শ্রমিকেরা গুলিবিদ্ধ, পুলিশের শরীরে ইট–পাথরের আঘাত
চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলায় কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্রে সংঘর্ষের ঘটনার জন্য পরস্পরকে দায়ী করছেন আহত পুলিশ ও শ্রমিকেরা। আজ শনিবার সকালে বাঁশখালীর গন্ডামারায় সংঘর্ষের সময় পুলিশের গুলিতে পাঁচ শ্রমিক নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন তিন পুলিশসহ অন্তত ৩০ জন। আহত শ্রমিকেরা পুলিশকে দায়ী করেছেন। পুলিশের অভিযোগ, বিনা উসকানিতে ইটপাটকেল ছোড়ায় ঘটনার সূত্রপাত হয়।
শিল্প গ্রুপ এস আলমের মালিকানায় এসএস পাওয়ার প্ল্যান্ট নামে এই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মিত হচ্ছে। চীনা প্রতিষ্ঠান সেফকো থ্রি পাওয়ার কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড এখানে অর্থায়ন করেছে।
খাবার সময়সূচি, ৫ তারিখের মধ্যে বেতন পরিশোধসহ কিছু বিষয় নিয়ে নির্মীয়মাণ এসএস ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটির কিছু শ্রমিক কয়েক দিন ধরে ক্ষোভ প্রকাশ করে আসছিলেন। আজ এর বহিঃপ্রকাশ ঘটে বলে শ্রমিকেরা জানান।
আজকের ঘটনায় আহত শ্রমিকদের বেশির ভাগই গুলিবিদ্ধ। আর তিন পুলিশ শ্রমিকদের ছোড়া ইটপাটকেলের আঘাতে আহত হয়। আহতদের মধ্যে তিন পুলিশসহ ১৯ জনকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে অন্তত পাঁচজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছেন চমেক হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক আনোয়ারুল হক।
আনোয়ারুল হক আজ শনিবার বেলা আড়াইটায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের ওয়ার্ডে ১৩ জনকে ভর্তি করা হয়েছে। এর মধ্যে পাঁচজনের অবস্থা গুরুতর। সবাই গুলি বা স্প্লিন্টারে বিদ্ধ। তবে তা শর্টগান না কিসের গুলি, এখনই বলা সম্ভব নয়।’
বাঁশখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক সওগাত ফেরদৌস প্রথম আলোকে বলেন, ‘আহত অবস্থায় অনেককে হাসপাতালে আনা হয়েছিল। এর মধ্যে চারজন মারা গেছেন।’ তিনি জানান, নিহত চারজন হলেন আহমেদ রেজা (১৮), রনি (২২), শুভ (২৪) ও মো. রাহাত (২২)। আর চমেক হাসপাতালে আনার পর মো. রায়হান (১৮) নামের এক শ্রমিককে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
আহত যাঁরা
চমেক হাসপাতাল চিকিৎসাধীন আহত শ্রমিকেরা হলেন আমিনুল ইসলাম (২৫), মো. আমির (২৪), মো. দিদার (২১), মো. বিল্লাল (২৬), মো. আযাদ (১৮), মো. কামরুল (২৬), শিমুল (২৮), শাকিল (২৩), মোরাদ (২৫), মিজান (১৮), রাহাত (২৮), হাবিবুল্লাহ (১৮), হাসান (৪০) ও অভি (২০)। একই হাসপাতাল ভর্তি হওয়া আহত পুলিশ সদস্যরা হলেন মো. ইয়াসির (২৪), আহমদ কবির (২৬) ও আসদুজ্জামান। তিনজনই গন্ডামারা পুলিশ ফাঁড়িতে কর্মরত।
চমেক পুলিশ ফাঁড়ির কর্তব্যরত উপপরিদর্শক (এসআই) শীলাব্রত বড়ুয়া বলেন, শ্রমিকেরা গুলিবিদ্ধ হন। আর পুলিশ সদস্যদের জখম ইট ও পাথরের আঘাতে।
ঘটনার নেপথ্যে
খাবার সময়সূচি, ৫ তারিখের মধ্যে বেতন পরিশোধসহ কিছু বিষয় নিয়ে নির্মীয়মাণ এসএস ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটির কিছু শ্রমিক কয়েক দিন ধরে ক্ষোভ প্রকাশ করে আসছিলেন।
এখানে প্রায় পাঁচ হাজার শ্রমিক কর্মরত। আহত ও সাধারণ শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কয়েক দিন ধরে তাঁরা কাজের সময়সূচি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে আসছিলেন। এ নিয়ে একটি পক্ষ কাজে যাওয়া থেকে বিরত থাকতে চায়। যার কারণে শুক্রবার সকাল থেকে শ্রমিকদের থাকার জায়গায় (লিভিং স্পেস) জড়ো হয়ে কাজে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা তখন সেখানে বিক্ষোভ করে। এরপর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা শ্রমিকদের বুঝিয়ে শান্ত করেন।
প্রিয়তম সূত্রধর নামের এক মেকানিক্যাল শ্রমিক শনিবার চমেক হাসপাতালে বলেন, শ্রমিকদের কিছু আন্দোলন ছিল। এ জন্য কাজে না যাওয়ার পক্ষে ছিলেন বেশির ভাগ। যাঁরা কাজে যাচ্ছিলেন, তাঁদেরও টেনে আনা হয় আন্দোলনে। শুক্রবার বিক্ষোভের পর কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা হয়। পরে আজ সকালে পুলিশ জানায়, ‘আমাদের দাবিদাওয়া মেনে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু শ্রমিকেরা এতে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। এরপর গন্ডগোল শুরু হয়ে যায়।
হবিগঞ্জের ছেলে প্রিয়তম সূত্রধর ৩৩ হাজার টাকা বেতন পান। তাঁর কোনো বকেয়া বেতন নেই বলে জানান। তিনি অভি নামের তাঁর এক বন্ধু শ্রমিকের শুশ্রূষার জন্য হাসপাতালে আসেন।
মো. তৌহিদের বাড়ি বাঁশখালী। তিনি অস্থায়ী ভিত্তিতে কাজ করেন বিদ্যুৎকেন্দ্রে। তৌহিদ বলেন, বেতন ৫ তারিখে দেওয়ার দাবি ছিল। এ ছাড়া রমজানে মাসে নতুন সময়সূচি নির্ধারণের দাবি জানিয়ে আসছিলেন কিছু শ্রমিক। তাই শুক্রবার থেকে বিক্ষোভ শুরু হয়। কিছু শ্রমিক কাজে যেতে চাচ্ছিলেন। তাঁদেরও বাধা দেন শ্রমিকেরা। পুলিশ বিনা উসকানিতে গুলি করে।
বুকে গুলি লাগে আবু সৈয়দের (৫৪)। তিনি নিরাপত্তারক্ষী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। তিনি বলেন, ‘শ্রমিকেরা আন্দোলন করছিলেন। আমি মাঝখানে পড়ে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হই।’
অন্য আহত শ্রমিক জাবেদ আলীর গুলি লাগে পেটে। তাঁকে ধরাধরি করে নিয়ে আসছিলেন মারুফ ও আরেকজন শ্রমিক। জাবেদ আলী বেশি কথা বলতে পারছিলেন না। তিনি বলেন, শ্রমিকেরা কাজে যাচ্ছিলেন না। পুলিশ শুধু শুধু গুলি করেছে। তবে আহত পুলিশ সদস্যরা জানান, পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোড়ার পর আত্মরক্ষার্থে গুলি ছোড়া হয়। তিন পুলিশের মধ্যে দুজনের চোখে জখম হয়েছে।
আহত পুলিশ সদস্য মো. ইয়াসির বলেন, শ্রমিকদের শান্ত করার চেষ্টা করছিল পুলিশ। তখন তাঁরা ২০ জনের মতো ছিলেন। এ সময় শ্রমিকেরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়তে থাকেন। তখন পুলিশ গুলি করে।
আহত জাবেদ আলীর সঙ্গে আসা শ্রমিক মারুফ বলেন, ‘সময়সূচিসহ নানা বিষয় নিয়ে আন্দোলন হচ্ছিল। আমাদের ওখানে আন্দোলন চলছিল। আমরা নিজেরাই আন্দোলন করছিলাম। সে অর্থে কোনো নেতা নেই।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিলেটের এক শ্রমিক বলেন, ‘আমি কয়েক দিন হয় কাজে যোগ দিয়েছি। স্থানীয় শ্রমিকেরা ওখানে শক্তিশালী। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন এই আন্দোলনকে এগিয়ে নিচ্ছেন।’
স্থানীয় শ্রমিক তৌহিদ শ্রমিকনেতাদের নাম জানেন। কিন্তু তিনি বলতে রাজি নন। তিনি বলেন, ‘১০ জনের মতো আছেন, যাঁরা শ্রমিকদের স্বার্থের কথা ভেবে সিদ্ধান্ত নেন। তবে তাঁদের নাম আমি আপনাদের বলতে পারব না। তাঁদের জিজ্ঞেস করে বলতে হবে।’
মারুফের ভাইয়ের কান্না
ক্রেনচালক রায়হানকে মৃত ঘোষণা করা হয় চমেক হাসপাতালে আনার পর। এ সময় তাঁর পাশে ছিলেন চাচাতো ভাই মিরন হোসেন। মিরনের আরও এক আপন ভাই ক্রেন চালান সেখানে। তিনজনের বাড়ি নোয়াখালীর হাতিয়ায়।
গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর মিরন হোসেন ভাই রায়হানকে প্রথমে বাঁশখালী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও পরে চমেক হাসপাতালে নিয়ে আসেন। মিরন হোসেন বলেন, ‘আমরা ক্রেন চালাই। শ্রমিকেরা আমাদের কাজে যেতে দেননি। ঘটনা শুরু হওয়ার পর দেখতে গিয়ে আমার ভাই গুলিবিদ্ধ হয়। এরপর এখানে নিয়ে এলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। ভাইকে বাঁচাতে পারলাম না।’