শেখ হাসিনার নামে আরও ৭ হত্যা মামলা

শেখ হাসিনাফাইল ছবি: বাসস

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র–জনতার আন্দোলনে গুলি চালিয়ে হত্যার অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আরও সাতটি মামলা হয়েছে। ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালত ও রাজধানীর বিভিন্ন থানায় গতকাল এবং আজ মঙ্গলবার এসব মামলা হয়েছে। এর বাইরে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আরও একটি হত্যা মামলা নেওয়ার আবেদন করা হয়েছে।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। এরপর থেকে আজ পর্যন্ত তাঁর বিরুদ্ধে ১৫৬টি মামলা হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ১৪০টিই হত্যা মামলা।

মামলায় শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকসহ বাড্ডা, যাত্রাবাড়ী, মোহাম্মদপুর, খিলগাঁও ও ধানমন্ডি এলাকার স্থানীয় ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও তাঁতী লীগের নেতা–কর্মীদের আসামি করা হয়েছে। মামলাগুলোয় বলা হয়েছে, গত ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র–জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনার নির্দেশে ছাত্রলীগ, যুবলীগ, পুলিশ ও র‍্যাব গুলি করে আন্দোলনকারীদের হত্যা করেছে। এলোপাতাড়ি গুলি কারও মথায় লাগে, কারও কপালে বা পিঠে। অধিকাংশ ব্যক্তি গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলে মারা গেছেন। বাকিদের গুলিবিদ্ধ অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

‘গুলিবিদ্ধ অবস্থায় বাঁচার আকুতি জানান রিয়াজ’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেওয়া শ্রমিক দলের কর্মী গিয়াস রিয়াজুল তালুকদারকে হত্যার অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ ১৩৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। সিএমএম আদালতে আজ এ মামলা করেন নিহত রিয়াজের ভাই রুবেল তালুকদার। আদালত মামলাটি এজাহার হিসেবে রেকর্ড করার জন্য যাত্রাবাড়ী থানার ওসিকে নির্দেশ দেন।

মামলার বাদী আরজিতে উল্লেখ করেন, গত ৪ আগস্ট বিকেলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেন শ্রমিক দলের কর্মী রিয়াজুল তালুকদার। তখন আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের লোকজন এলোপাতাড়ি ছাত্র–জনতার আন্দোলনে গুলিবর্ষণ করে। তখন রিয়াজুল তালুকদারের পিঠে গুলি লেগে বেরিয়ে যায়। তিনি তখন যাত্রাবাড়ীর চৌরাস্তার মোড়ে পড়ে ছিলেন। তাঁকে বাঁচানোর জন্য আকুতি জানান। মামলার আরজিতে আরও উল্লেখ করা হয়, একপর্যায়ে স্থানীয় লোকজন একটি ভ্যানে করে গিয়াস উদ্দিনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর রাত আটটার দিকে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

মামলায় শেখ হাসিনা ছাড়া আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক সংসদ সদস্য মশিউর রহমান সজল, সাবেক পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এনামুল হক শামীম, সাবেক সংসদ সদস্য ইকবাল হোসেন অপু, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বি এম মোজাম্মেল হক, সাবেক সংসদ সদস্য নাহিম রাজ্জাককে আসামি করা হয়েছে। এ ছাড়া যাত্রাবাড়ী এলাকার স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীদের আসামি করা হয়েছে মামলায়।

ওয়াসীমের মাথায় গুলি লাগে

যাত্রাবাড়ীতে ওয়াসীম (৩৮) নামের এক যুবককে হত্যার অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ ১১৯ জনের বিরুদ্ধে আরেকটি হত্যা মামলা হয়েছে। ওয়াসীমের ভাই জাহিদ হোসেন বাদী হয়ে ঢাকার সিএমএম আদালতে এ মামলা করেন। মামলায় বলা হয়, গত ১৮ জুলাই দুপুরে যাত্রাবাড়ীর হানিফ উড়ালসড়কের কাজলার টোল প্লাজার কাছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতা–কর্মী ও পুলিশ সদস্যরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র–জনতার ওপর এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করেন। তখন ওয়াসীমের মাথায় গুলি লাগে। পরে তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। মামলায় শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদের, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক সংসদ সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদকে আসামি করা হয়েছে।

গুলিবিদ্ধ কিশোর মাহমুদুল রাস্তায় পড়ে ছিল

যাত্রাবাড়ীর শনির আখড়ায় মাহমুদুল হাসান (১৪) নামের এক কিশোরকে গুলি করে হত্যার অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ ৩৭ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়েছে। ঢাকার সিএমএম আদালতে মাহমুদুলের আত্মীয় রবিউল আওয়াল বাদী হয়ে এ মামলা করেন। মামলার আরজিতে উল্লেখ করা হয়, গত ৫ আগস্ট দুপুরে শনির আখড়ায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল কিশোর মাহমুদুল। তখন স্থানীয় ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের গুন্ডারা এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করে। তখন গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পড়ে ছিল কিশোর মাহমুদুল। পরে তাঁকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

কিশোর ইসমাইলের গলায় গুলি

রাজধানীর মোহাম্মাদপুরে কিশোর ইসমাইলকে (১৭) গুলি করে হত্যার অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ ২৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা নেওয়ার আবেদন করা হয়েছে। ঢাকার সিএমএম আদালতে এ আবেদন করেন ইসমাইলের মা তসলিমা আক্তার। এ–সংক্রান্ত কোনো মামলা হয়েছে কি না, সেটি আদালতকে জানানোর জন্য মোহাম্মদপুর থানার ওসিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

মামলার আবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, গত ১৯ জুলাই বিকেলে মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড–সংলগ্ন আল্লাহ করিম মসজিদ মার্কেটের পশ্চিম পাশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল কিশোর ইসমাইল। তখন স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, তাঁতী লীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের লোকজন আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি ছোড়ে। তখন ইসমাইলের বাঁ গলায় গুলি লাগে। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

শামীমের বুকে গুলি লাগে

রাজধানীর রূপনগরে শামীম হাওলাদার নামের এক যুবককে হত্যার অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ ১১৫ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়েছে। শামীমের আত্মীয় সম্রাট বাদী হয়ে গতকাল ঢাকার সিএমএম আদালতে মামলা করেন। মামলার আরজিতে উল্লেখ করা হয়েছে, গত ২০ জুলাই রাজধানীর রূপনগর থানার প্রশিকার মোড়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র–জনতার আন্দোলনে অংশ নেন শামীম হাওলাদার। তখন ছাত্র–জনতার মিছিলে আওয়ামী লীগসহ ১৪ দলের নেতা–কর্মীরা গুলি করেন। শামীমের বুকে গুলি লাগলে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। পরে তাঁকে স্থানীয় লোকজন উদ্ধার করে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসকেরা মৃত ঘোষণা করেন। মামলায় শেখ হাসিনা ছাড়াও সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক, সাবেক সংসদ সদস্য ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লা, যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হোসেন খান, সাবেক সংসদ সদস্য শাহেদা তারেক, ঢাকা মহানগর যুব মহিলা লীগের সভাপতি সাবিনা আক্তার তুহিনকে আসামি করা হয়েছে।

মাথায় গুলি লাগে কিশোর আশিকুলের

রাজধানীর খিলগাঁওয়ের বনশ্রী এলাকায় ১৪ বছর বয়সী মাদ্রাসাছাত্র আশিকুল ইসলামকে হত্যার অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। খিলগাঁও থানায় গতকাল এ মামলা রেকর্ড হয়েছে। মামলায় মাদ্রাসাছাত্র আশিকুরের মা আরিশা আফরোজ উল্লেখ করেন, গত ১৯ জুলাই বিকেলে বনশ্রীর রোড–১, ব্লক–জি এলাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র–জনতার মিছিল চলছিল। তখন পুলিশ নির্বিচার গুলি চালায়। এ সময় আশিকুলের ডান কানের পাশে গুলি লেগে তা বাঁ কানের পাশ দিয়ে বের হয়ে যায়। তখন ঘটনাস্থলে মারা যায় আশিকুল। মামলায় শেখ হাসিনা ছাড়া সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল–মামুন, সাবেক ডিবিপ্রধান হারুন অর রশীদকে আসামি করা হয়েছে।

ধানমন্ডিতে রিয়াজের মাথায় গুলি লাগে

রাজধানীর ধানমন্ডিতে রিয়াজ (২৩) নামের এক তরুণকে হত্যার অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ ১৩৫ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়েছে। রিয়াজের মা শাফিয়া বেগম বাদী হয়ে গতকাল ধানমন্ডি থানায় এ হত্যা মামলা করেন। মামলায় রিয়াজ দাবি করেন, গত ৪ আগস্ট বেলা দেড়টার দিকে ধানমন্ডির ২ নম্বর রোড দিয়ে জিগাতলায় যাওয়ার সময় ছাত্র–জনতার মিছিলে ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের লোকজন গুলি করে। তখন রিয়াজের মাথায় গুলি লাগে। পরে তাঁকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। মামলায় সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, সাবেক তথ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাত, যুবলীগের সভাপতি শেখ ফজলে শামস পরশকে আসামি করা হয়েছে।

বাড্ডায় এমদাদুলের কপালে গুলি লাগে

বাড্ডায় এমদাদুল হক (২৬) নামের এক যুবককে গুলি করে হত্যার অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ ১২০ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়েছে। এমদাদুলের চাচাতো ভাই সাইফুল ইসলাম বাদী হয়ে গতকাল এ মামলা করেন। মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, গত ২০ জুলাই উত্তর বাড্ডার এ এম জেড হাসপাতালের কাছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ওপর ছাত্রলীগ, যুবলীগের লোকজন এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করে। তখন এমদাদুলের মাথায় গুলি লাগে। ঘটনাস্থলে তিনি মারা যান।