শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলার চার বছর আজ
কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় নৃশংস জঙ্গি হামলার ঘটনার চার বছর পূর্ণ হলো আজ মঙ্গলবার। তবে ওই হামলার ঘটনায় করা মামলার সাক্ষ্যগ্রহণের কার্যক্রম এখনো শুরু হয়নি। সেই দুঃসহ স্মৃতি এখনো ভুলতে পারছেন না এলাকাবাসী।
২০১৬ সালের ৭ জুলাই ছিল পবিত্র ঈদুল ফিতরের দিন। কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠের অদূরে আজিম উদ্দিন উচ্চবিদ্যালয়ের পাশে পুলিশের ওপর হামলা চালায় জঙ্গিরা। তারা নির্মমভাবে চাপাতি ও কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে পুলিশের দুই কনস্টেবলকে। পরে জঙ্গিরা পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এ সময় একটি গুলি পাশের বাড়ির জানালা ভেদ করে গৃহবধূ ঝর্ণা রানী ভৌমিককে বিদ্ধ করে। এতে ঘটনাস্থলেই তিনি মারা যান। সেই দুঃসহ স্মৃতি ভুলতে পারছে না ঝর্ণার পরিবার।
গতকাল সোমবার বেলা দুইটার দিকে ঝর্ণা রানীর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, যে জানালা দিয়ে গুলি ঢুকেছিল, সেই জানালার নিচে নিহত ঝর্ণা রানীর পুরোনো ছবিটি তুলে নতুন ছবি লাগানো হচ্ছে। পাশেই মায়ের ছবির দিকে তাকিয়ে আছে ছেলে শুভদেব (১৫)। কান্নাজড়িত কণ্ঠে শুভ জানায়, মায়ের আঁচলে বাঁধা চাবির আওয়াজ এখনো তার কানে বাজে। যে জানালা দিয়ে বুলেটটি ঢুকেছিল, সেই জানালায় রয়ে গেছে বুলেটের ক্ষতচিহ্ন। সেখানে চোখ পড়লেই বুকটা মুচড়ে ওঠে তার।
এই হত্যাকাণ্ডের দ্রুত বিচার দাবি করে ঝর্ণা রানীর স্বামী গৌরাঙ্গ নাথ ভৌমিক বলেন, ওই ঘটনায় তাঁর পুরো পরিবার তছনছ হয়ে গেছে। ছোট ছেলেটার মুখের দিকে তাকালে কষ্ট সহ্য করা যায় না।
স্থানীয় বাসিন্দা নীরেন্দ্র চন্দ্র দাসসহ কয়েকজন জানান, সেই ঘটনা মনে হলে এলাকার মানুষ এখনো শিউরে ওঠেন। আজও মানুষের কানে বাজে মুহুর্মুহু সেই গুলির আওয়াজ।
ওই জঙ্গি হামলার প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় মসজিদের ইমাম মো. দ্বীন ইসলাম বলেন, প্রতিবছরই শোলাকিয়া ঈদ জামাত শেষ হলে তাঁর মসজিদে ঈদের জামাত হয়। সেই জামাতের জন্য প্রস্তুতি নিতে সকাল নয়টার দিকে তিনি মসজিদের ভেতর গোসল সেরে ছাদে কাপড় নাড়তে যাচ্ছিলেন। এমন সময় নিচে তিনি হট্টগোল শুনতে পান। মসজিদের দোতলার জানালার ফাঁক দিয়ে দেখেন, পাশের সড়কের ওপর দুই জঙ্গি নিষ্ঠুরভাবে দুই পুলিশ কনস্টেবলকে চাপাতি দিয়ে এলোপাতাড়ি কোপাচ্ছে। এতে ওই দুই পুলিশ সদস্য মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছেন। জঙ্গিরা থেমে থেমে কয়েক দফা পুলিশদের কোপায়। এ ধরনের হামলা ইসলাম কখনো সমর্থন করে না।
শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠের ঐতিহ্য ও মর্যাদা রক্ষায় দ্রুত এর বিচারকার্য শেষ করে দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন এলাকার বিশিষ্টজনেরা। ওই দিন পুলিশের তল্লাশির সময় জঙ্গিরা গ্রেনেড হামলা করে। এ ছাড়া তাদের চাপাতির কোপে দুই পুলিশ কনস্টেবল আনসারুল হক ও জহিরুল ইসলাম মারা যান। ওই সময় আরও ১২ পুলিশ সদস্য আহত হন। পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ঘটনাস্থলে জঙ্গি আবির রহমান মারা যান। উভয় পক্ষের গোলাগুলির মধ্যে নিজ বাসায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান এলাকার গৃহবধূ ঝর্ণা রানী ভৌমিক। এ ঘটনায় আটক করা হয় জঙ্গি শফিউল ও স্থানীয় তরুণ জাহিদুল ইসলাম ওরফে তানিমকে। পরে একই বছরের ৪ আগস্ট ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার ডাংরি এলাকায় র্যাবের সঙ্গে এক ‘বন্দুকযুদ্ধে’ শফিউল নিহত হন।
হামলার তিন দিন পর ১০ জুলাই পাকুন্দিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ সামসুদ্দীন বাদী হয়ে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে কিশোরগঞ্জ মডেল থানায় একটি মামলা করেন। এ ঘটনায় পুলিশ ২০১৮ সালের ১২ সেপ্টেম্বর আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে। আর ২৮ নভেম্বর মামলার অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। মামলাটি বর্তমানে কিশোরগঞ্জের স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল-২–এ বিচারাধীন। ২২ জুলাই সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য দিন ধার্য আছে।
মামলার তদন্ত করে শেষ পর্যন্ত মোট ২৪ জনকে আসামি করা হয়েছিল। তাদের মধ্যে বিভিন্ন জায়গায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানকালে ১৯ জন মারা যায়। বর্তমানে অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি হলেন কিশোরগঞ্জ শহরের জাহিদুল হক তানিম (২৭), গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার রাঘবপুরের জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধী (৩৪), কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার সাদীপুর (কাবলিপাড়া) গ্রামের সোহেল মাহফুজ (৩৫), চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার হাজারদীঘা গ্রামের বড় মিজান (৬২) ও গাইবান্ধা এলাকার আনোয়ার হোসেন (৪৮)। তাঁরা বর্তমানে দেশের বিভিন্ন কারাগারে বন্দী রয়েছেন।
কিশোরগঞ্জের পুলিশ সুপার মো. মাশরুকুর রহমান খালেদ প্রথম আলোকে বলেন, শোলাকিয়া হামলার ঘটনাটি এখন আদালতে বিচারাধীন। এ মামলায় ২০১৮ সালে ১২ সেপ্টেম্বর অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। দোষী ব্যক্তিদের যাতে সর্বোচ্চ শাস্তি সুনিশ্চিত হয়, পুলিশের পক্ষ থেকে সে চেষ্টা চলছে।