২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

শুধু জানা গেল শনাক্ত হওয়া যুবক ‘ভবঘুরে’

পুলিশ বলছে, পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন নিয়ে যান ইকবাল নামের এক যুবক। রাতে কক্সবাজারে ইকবাল সন্দেহে এক যুবক আটক।

ইকবাল হোসেন

কুমিল্লার নানুয়া দীঘির পাড়ের অস্থায়ী পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন রেখেছিলেন শহরের দ্বিতীয় মুরাদপুরের লস্করপুকুরপাড়ের বাসিন্দা ইকবাল হোসেন। পূজামণ্ডপের আশপাশের বিভিন্ন বাসা–প্রতিষ্ঠান ও শহরের কয়েকটি এলাকার ক্লোজড সার্কিট টিভি (সিসিটিভি) ক্যামেরার ফুটেজ দেখে এটি নিশ্চিত হয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বয়সে তরুণ ইকবাল ‘ভবঘুরে ও মাদকাসক্ত’—এমন তথ্যও দিচ্ছে পুলিশ।

তবে ইকবাল কেন পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন রাখতে গেলেন—এ প্রশ্নের উত্তর কারও কাছে নেই। পুলিশের ধারণা, ইকবালকে দিয়ে অন্য কেউ এই কাজ করিয়েছে। তাঁর পরিবারের সদস্য এবং স্থানীয় বাসিন্দারাও এমনটা মনে করছেন। কে বা কারা পেছনে থেকে এই কাজ করিয়েছে, তাদের উদ্দেশ্য কী—এসব প্রশ্ন এখন বড় হয়ে উঠেছে?

এদিকে ইকবাল হোসেন নামের এক যুবককে গতকাল বৃহস্পতিবার রাত ১০টায় কক্সবাজার সৈকতের সুগন্ধা এলাকা থেকে আটক করেছে পুলিশ। এ বিষয়ে পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক মো. আনোয়ার হোসেন গত রাত সাড়ে ১১টায় মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা প্রাথমিকভাবে মনে করছি, আটক ব্যক্তিই কুমিল্লার ইকবাল। তাঁর পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার জন্য কুমিল্লায় পাঠানো হয়েছে। স্থানীয় পুলিশ যাচাই-বাছাই করে বিষয়টি নিশ্চিত করবে।’

কুমিল্লার হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতৃস্থানীয় দুজন নেতা নাম না প্রকাশের শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ইকবাল নিজে থেকে ওই কাজ করার কোনো কারণ আছে বলে তাঁরা মনে করেন না। স্থানীয় কিছু মানুষ নানুয়া দীঘির পাড়ে পূজামণ্ডপ থাকুক, তা চাইছিলেন না। তাঁদের মধ্যে ঘটনার পর ফেসবুকে প্রথম বিষয়টি প্রচার (লাইভ) করা মো. ফয়েজও আছেন। একটা কিছু ঘটিয়ে পুজামণ্ডপটি স্থায়ীভাবে বন্ধ করার উদ্দেশ্যও থাকতে পারে। তাঁরা দুজন মনে করেন, আগামী বছরের শুরুতে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন। নির্বাচনে রাজনৈতিক ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা করতে পারেন কেউ কেউ। এর বাইরে জাতীয়-আন্তর্জাতিক রাজনীতির অংশ হিসেবে ষড়যন্ত্রও থাকতে পারে। কোনটি প্রকৃত সত্য, সেটি পুলিশকে বিশ্বাসযোগ্যভাবে প্রমাণ করতে হবে।

কুমিল্লা মহানগর পূজা উদ্‌যাপন কমিটির সভাপতি শিবপ্রসাদ রায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘটনার পেছনে কে বা কারা, তাঁদেরও শনাক্ত করতে হবে। ইকবালকে জীবিত গ্রেপ্তার করা দরকার। তাঁর কাছ থেকে মূল তথ্য উদ্‌ঘাটন করতে হবে। তদন্তের জন্য প্রয়োজনে আরও সময় নিক পুলিশ।

কে এই ইকবাল

পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, ইকবাল কখনো বাসচালকের সহকারী (হেলপার), কখনো রংমিস্ত্রির সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন।

ইকবালের বাবা নুর আহমেদ আলম, মা বিবি আমেনা বেগম। তাঁদের তিন ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে ইকবাল বড়। তাঁর মা আমেনা বেগম জানান, ১০ বছর আগে চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলায় প্রথম বিয়ে করেন ইকবাল। প্রথম স্ত্রীর ঘরে একটি ছেলে আছে। পাঁচ বছর আগে তাঁদের বিচ্ছেদ হয়। এরপর কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে দ্বিতীয় বিয়ে করেন। এই ঘরে একটি মেয়ে আছে। তাঁর ছেলের আচরণ নিয়ে প্রশ্ন তুলে দ্বিতীয় স্ত্রী বাবার বাড়ি চলে গেছেন।

পরিবারের অন্য সদস্যরা জানান, ইকবাল ভবঘুরের মতো জীবন কাটান। মাদকের টাকার জন্য পরিবারের সদস্যদের বিরক্ত করেন।

গতকাল সকালে কুমিল্লা শহরের ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের মুরাদপুর লস্করপাড়া এলাকা ঘুরে স্থানীয় ৩০ জন বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁরা বলেছেন, ইকবালদের মূল বাড়ি ছিল শহরের তেলিকোনা এলাকায়। সেখান থেকে ভিটেবাড়ি বিক্রি করে এই এলাকায় এসে ভাড়া থাকে পরিবারটি। লস্করপাড়া থেকে নানুয়া দীঘির দূরত্ব প্রায় তিন কিলোমিটার।

ইকবালের মা আমেনা বেগম জানান, ভিডিও ফুটেজে যে ছবি দেখা গেছে, তা ইকবালের। ১১ অক্টোবরের সন্ধ্যার পর ছেলের সঙ্গে তাঁর আর দেখা হয়নি। তিনি বলেন, ‘ইকবাল নেশাখোর ছিল।’

ইকবালদের বাসার কাছেই থাকেন তাঁর নানি বিবি রহিমা। তিনি বলেন, ইকবালের বিচার হওয়া উচিত।

এদিকে ইকবালের বাবা নুর আহমেদ, ভাই সাফায়েত হোসেন ও মামা তাজুল ইসলামকে গত শনিবার সন্ধ্যায় পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যায়। তাঁদের আটক করা হয়েছে কি না, এ বিষয়ে পুলিশ কিছু বলেনি।

ফুটেজে যা দেখা গেল

সেদিন রাতে ইকবালই পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন শরিফ রেখেছেন—বুধবার সন্ধ্যায় এটি নিশ্চিত করে পুলিশ। জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে সিসিটিভি ক্যামেরায় ধারণ করা দুটি ফুটেজও সরবরাহ করা হয় সাংবাদিকদের। গতকাল বিকেলে ১৬ মিনিট ৫২ সেকেন্ডের আরেকটি ফুটেজ দেখায় পুলিশ। এতে কিছু কিছু স্থানে বাংলায় ক্যাপশন জুড়ে দেওয়া হয়।

সর্বশেষ ফুটেজে ঘটনার আগের স্থির ছবিও জুড়ে দেওয়া হয়। এতে দেখা যায়, পূজামণ্ডপে রাখা হনুমানের মূর্তির সঙ্গে গদা আছে। পরে সেখানে গদাটি নেই। মূর্তির পায়ের কাছে পবিত্র কোরআন রাখা। কিন্তু এই ফুটেজের কোথাও পবিত্র কোরআন রাখা কিংবা মূর্তি থেকে গদা নিয়ে যাওয়ার কোনো দৃশ্য নেই। কারণ, পূজামণ্ডপে কোনো সিসিটিভি ছিল না। পুলিশ আশপাশের বাসাবাড়ি এবং শহরের বিভিন্ন স্থানের ফুটেজ সংগ্রহের পর তা বিশ্লেষণ করে এবং ফুটেজ জোড়া দিয়ে ঘটনার পরম্পরা তুলে ধরেছে।

পুলিশের পাঠানো ফুটেজের এক জায়গায় ক্যাপশনে বলা হয়, ইকবাল প্রায়ই মাজারে যাতায়াত করতেন। ঘটনার আগের রাতেও তাঁকে দারোগা বাড়ি মসজিদ ও মাজারে প্যান্ট ও গেঞ্জি পরে ঢুকতে দেখা যায়।

উল্লেখ্য, নানুয়া দীঘি থেকে দারোগা বাড়ি মসজিদ ও মাজার প্রায় আধা কিলোমিটার দূরে।

এটি কোনো ভবঘুরের কাজ হতে পারে না। এটি পূর্বপরিকল্পিত ঘটনা। চক্রান্তকারীরা পেছনে আছে। এদের বের করা রাষ্ট্র ও সরকারের দায়িত্ব।
রানা দাশগুপ্ত, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ

আরেকটি ফুটেজে দেখা গেছে, ১২ অক্টোবর রাত ১০টা ৩৮ মিনিটে ইকবালকে মসজিদে দেখা যায়। মাজারের খাদেম ফয়সল ও হাফেজ হুমায়ুন আগে থেকেই মসজিদে ছিলেন। রাত ১১টার দিকে প্রথমে হাফেজ হুমায়ুন, পরে খাদেম ফয়সল বের হয়ে যান। কিছুক্ষণ পর ইকবালও বেরিয়ে যান। রাত ২টা ১২ মিনিটে ইকবাল আবার মসজিদে ঢোকেন।

ফুটেজে দেখা গেছে, ইকবাল হোসেন একটি বাক্সের ওপরে রাখা পবিত্র কোরআন হাতে নিয়ে মেঝেতে বসেন। রাত ২টা ১৭ মিনিটের দিকে পবিত্র কোরআন হাতে নিয়ে মসজিদ থেকে বেরিয়ে মাজারের উত্তর পাশের সড়ক দিয়ে চলে যান। একপর্যায়ে ইকবালের সঙ্গে চকবাজার এলাকায় দুজন নৈশপ্রহরীর দেখা হয়, তাঁরা কথাও বলেন। এরপর ইকবাল পবিত্র কোরআন হাতে নিয়ে দিগম্বরীতলা সড়ক দিয়ে নানুয়া দীঘির পূজামণ্ডপের দিকে যান।

পুলিশ বলছে, ইকবাল তাঁর হাতে থাকা কোরআন শরিফ পূজামণ্ডপে রেখে গদাটি নিয়ে চলে আসেন। এরপর তিনি কিছুক্ষণ এলোমেলো ঘোরাঘুরি করেন। ফুটেজগুলো সবই রাতের। ধারণা করা হচ্ছে, ফজরের নামাজের আগে-পরে কোনো এক সময় তিনি এই কাজ করেছেন।

কুমিল্লা জেলা পুলিশ সুপার ফারুক আহমেদ বলেন, বিভিন্ন স্থানের ফুটেজ সংগ্রহ করে ঘটনার পুরোটা বোঝার চেষ্টা করেছেন তাঁরা। এর মাধ্যমেই ইকবাল যে কাজটি করেছে, তা নিশ্চিত হয়েছেন। তিনি বলেন, ‘মূল টার্গেট হলো কে পরিকল্পনাকারী, তাঁকে ধরা। সেই লক্ষ্যে পুলিশের কয়েকটি দল মাঠে আছে। আমরা সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করছি।’

কাউন্সিলরের সঙ্গে ইকবালের কী সম্পর্ক

ইকবালদের বাসা কুমিল্লা শহরের ১৭ নম্বর ওয়ার্ডে পড়েছে। এখানকার কাউন্সিলর মো. সোহেল আওয়ামী লীগ-সমর্থিত। তিনি মহানগর আওয়ামী লীগেরও সদস্য।

ইকবালের নানির বাসা কাউন্সিলর কার্যালয়ের পাশেই। ইকবাল নানির বাসাতেই বেশি থাকতেন। পরিবার ও স্থানীয় লোকজন জানান, কাউন্সিলরের সঙ্গে ইকবাল ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের সখ্য আছে। আর্থিকভাবেও কাউন্সিলর তাঁদের সহায়তা করেন।

ইকবালের মা আমেনা বেগম বলেন, ‘আমার স্বামী টুকটাক ব্যবসা করেন। কাউন্সিলর মো. সোহেল আমার স্বামীকে বিভিন্ন সময়ে সহযোগিতা করেন। কিছুদিন আগেও চার হাজার টাকা দিয়েছেন ব্যবসা করার জন্য। আমার ছেলে ইকবালকে ভাগিনা বলে মায়া করতেন কাউন্সিলর।’

নানুয়া দীঘির পূজামণ্ডপটি ১২ নম্বর ওয়ার্ডে। ১৩ অক্টোবর ঘটনার দিন যখন পূজামণ্ডপ ঘেরাও করা হয়, তখন কাউন্সিলর সোহেল সেখানে ছিলেন। তাঁকে একপর্যায়ে মাইক হাতে নিয়ে বিক্ষুব্ধদের শান্ত হওয়ার আহ্বান জানাতে দেখা গেছে।

স্থানীয় লোকজন বলছেন, কাউন্সিলর সোহেল রাজনৈতিকভাবে এতটা প্রভাবশালী নন। ওই দিন তাঁর এগিয়ে আসা কিছুটা অবাক করা বিষয়।

কাউন্সিলর মো. সোহেল প্রথম আলোকে বলেন,‘ইকবালকে আমি চিনি। তাঁর পরিবার আমার পরিচিত। আমার ওয়ার্ডের বাসিন্দা। তাঁর মাথার একটা দুইটা তার ছেঁড়া।’

১৩ অক্টোবর ভোরে কুমিল্লার নানুয়া দিঘির উত্তর পাড়ের অস্থায়ী পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন অবমাননাকে কেন্দ্র করে কুমিল্লা শহরের ৭টি পূজামণ্ডপ এবং ৪টি মন্দিরে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এর জের ধরে চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ, নোয়াখালীর চৌমুহনী, রংপুরের পীরগঞ্জসহ বিভিন্ন স্থানে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। এর মধ্যে কুমিল্লার ঘটনায় শহরের কোতোয়ালি মডেল থানায় পাঁচটি মামলা হয়। গত আট দিনে ঢাকা ও কুমিল্লার পুলিশের বিভিন্ন দল বিষয়টি তদন্ত করছে। এর মধ্যে ৪৩ জনের মতো গ্রেপ্তার হয়েছেন।

কুমিল্লার ঘটনায় মূল অভিযুক্তকে শনাক্ত করার বিষয়ে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত গতকাল চট্টগ্রাম শহরের নিজ বাসভবনে সাংবাদিকদের বলেন, ইকবাল হোসেন নামে যাঁকে চিহ্নিত করা হয়েছে, তাঁর নামের আগে একটা শব্দ জুড়ে দিল। সেটা হলো ভবঘুরে। কখনো কখনো এমন যাদের ধরা হয়, কখনো বলে পাগল, না হলে বলে ভবঘুরে। এই ভবঘুরে কীভাবে পবিত্র কোরআন শরিফ চিনল? এটি কোনো ভবঘুরের কাজ হতে পারে না। এটি পূর্বপরিকল্পিত ঘটনা। চক্রান্তকারীরা পেছনে আছে। এদের বের করা রাষ্ট্র ও সরকারের দায়িত্ব।