করোনা আমাদের মতো বেসরকারি খাতের শিল্পোদ্যোক্তাদের অনেক কিছু শিখিয়েছে। এ শিক্ষাকে আমরা ভবিষ্যতে প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় যত বেশি কাজে লাগাব, প্রতিষ্ঠান ততই লাভবান হবে। করোনার ধাক্কা আমাদের তরুণ, মধ্যবয়সী, প্রবীণ উদ্যোক্তা—সবাইকে প্রযুক্তিনির্ভর হতে বাধ্য করেছে। আমরা কেউ কোনো দিন চিন্তাও করিনি, প্রযুক্তি ব্যবহার করেও জরুরি ও প্রয়োজনীয় এসব বৈঠক করা যায়। করোনা সেই অভ্যাস গড়ে তুলেছে।
করোনা শুরুর পর থেকে এখনো আমি বাসায় থেকে কাজ (হোম অফিস) করছি। দেশ-বিদেশের সঙ্গে সব ধরনের যোগাযোগ ও বৈঠক অনলাইনে করছি। কিন্তু এসব বৈঠকের জন্য একসময় আমরা কত অর্থ ও সময় ব্যয় করেছি। অথচ প্রযুক্তি ব্যবহার করে এসব খরচ ও সময় অনায়াসে বাঁচানো যেত। করোনা যেটাকে সম্ভব করে দিয়েছে, সেটা আমরা কখনো ভাবিনি। তাই আমি মনে করি, কোনো ধরনের চিন্তাভাবনা ছাড়া ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা বা ব্যবসার দিন ফুরিয়ে গেছে। করোনা সেই সুযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। এখন ব্যবসা গড়ে তুলতে হলে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা লাগবে। তা না হলে যেকোনো দুর্যোগে ব্যবসায় টিকে থাকা কঠিন হবে।
এ ছাড়া বৈরী সময়ে ব্যবসায় টিকে থাকার সক্ষমতা কীভাবে বাড়ানো যায়, সেই ভাবনাও সামনে এনেছে করোনা। শুধু ব্যবসা করলে হবে না, যেকোনো সময় যেকোনো আপদ মোকাবিলায় আপৎকালীন প্রস্তুতিও থাকতে হবে। সব ধরনের প্রতিষ্ঠানেরই উচিত সব সময় তিন–চার মাসের আপৎকালীন প্রস্তুতি রাখা। পাশাপাশি ব্যয়ের ক্ষেত্রে সাশ্রয়ী হওয়া।
ব্যয়সাশ্রয়ী হতে গিয়ে অনেক প্রতিষ্ঠানই কর্মী ছাঁটাই শুরু করেছে, এটি অমানবিক। কর্মী ছাঁটাই না করেও ব্যয় সাশ্রয়ের আরও অনেক পথ রয়েছে। সবার আগে সেসব পথেরই সন্ধান করা উচিত। আমি মনে করি, কর্মী ছাঁটাইয়ের পথ তখনই বিবেচনাযোগ্য হতে পারে, যখন ব্যবসা একেবারে বন্ধ করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় না থাকে। অথবা করোনার কারণে হারানো ব্যবসা পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা একেবারে ক্ষীণ। এ ছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা যদি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, সে ক্ষেত্রে কর্মী ছাঁটাই না করে সাশ্রয়ের অন্য বিকল্প পথগুলো বেছে নেওয়া যেতে পারে। করোনার ক্ষতি পোষাতে গিয়ে সব প্রতিষ্ঠান যদি কর্মী ছাঁটাইয়ের পথ বেছে নেয়, তাহলে সমাজ ও দেশ তাতে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়তে পারে।
সামগ্রিকভাবে আমাদের সমাজে প্রত্যেক ব্যক্তি ও পরিবার পর্যায়েও বেশি খরচের একধরনের প্রবণতা রয়েছে। জাতিগতভাবে আমরা অনেক বেহিসাবি। অনেক সময় আমরা ঋণ করেও অপ্রয়োজনীয় নানা খরচ করে থাকি। শিল্পপ্রতিষ্ঠান, ব্যবসায়ীরাও এ প্রবণতার বাইরে নন। তাই আমি মনে করি, এখন খরচের লাগাম টেনে সাশ্রয়ী হতে হবে। আমরা আমাদের প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এ নীতিতেই চলছি। কর্মী ছাঁটাই না করে বিভিন্ন ধরনের খরচের লাগাম টেনে ধরে ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি। অনেক বছরের পুরোনো প্রতিষ্ঠান বলে হয়তো আমাদের অবস্থা অন্য অনেকের চেয়ে একটু ভালো। আমাদের সব প্রতিষ্ঠানে সব সময় আপৎকালীন কিছু প্রস্তুতি থাকে। এ ছাড়া আমরা কখনো আগ্রাসী ব্যবসায় বিশ্বাস করতাম না। অনেক অনেক টাকা ঋণ করে ব্যবসার নীতিবিরোধী ছিলাম আমরা। আমাদের ব্যবসায়িক এ মডেল আমাদের প্রতিষ্ঠানকে করোনা মোকাবিলার ক্ষেত্রে খুব সহায়তা করেছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমরা লাভজনক প্রতিষ্ঠান গড়তে বেশি আগ্রহী হই। কিন্তু টেকসই ও ভালো মানের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ক্ষেত্রে আমাদের আগ্রহ থাকে কম। করোনার কারণে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে আমার সামনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হয়ে উঠে এসেছে ‘প্রতিষ্ঠানের স্থায়িত্বের’ বিষয়টি।
কোনো ধরনের চিন্তাভাবনা ছাড়া ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা বা ব্যবসার দিন ফুরিয়ে গেছে। করোনা সেই সুযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। এখন ব্যবসা গড়ে তুলতে হলে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা লাগবে।
করোনার শুরুতে আমরা প্রথম ধাক্কা খাই কাঁচামালের ক্ষেত্রে। হঠাৎ করে পৃথিবীজুড়ে কাঁচামালের সংকট দেখা দেয়। সংকটের কারণে দামও অনেক বেড়ে যায়। আমাদের প্রতিষ্ঠানের ওষুধের কাঁচামাল বেশি আসে ভারত ও চীন থেকে। আর কিছু কাঁচামাল ইউরোপের দেশ জার্মানি ও ইতালি থেকে আনা হয়। কিন্তু করোনার কারণে এসব দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় কাঁচামাল সংগ্রহে বেশ বেগ পেতে হয়। বেশি দামে কাঁচামাল সংগ্রহ করলেও ক্রেতা পর্যায়ে আমরা পণ্যের দাম বাড়াইনি। আমাদের দেশে করোনা শুরুর আগে যখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করোনা আঘাত আনে, তখনই আমরা আমাদের প্রতিষ্ঠানে নানা ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করি। এ কারণে পরবর্তী সময়ে আমাদের বড় ধরনের লোকসানে পড়তে হয়নি।
করোনা সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতাগুলোকে যেমন ফুটিয়ে তুলেছে, তেমনি আমাদের সামর্থ্য বা সক্ষমতার দিকটিকেও সামনে তুলে ধরেছে। আমরা যেহেতু একটি হাসপাতাল পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত রয়েছি, তাই কাছ থেকে দেখেছি চিকিৎসক থেকে শুরু করে পরিচ্ছন্নতাকর্মী—সবাই কীভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। আবার অনেক তরুণকে দেখেছি নানা ধরনের সেবার সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করতে। এগুলো তো আমাদের সক্ষমতা ও এগিয়ে যাওয়ার শক্তি। তবে এ কথা সত্য, স্বাস্থ্য খাতে মানুষের একধরনের আস্থার সংকট তৈরি হয়েছিল। সেটি এখন অনেকাংশে কেটে গেছে। ভবিষ্যতের জন্য এখান থেকেও শিক্ষা নেওয়ার আছে অনেক কিছু, যদি আমরা সেটি নিতে চাই।
আরেকটি দুর্বল দিক আমার মনে হয়েছে এ করোনা সংকটে। সেটি হলো আমরা অনেক ক্ষেত্রে নিজের দায়িত্বটুকু পালন করি না। অন্য কেউ সেটি করে দেবে, তার জন্য অপেক্ষায় থাকি। আর সব বিষয়ে শীর্ষ পর্যায়ের নির্দেশের অপেক্ষায় বসে থাকি। এ কারণে অনেক সময় সিদ্ধান্ত গ্রহণ বিলম্বিত হয়। এতে ক্ষতি বেশি হয়। আমাদের নাগরিকদের আরও বেশি দায়িত্বশীল হতে হবে।
পরিশেষে একজন উদ্যোক্তা হিসেবে আমি বলব, করোনা–পরবর্তী পৃথিবীতে মানুষের বদলে একটা বড় জায়গা দখল করে নেবে প্রযুক্তি। তাই প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রযুক্তিনির্ভরতা বাড়ানোর পাশাপাশি মানবসম্পদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে বড় বিনিয়োগ করতে হবে। প্রযুক্তির পেছনেও থাকে মানুষ। সেই মানুষের ওপর বিনিয়োগ না করে শুধু প্রযুক্তি দিয়ে প্রতিষ্ঠানকে দীর্ঘ মেয়াদে টেকসই করা যাবে না।
●তপন চৌধুরী স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক