২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

সংকটে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পদ

আধুনিক ট্রাস্ট হাসপাতালের ভ্রাম্যমাণ দুটি হাসপাতাল-গাড়ি এখন পরিত্যক্ত ।
ছবি: সাজিদ হোসেন

মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের ৩২টি শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নাম-নিশানা মুছে ফেলার সব প্রক্রিয়া প্রায় শেষ পর্যায়ে। উৎপাদন বন্ধ হওয়ার পর এসব শিল্পপ্রতিষ্ঠানের জমিগুলো নির্মাতাপ্রতিষ্ঠানের কাছে হস্তান্তর করে বিকল্প আয়ের দিকে ঝুঁকছে ট্রাস্ট।
প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানগুলো একে একে বন্ধ হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয় আশির দশক থেকে। এরশাদের আমলে সাতটি প্রতিষ্ঠান বিক্রি করে দেওয়া হয়। লোকসানের ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বন্ধ হয় তাবানী বেভারেজ। অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অদক্ষতায় এখন পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের ২৯টি প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন বন্ধ।
চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় ১০ একর জমিতে অবস্থিত ইস্টার্ন কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি (গ্লু ও ফরমালিন তৈরি করে) এবং ঢাকার তেজগাঁওয়ে এক একর জমিতে মিমি চকলেট লিমিটেড চালু থাকলেও লোকসান গুনছে। একমাত্র ঢাকার পূর্ণিমা ফিলিং স্টেশন থেকে তেল বিক্রির কমিশন থাকে মাসে পাঁচ থেকে সাত লাখ টাকা।
বাকি লোকসানি প্রতিষ্ঠানগুলোর মূল্যবান জমি একে একে ভবন নির্মাতাদের কাছে হস্তান্তর করা হচ্ছে। ১৯৯৯ সালে রাজধানীর গুলিস্তান ও নাজ সিনেমা হলের জমিতে ২০তলা ভবন নির্মাণের অসম চুক্তি হয়। ভবন তৈরি করে পুরোটাই বিক্রির সুযোগ পান নির্মাতাপ্রতিষ্ঠান ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ার্সের মালিক ও বিএনপির সমর্থক ব্যবসায়ী এ এস এম আলাউদ্দিন। ১৯৯৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ওই চুক্তির ফলে প্রায় দেড় শ কোটি টাকা আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ে ট্রাস্ট। নির্মাতাপ্রতিষ্ঠান ১১ তলা পর্যন্ত কাজ করলেও ২০ তলা পর্যন্ত সব দোকান ও কার্যালয়ের জায়গা বিক্রি করে চলে গেছে।
কল্যাণ ট্রাস্টের তালিকায় থাকলেও সূত্রাপুরের ওয়াইজঘাটের মুন সিনেমার মালিকানা নিয়ে ৪২ বছর ধরে মামলা চলে। আদালতের রায় হয়েছে ব্যক্তিমালিকের পক্ষে। দুই পক্ষের বিরোধের ফলে সেখানে স্থাপিত ভবনটি বিক্রি করেছে ও ভাড়া তুলছে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান।

তেজগাঁওয়ে কাঁচামালের অভাবে কোকা-কোলা উৎপাদন বন্ধ হওয়ায় তাবানী বেভারেজ ক্ষতিপূরণ চেয়েছিল এক হাজার ৪০০ কোটি টাকা, সম্প্রতি কোকা-কোলা আটলান্টা ১২৪ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়ে নিজেই এ দেশে স্বতন্ত্র প্ল্যান্ট স্থাপন করছে।
তার পরও কল্যাণ ট্রাস্টের ২০টি প্রতিষ্ঠানের কাছে এখনো জমি আছে ৫৫ একর। ঢাকার মিরপুর, তেজগাঁও, ওয়ারী ও মোহাম্মদপুর; চট্টগ্রামের চট্টেশ্বর, রাঙ্গুনিয়া, নাসিরাবাদ ও কালুরঘাটে এবং গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জে অবস্থিত এসব জমির সরকারি মূল্য এক হাজার ৩৪৫ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। ট্রাস্টের হিসাবে এর বাজারমূল্য প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা।
ট্রাস্ট সূত্র জানায়, চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে দুটি বাণিজ্যিক ভবনের নির্মাণকাজ চলছে। আগ্রাবাদের একটি ভবন থেকে সাত কোটি এবং আরেকটি ভবন থেকে আট কোটি টাকা ‘সাইনিং মানি’ পেয়েছে ট্রাস্ট। ঢাকার পোস্তগোলায় পারুমা ইন্ডাস্ট্রিজের (জুতাসহ চামড়াজাত পণ্য) জমিতে ১৮তলা ভবন নির্মাণের চুক্তি থেকে ‘সাইনিং মানি’ এসেছে ১২ কোটি টাকা। টিকাটুলীতে হরদেও গ্লাস ওয়ার্কসের (কাচের তৈরি পণ্য) জমিতে গড়ে উঠেছে রাজধানী সুপার মার্কেট, ঠাটারীবাজারে খুচরা যন্ত্রপাতি তৈরির কারখানা মডেল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের জমিতে গড়ে উঠেছে সাততলা ভবন। মোহাম্মদপুরের গজনবী সড়কে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের বিশ্রামাগারটি আধুনিকায়ন করে বহুতল আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণের কাজ চলছে।
যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের কল্যাণে এসব প্রতিষ্ঠান ট্রাস্টকে দেওয়া হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সাধারণ মুক্তিযোদ্ধা, বিশেষ করে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা আর্থিক সহায়তা এবং চাকরির জন্য বঙ্গবন্ধুর কাছে আসতে থাকলে তিনি এই উদ্যোগ নেন।
কল্যাণ ট্রাস্টের নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে ১৮টি শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান দেন মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টকে। পরে ’৭৮ সালে জিয়াউর রহমান ট্রাস্টকে আরও ১১টি প্রতিষ্ঠান দেন। আর কল্যাণ ট্রাস্ট নিজেই তিনটি প্রতিষ্ঠান (চট্টগ্রামের কালুরঘাটে ফলের রস কারখানা, ঢাকায় ট্রাস্ট হাসপাতাল ও দুর্বার অ্যাডভার্টাইজিং) গড়ে তুললেও বড় ধরনের লোকসানে পড়ে এগুলো বন্ধ হয়ে যায়।

ট্রাস্ট সূত্র জানিয়েছে, ট্রাস্টের আওতায় বর্তমানে মাসিক সম্মানী ভাতা পাচ্ছেন সাত হাজার ৮৩৮ জন। এঁদের মধ্যে আছেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবার ও বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ পরিবার। ১৯৭২ সালে ট্রাস্টের শুরুতে সাধারণ মুক্তিযোদ্ধারা ৩০ টাকা ভাতা পেতেন। এখন মাসে ন্যূনতম ভাতার পরিমাণ নয় হাজার ৭০০ টাকা।
মতিঝিলে ট্রাস্টের প্রধান কার্যালয়সহ বিভিন্ন বন্ধ শিল্পে কর্মরত জনবল প্রায় ৩০০। মাসে বেতন বাবদ ৫০ লাখ টাকার বেশি খরচ হয়। কিন্তু ৩২টি কারখানার মধ্যে শুধু পূর্ণিমা ফিলিং স্টেশন থেকে আয় হয় বড়জোর সাত লাখ টাকা। বাকি খরচ মেটানো হয় স্থায়ী আমানত থেকে।
প্রতিষ্ঠানগুলো ডুবছে কেন: অনুসন্ধানে জানা যায়, মূলত অব্যবস্থাপনা ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির কারণেই ট্রাস্টের লাভজনক প্রতিষ্ঠানগুলো একে একে মুখ থুবড়ে পড়ে। ট্রাস্টের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে জড়িত মুক্তিযোদ্ধারা জানান, ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত কল্যাণ ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠানগুলো লাভজনক ছিল। ট্রাস্ট থেকেই সব মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পেতেন। বিয়ে, চিকিৎসা, শিক্ষাসহ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রয়োজনীয় বিভিন্ন খরচ মেটানো হতো ট্রাস্টের আয় থেকে।
যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও কল্যাণ ট্রাস্টের সাবেক কর্মকর্তা মাহমুদ পারভেজ প্রথম আলোকে বলেন, ১৯৭৮ সালে পাকিস্তান আমলের দায়দেনা থাকা ১১টি প্রতিষ্ঠান কল্যাণ ট্রাস্টকে দেন জিয়াউর রহমান। এই দায় শোধ হওয়ার আগেই ১৯৭৯ সালে কল্যাণ ট্রাস্টের শ্রমিক-কর্মচারীদের তিনি দুই বছর আগে থেকে নতুন জাতীয় বেতন স্কেল কার্যকর করার নির্দেশ দেন। ফলে প্রায় পাঁচ কোটি টাকার বাড়তি চাপ সইতে পারেনি ট্রাস্ট।

ট্রাস্ট সূত্র জানায়, দায়দেনা থাকা প্রতিষ্ঠান ট্রাস্টকে দেওয়া, দুই বছর আগে থেকে বেতন স্কেল কার্যকর করায় আর্থিক সংকটে পড়ে ট্রাস্ট। এরপর ১৬ কোটি টাকায় ‘মাল্টিপল জুস কনসেনট্রেট প্ল্যান্ট’ স্থাপন করা হয় চট্টগ্রামে। সারা দেশের আনারস জোগাড় করেও কারখানাটি চালু করা সম্ভব ছিল না। ফলে শুরুর কয়েক দিনের মাথায় বন্ধ হয় ওই প্ল্যান্ট।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, ট্রাস্টকে দেওয়া শিল্পকারখানাগুলোর দু-একটি ছাড়া বাকিগুলো ছিল ১০-১৫ বছরের পুরোনো। এসব কারখানা চালানোর শ্রমিক থাকলেও ব্যবস্থাপনা পর্যায়ের সবাই ছিলেন অনভিজ্ঞ।
কল্যাণ ট্রাস্টের বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এ কে মোহাম্মদ আলী শিকদার ২০০৯ সাল থেকে চলতি বছর পর্যন্ত চার দফায় ছয় বছর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছেন। স্বাধীনতার পর থেকে ওই পদে কোনো কর্মকর্তা এত সময়ের জন্য দায়িত্ব পালন করেননি।
তবে বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালকের আমলে কিছু অগ্রগতি হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিয়মিত বেতন-ভাতা পাচ্ছেন। ট্রাস্টের সব জমির নামজারি হয়েছে। নারায়ণগঞ্জের নিতাইগঞ্জে বেদখল হওয়া ১৬ কাঠা জমি উদ্ধার হয়েছে। গ্যাস, পানি ও বিদ্যুৎ বিল বাকি নেই। সরকারের হস্তক্ষেপে সুদে-আসলে ১২৬ কোটি টাকা ব্যাংক মওকুফ করেছে। এ ছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো ট্রাস্টকে কালো তালিকা থেকে মুক্ত করেছে।
তবে ট্রাস্টের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একাংশ মনে করেন, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছয় বছরেও একটি বন্ধ কারখানা চালু করতে পারেননি; বরং ট্রাস্টের জমি ভবন নির্মাতাদের কাছে দিয়ে কোনোমতে টিকে থাকার কৌশল নিয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিষ্ঠানটির কোমর ভেঙে গিয়েছিল। উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা এখনো চলছে। ১০-১৫ বছর আগে বন্ধ কোনো প্রতিষ্ঠান আর চালু করা সম্ভব নয় বলে জানান তিনি।
কল্যাণ ট্রাস্টের বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান পদাধিকারবলে প্রধানমন্ত্রী। ট্রাস্টের কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত থাকায় বছরে একটি সভা করাও প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে সম্ভব হয় না। যেকোনো সিদ্ধান্তের জন্য প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন দরকার হয়, যা অনেক সময় কঠিন হয়ে পড়ে।
যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা গাজী এ কে এম ওসমান গণি প্রথম আলোকে বলেন, শহীদ পরিবারের সদস্য ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য এই ট্রাস্ট হলেও এর নীতিনির্ধারক পর্যায়ে থাকেন প্রেষণে আসা কর্মকর্তারা। ভুল বা সঠিক যা-ই হোক, তাঁদের সিদ্ধান্ত মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বাস্তবায়ন করেন। তাঁর মতে, নিশ্চয়ই ভুল সিদ্ধান্ত ছিল, নইলে পরিণতি এতটা খারাপ হবে কেন?
দ্বিতীয় কিস্তি পড়ুন আগামীকাল।