শূন্য থেকে আকাশ ছোঁয়ার পথে

বিদেশি গ্রাহকেরাও সুলভে বাংলাদেশে বিশ্বমানের ছবি ও ভিডিও সম্পাদনা, ত্রিমাত্রিক ছবির কাজ দেখে মুগ্ধ হন। বড় হতে থাকে কাওসারের স্বপ্ন।

দ্য কাও কোম্পানির কার্যালয়ে তথ্যপ্রযুক্তি উদ্যোক্তা কাওসার আহমেদ
ছবি: প্রথম আলো

আট বছর বয়সে মাকে হারিয়ে বোনদের কাছে বেড়ে উঠতে থাকেন কাওসার আহমেদ। যশোরের বিএএফ শাহীন কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক সম্পন্ন করার পর ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন বরিশাল মেডিকেল কলেজে। বাড়ি থেকেও চাপ ছিল। কিন্তু কাওসারের স্বপ্ন ছিল অন্য রকম। একপর্যায়ে বাড়ি ছাড়েন তিনি।

২০০৬ সালে যশোর থেকে ঢাকায় চলে আসেন। পকেটে টাকা ছিল না, ছিল না থাকার জায়গাও। এত সব সংশয় আর দ্বিধা নিয়ে সেই থেকে শুরু হয় কাওসারের অনিশ্চিত যাত্রা। সেই অনিশ্চয়তা তো কেটেছেই, বরং অন্য অনেকের অনিশ্চিত জীবনে নিশ্চয়তা এনে দিচ্ছে কাওসারের নিজের প্রতিষ্ঠান দ্য কাও কোম্পানি।

সাহসে ভর করে রাজধানীতে

ঢাকায় এসে কাওসারের যোগাযোগ হয় এক বন্ধুর সঙ্গে। সেদিন মিরপুর স্টেডিয়ামের সামনে বন্ধুর সঙ্গে দেখা করে ৫০০ টাকা ধার নিয়েছিলেন। সেই টাকা পুঁজি করেই ঢাকায় জীবনযাপন শুরু কাওসারের। উত্তরার দক্ষিণখানে এক মসজিদে রাত কাটান। এরপর মসজিদের ছাদে থাকা শুরু করেন। দূরসম্পর্কের এক চাচাতো ভাই দুজন ছাত্র জোগাড় করে দেন পড়ানোর জন্য। এতে দুবেলা খাবারের নিশ্চয়তা মেলে।

একসময় ঢাকা কলেজে ইংরেজি বিষয় নিয়ে স্নাতকে ভর্তি হন। উত্তরা থেকে ঢাকা কলেজের দূরত্বটা বেশি, যাতায়াত কঠিন হয়ে পড়ে। তখন কলেজের এক বন্ধুর সুবাদে মিরপুরের এক মেসে এসে ওঠেন কাওসার। স্থান সংকুলানের সংকট আর অর্থকষ্ট থাকায় মেসের মেঝেতে ঘুমিয়েছেন অনেক দিন। এমনও হয়েছে পকেটে টাকা না থাকায় মিরপুর ১০ নম্বর থেকে নিউমার্কেট পর্যন্ত হেঁটে এসেছেন। ছাত্র পড়াতে গিয়ে একদিন টিভিতে দেখলেন একটি কল সেন্টার কর্মী খুঁজছে। পরদিন সেখানে গেলেন সাক্ষাৎকার দিতে। গিয়ে জানলেন, ওই পদে এরই মধ্যে নিয়োগ হয়ে গেছে।

চাকরি এবং ব্যবসা

ওই অফিস থেকে পাওয়া তথ্য নিয়ে পরদিন আরেক কল সেন্টারে সাক্ষাৎকার দিতে যান কাওসার। চাকরিটা পেয়ে যান। কিন্তু কল সেন্টারের কাজে ঠিকঠাক মানিয়ে উঠতে পারেন না। ছয় মাসের মাথায় জন্ডিসে আক্রান্ত হয়ে চাকরি ছাড়তে হয় তাঁকে। আবার টিউশনি শুরু করেন। পাশাপাশি নতুন কিছু করার খোঁজ করতে থাকেন কাওসার।

এবার বন্ধুর মাধ্যমে কাপড়ের স্টকলট (মজুত থাকা পোশাক) কেনাবেচার ব্যবসা শুরু করেন। কয়েকজন মিলে খোলেন বায়িং হাউসও। যেহেতু ইংরেজিতে দক্ষ ছিলেন, তাই বিদেশি বায়ারদের (ক্রেতা) সঙ্গে সখ্য হতে সময় লাগত না কাওসারের। তবে বছর কয়েক পরে বায়িং হাউসের ব্যবসায় বেশ লোকসান হয়। আবার শুরু হয় কাওসারের জীবনসংগ্রাম।

একদিন কাওসার তাঁর এক বায়ারকে জিজ্ঞেস করেন, ‘এই যে তোমরা আমাদের কাছ থেকে কাপড়ের নমুনা নিয়ে যাও, ওগুলো দিয়ে কী করো?’ বায়ার বলেন, ‘আমরা আগে ছবি তুলি।’ কাওসারের কৌতূহলী জিজ্ঞাসা, ‘ছবি তো আমরাই তোমাদের তুলে পাঠাই। তাহলে আবার ছবি তোলো কেন?’ এবার বায়ারের জবাব, ‘তোমরা যে ছবি তোলো, সেগুলো খুব বাজে হয়। একদম আকর্ষণীয় না। আমরা যাদের ছবি তুলতে পাঠাই, তারা এডিট করে ছবিকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে।’

আমিও তো পারি

কয়েকটা ছবি দেখে কাওসারের মাথায় বুদ্ধি খেলে যায়। ওই বায়ারকে আবার জিজ্ঞেস করেন, ‘তোমরা এমন একটা ছবির জন্য কত টাকা দাও।’ বায়ার জানালেন দুই থেকে তিন ডলারের মতো। এবার কাওসার পাল্টা প্রস্তাব দেন, ‘আমি যদি তোমাকে দেড় ডলারে একটা ছবি করে দিই, তুমি আমাকে কাজটা দেবে?’ বায়ার রাজি হয়ে যান। কাওসার সঙ্গে সঙ্গে দুজন ফটো এডিটর খুঁজে বের করেন। শুরু করেন কাজ।

প্রথম মাসেই ওই বায়ারের কাজ করে আয় করেন ৩৩৮ ডলার। তখন ২০১৪ সাল। এরপর ধীরে ধীরে আরও কাজ আসে। বাড়তে থাকে আয়। দুজন কর্মী থেকে লোকবল বেড়ে দাঁড়ায় ১৭ জনে।

এবার নিজের কোম্পানি

শুরুর দিকে পূর্বপরিচিত এক ব্যবসায়ীর অফিসে ক্ষুদ্র পরিসরে যাত্রা শুরু করে কাওসারের নিজের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান বিভি ক্রিয়েটিভস লিমিটেড। এরপর লোকবল বাড়তে থাকলে নিজেদের অফিস নেন। শুরুর বায়ারের সুপারিশে আরও গ্রাহক আসতে থাকে। প্রতিষ্ঠানের আয় দাঁড়ায় মাসে আট হাজার ডলারে। প্রতি মাসেই ছবি সম্পাদনার জন্য ৫ থেকে ১০-২০ জন লোক নিয়োগ হতে থাকে।

২০১৬ সালের মার্চে প্রথমবারের মতো সরকারি প্রকল্পের অংশ হয়ে বেসিসের সহায়তায় জার্মানিতে একটি মেলায় অংশ নেওয়ার সুযোগ পায় প্রতিষ্ঠানটি। কাওসার বলেন, ‘সেটা ছিল জীবন বদলে দেওয়ার মতো অভিজ্ঞতা। ওখানে যাওয়ার পর আমার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যায়। অনেক নতুন বিষয় জানতে পারি। চিন্তার পরিধি বেড়ে যায়।’ জার্মানির মেলায় বিভিন্ন দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজ দেখে কাওসার আরও বড় পরিসরে ভাবনার উপায় খুঁজে পান। নিজেদের কাজের পরিধি বাড়ানোর উদ্যোগ নেন।

দ্য কাও কোম্পানি

এভাবে ভালোই চলছিল সব। ২০১৭ সালে ব্যবসায় মন্দা লেগে গেল। পুরোনো অংশীদারেরা চলে যান। একা হয়ে পড়েন কাওসার। নিজেই হাল ধরেন নিজের প্রতিষ্ঠানের। প্রতিষ্ঠানের নতুন নাম দেন—দ্য কাও কোম্পানি। এদিকে তত দিনে প্রতিষ্ঠানের ব্যাপ্তি এত বেড়ে গিয়েছিল যে একা চালিয়ে নেওয়া ছিল কঠিন এক কাজ।

বেশি দিন অপেক্ষা করতে হয় না কাওসারকে। তাঁর অংশীদার হিসেবে কিছুদিন পরই যুক্ত হন তথ্যপ্রযুক্তি উদ্যোক্তা নাজিম ফারহান চৌধুরী। নতুন উদ্যমে শুরু হয় দ্য কাও কোম্পানি। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে কাজের পরিধি। একসময় সরাসরি ভিনদেশি গ্রাহকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বাংলাদেশে কাজ আনতে শুরু করেন কাওসার। বিদেশি গ্রাহকেরাও সুলভে বাংলাদেশে বিশ্বমানের ছবি ও ভিডিও সম্পাদনা, ত্রিমাত্রিক (থ্রিডি) ছবির কাজ দেখে মুগ্ধ হয়ে যান। এভাবে ঘুরে দাঁড়িয়ে আরও বড় হতে থাকে কাওসারের স্বপ্ন। আর স্বপ্নপূরণও হতে থাকে ধীরে ধীরে। রাজধানীর পান্থপথের নাভানা ডিএইচ টাওয়ারের অফিসে বসে কাওসার বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র, নিউজিল্যান্ড, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়াসহ প্রায় সব বড় বড় দেশের নামকরা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমরা কাজ করছি। বিশ্বের প্রথম সারির তিনটি স্পোর্টস ব্র্যান্ড আমাদের গ্রাহক।’

স্বপ্ন দেখেন হাজারো তরুণের জন্য

মাত্র দুজন ফটো এডিটর নিয়ে যে পথে হাঁটা শুরু করছিলেন কাওসার, সেটা এখন তাঁকে আরও বড় লক্ষ্যের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। কাওসার জানান, এখন তাঁর প্রতিষ্ঠানে তিন পালায় কাজ করছেন ৬০০ কর্মী। প্রতি মাসে কর্মীদের বেতন দেন প্রায় এক কোটি টাকা। তিন বেলার খাবারও দেওয়া হয় অফিস থেকে। চলতি বছরেই দ্য কাও কোম্পানির কর্মী বাড়িয়ে পাঁচ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান করতে চান তিনি।

তাঁর কোম্পানিতে যেন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসেও কাজ করা যায়, সেই ব্যবস্থাও তিনি চালু করতে যাচ্ছেন। তাহলে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা তরুণেরা প্রযুক্তি খাতে কাজের সুযোগ পাবেন সহজেই। এমন করেই ৩২ বছর বয়সী কাওসারের স্বপ্ন ছড়িয়ে পড়বে দেশের হাজারো তরুণের মধ্যে।