুখ ফুটে একটু বাবা ডাক শিখেছে, কী যে সুমধুর এই আধো আধো কণ্ঠের ডাক, পৃথিবীর সব শব্দ যেন মূল্যহীন এই একটি শব্দের কাছে, এটা শুধু একটি বাবাই অনুভব করতে পারেন।
প্রতিবারের মতো এবারও ছুটি কাটিয়ে খুব সকালেই ছেলেটি তার মোটরসাইকেল নিয়ে রওনা হয়েছে তার কর্মস্থলের উদ্দেশে। যথারীতি পরিবারের সবাই তাকে বিদায় জানানোর জন্য গ্রামের মেঠোপথ ধরে কিছু দূর পর্যন্ত এগিয়ে এসেছে, হাসিমাখা মুখগুলোকে বিদায় দিতে খুবই কষ্ট হয় ছেলেটার, তারপরও কিছু করার নেই, জীবন-জীবিকার চক্রে আবদ্ধ আমাদের বাবাদের জীবন, সেখানে আবেগের স্থানটা অত্যন্ত ক্ষীণ। ছেলেটি চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরই থানা থেকে একটি ফোন আসে যে মোটরসাইকেল অ্যাক্সিডেন্টে গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানেই সে মৃত্যুবরণ করে। ছেলেটির বাবা তখনো জানেন না এই নির্মম পরিস্থিতির কথা, পুরো গ্রামে চলে আসে এক শোকের ছায়া, গ্রামবাসী কারোর পক্ষেই এই খবরটি তার বাবার কানে পৌঁছানো সম্ভব নয়, এটি শুধু একটি ছেলের মৃত্যু নয়, একটি বাবার জমিয়ে রাখা শত সহস্র স্বপ্নের মৃত্যু, ছেলেকে ছাড়া বাবার কাছে জীবনটা আজ শুধু একটি বর্ণহীন পৃথিবীতে শুধু বেঁচে থাকা, বাবার শারীরিক মৃত্যু না হলেও তাঁর অন্তর আজ মৃত। কত উৎসব কত ঈদ চলে যায় ছেলে আর বাড়ি ফিরে আসে না, হয়তো বাবা ডাকটিও তাঁর অনেক দিন ধরে শোনা হয় না, এখন তিনি তাঁর নাতির মধ্যেই খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করেন তাঁর হারিয়ে যাওয়া ছেলেকে, কারণ বাবাদের ভালোবাসা অমর।
* লেখক: এজিএম, ওপেক্স গ্রুপ। [email protected]