সন্তানকে নিয়ে স্বপ্ন বোনা হলো না শাকিলের

সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত শাকিল খান
ছবি: সংগৃহীত

অনাগত সন্তানকে নিয়ে খুশির স্বপ্ন বুনেছিলেন শাকিল খান (২৬)। হয়তো ২০-২২ দিন পরই আসত খুশির সেই দিনটি। শাকিল আর তাঁর স্ত্রী দুজনেই অধীর অপেক্ষায় ছিলেন সেই আনন্দক্ষণের। কিন্তু প্রথম সন্তানের জন্মের সেই আনন্দ থেকে এখন অনেক দূরে শাকিল।

সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে ৩৪ দিন চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় মারা গেছেন শাকিল। ভাঙা পায়ে সংক্রমণ শুরু হওয়ায় সেটি কেটে বাদ দিয়েও তাঁকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। মঙ্গলবার রাতেই শাকিলের লাশ বরিশালে নেওয়া হয়। দাফন করা হয় কলাপাড়ায়। ওই দুর্ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি।

শাকিলরা দুই বোন, এক ভাই। শাকিল দ্বিতীয়। বাবা আবদুল মান্নান রাজধানীতে ক্ষুদ্র ব্যবসায় জড়িত। মা জেসমিন বেগম বরিশালে থাকেন। স্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিনের সঙ্গে সংসার শুরু হয় ২০২০ সালে। ঢাকায় ভগ্নিপতি মোস্তাফিজুর রহমানের রিক্রুটিং এজেন্সি আছে। সেখানে কাজে সহযোগিতা করতেন শাকিল। তবে গত কয়েক মাস ধরে কলাপাড়া উপজেলার সবুজবাগ এলাকায় পরিবারের সঙ্গে বসবাস করছিলেন তিনি।

শাকিলের ভগ্নিপতি মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, করোনাকালে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছিলেন শাকিল। অনাগত সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকতেন। হাসপাতালেও তিনি সন্তানকে নিয়ে দুশ্চিন্তার কথা বলেছেন। মায়ের সঙ্গে সবচেয়ে হৃদ্যতা ছিল শাকিলের। হাসপাতালে বারবার অনুরোধ করছিলেন, মাকে যেন সবাই মিলে দেখে রাখে। বারবার বেঁচে থাকার আকুতিও জানিয়েছেন শাকিল। পরিবার, স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের সহায়তায় শাকিলের চিকিৎসায় ব্যয়ও করা হয় ২২ লাখ টাকা।

শাকিলের পরিবারের কাছ থেকে জানা গেছে, গত ১৬ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় বরিশালের কলাপাড়া উপজেলায় বালিয়াতলী নামক স্থানে মহিষ বহনকারী একটি টমটমের (স্থানীয় খোলা যান) সঙ্গে শাকিলের মোটরসাইকেলের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে গুরুতর আহত হন তিনি। মোটরসাইকেল শাকিলই চালাচ্ছিলেন। পেছনে বসা ছিলেন শ্যালক ইমাম মাতব্বর। মোটরসাইকেল থেকে ছিটকে পড়ে ইমাম সামান্য আহত হন। টমটমের সামনের পাদানির সঙ্গে প্রচণ্ড ধাক্কা খাওয়ায় শাকিলের পেটে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয়। প্রাথমিক চিকিৎসার পর ওইদিন রাতেই তাঁকে নিয়ে রাজধানীর পথে রওনা হন স্বজনেরা।

স্বজনেরা চিকিৎসকদের কাছ থেকে জেনেছেন, দুর্ঘটনায় শাকিলের বাঁ পায়ের হাড় বেশ কয়েক টুকরা হয়ে যায়। পাঁজরের হাড়ের কয়েক জায়গায় ভেঙে যায়। পেট গভীরভাবে কেটে যাওয়ায় নাড়িও কাটা পড়ে। থুতনিসহ শরীরের বিভিন্ন অংশে ক্ষত হয়। ফুসফুস ও কিডনিতেও আঘাত লাগে।

দুর্ঘটনার পর গুরুতর আহত শাকিলকে নিয়ে হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ঘুরেছেন স্বজনেরা। শাকিলের খালাতো ভাই জাহিদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, দুর্ঘটনার পরের দিন ভোরে প্রথম ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা হয় শাকিলকে। সেখানে পেটে অস্ত্রোপচারের পর তাঁকে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে (পঙ্গু হাসপাতাল নামে পরিচিত) নেওয়া হয়। সেখানে অস্ত্রোপচারের জন্য প্রস্ততি নেওয়ার পরও আইসিইউসহ অন্যান্য সহযোগিতার অভাবে অস্ত্রোপচার বন্ধ রাখা হয়। পরে তাঁরা শাকিলকে ধানমন্ডির বেসরকারি হাসপাতাল ইবনে সিনায় নিয়ে আইসিইউতে ভর্তি করেন। সেখানে পেটে ও পায়ে অস্ত্রোপচার হয়। তবে একপর্যায়ে পায়ে সংক্রমণ দেখা দিলে তা কেটে বাদ দেওয়া হয়।

শাকিলের ভগ্নিপতি মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ১৭ মার্চ শাকিলের বাঁ পা কেটে বাদ দেওয়া হয়। এর আগে কিছুটা সুস্থ হয়ে ওঠায় ১২ মার্চ থেকে তিন দিন কেবিনে রাখা হয় তাঁকে। বাকি সময়টা ছিলেন আইসিইউতে। তিনি বলেন, ‘শাকিল বাঁচার জন্য খুব আকুতি করছিল। বিদেশে যেতে চাইছিল। কিন্তু বিদেশে নেওয়ার মতো শারীরিক অবস্থা ছিল না। যথাসাধ্য চেষ্টা করা হয়েছিল বাঁচানোর জন্য।’

মোস্তাফিজুর ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘এলাকায় টমটম-নছিমনের মতো কিছু বাহন চলে। রাস্তায় পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা না থাকায় রাতে এই বাহনগুলোর হেডলাইট দেখে এর আকৃতি বোঝা যায় না। এটি মোটরসাইকেল নাকি বড় বাহন, বোঝার উপায় থাকে না। অন্ধকারে শাকিল টমটমটিকে হয়তো মোটরসাইকেল মনে করে সেভাবেই পাশ কাটাতে চেয়েছিলেন।’