শিশুরাই সম্প্রীতির সেতুবন্ধ

যশোরের অভয়নগরের মালোপাড়া ও মোল্যাপাড়ার মানুষের মধ্যে উদ্বেগ–উৎ​কণ্ঠা দূর করে সম্প্রীতি-সৌহার্দ্য বাড়াতে সরকার একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। তারই অংশ হিসেবে দুই পাড়ার হিন্দু-মুসলিম পরিবারের শিশুরা একত্রে বসে খেলাধুলা করে। অংশ নেয় নানা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে। গতকাল বিকেলে ছবিটি তুলেছেন এহসান-উদ-দৌলা
যশোরের অভয়নগরের মালোপাড়া ও মোল্যাপাড়ার মানুষের মধ্যে উদ্বেগ–উৎ​কণ্ঠা দূর করে সম্প্রীতি-সৌহার্দ্য বাড়াতে সরকার একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। তারই অংশ হিসেবে দুই পাড়ার হিন্দু-মুসলিম পরিবারের শিশুরা একত্রে বসে খেলাধুলা করে। অংশ নেয় নানা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে। গতকাল বিকেলে ছবিটি তুলেছেন এহসান-উদ-দৌলা

আগুনে পুড়েছিল দুলাল-রণজিতা বিশ্বাস দম্পতির ঘর। পুড়েছিল জীবিকার অবলম্বন জাল-দড়ি। পুড়ে যাওয়া ঘরটি সংস্কার করে নতুন করা হয়েছে। নতুন হয়েছে জাল-দড়িও। ঘরের ঠিক ১০০ গজের মধ্যে হয়েছে পুলিশ ক্যাম্প। তাঁদের এক মেয়ে যোগ দিয়েছেন পুলিশ বাহিনীতে। তবু আতঙ্ক তাঁদের পিছু ছাড়ছে না কিছুতেই। সাম্প্রদায়িক হামলার এক বছর পরও যশোরের অভয়নগর উপজেলার চাঁপাতলা গ্রামের মালোপাড়ায় এই দম্পতির চোখে-মুখে আতঙ্কের ছাপ।
গতকাল শনিবার মালোপাড়ায় গিয়ে বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে দুলাল-রণজিতা দম্পতির মতো তাঁদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কথা জানা গেল। তবে আশার কথা, সম্প্রীতির সেতুবন্ধন গড়তে হিন্দু–মুসলিম পরিবারের শিশুদের নিয়ে চাঁপাতলায় চালু করা হয়েছে শিশুবান্ধব কেন্দ্র।
রণজিতা বিশ্বাস বলেন, ‘ঘরের পেছনেই পুলিশ ক্যাম্প। তাই এখন ভালো আছি। তার পরও হামলাকারীরা যখন বলে “ওদের রক্ত দিয়ে গোসল করব”, “লবণ দিয়ে গিলে খেয়ে ফেলব” তখন ভয়ে বুকটা কেঁপে ওঠে। ঘটনার পর থেকে ভয়ে একটি রাতও ঠিকমতো ঘুমাতে পারিনি। জানি না ভবিষ্যতে কী হবে!’
রণজিতার স্বামী দুলাল বিশ্বাস বলেন, ‘হামলাকারীরা আজেবাজে কথা বলে। মোল্যাপাড়ার অনেকেই এখনো দেখা হলে কথা বলে না। তখন খুব খারাপ লাগে।’
পাড়ার মনোদাসী বর্মণ বলেন, ‘স্বস্তিতে নেই। নানা কথা কানে আসে। সরকার পরিবর্তন হলে ওরা মালোপাড়া থেকে খরচের টাকা তুলে নেবে বলে হুমকি দেয়।’ মীরা বিশ্বাস বলেন, ‘এখন অবস্থা ভালো। পরে সমস্যা হবে। পালায়ও বাঁচব না। আগেরবার গাঙ পার হয়ে পলায়ছিলাম। এবার যে কোথায় যাব?’
বিশ্বজিৎ সরকার বলেন, ‘সার্বিক অবস্থা মোটেও ভালো নয়। ওরা সরাসরি কিছু বলে না। আশপাশ থেকে নানা হুমকি শোনা যায়। কিছু আসামি পলাতক ছিল। তারা এখন এলাকায় ফিরে এসেছে।’
শেখর কুমার বর্মণ নামের এক বাসিন্দা বলেন, ‘স্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প তৈরি, একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এবং ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িঘর নির্মাণ আমাদের দাবি ছিল। প্রতিশ্রুতিও পেয়েছিলাম সরকারের কাছ থেকে। কিন্তু এ পর্যন্ত ৫৫টি বাড়ি নির্মাণ এবং ২৩টি বাড়ি সংস্কার ছাড়া কোনো প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হয়নি। গত বছরের ২৩ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী আসার আগে খোয়া ও বালু মিশিয়ে রাস্তা সংস্কার করা হয়েছিল। শুনেছিলাম পরে পিচ দেওয়া হবে। কিন্তু তা আর হয়নি। খোয়া উঠে রাস্তার অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গেছে।’
এদিকে মোল্যাপাড়ার লোকজনের সঙ্গে মালোপাড়ার লোকজনের সম্পর্ক উন্নয়ন করতে ‘সম্প্রীতি প্রকল্প’ নামে ছয় মাসের একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। ইউনিসেফের আর্থিক সহায়তায় মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। জেলা শিশু একাডেমী সূত্র জানায়, প্রকল্পের আওতায় এলাকায় একটি শিশুবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করা হচ্ছে। এ জন্য মালোপাড়ার ১৪০ ও মোল্যাপাড়ার ৮১টি শিশুকে এই প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া অনুষ্ঠান এবং চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার মাধ্যমে দুই পাড়ার শিশুদের মধ্যকার দূরত্ব কমিয়ে আনা হচ্ছে। অভিভাবকদেরও এই প্রকল্পে সম্পৃক্ত করা হয়েছে।
জেলা শিশুবিষয়ক কর্মকর্তা সাধন কুমার দাস বলেন, ‘সাম্প্রদায়িক হামলার পর দুই পাড়ার শিশুদের মনে যে ভয়ভীতি, আতঙ্ক ও অনাস্থা সৃষ্টি হয়েছে, তা দূর করতে প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়েছে। আর এই শিশুরাই দুই পাড়ার লোকজনের মধ্যে সেতুবন্ধ তৈরি করবে। আগের মতো সম্প্রীতি তৈরি হবে।’
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট দেওয়ায় গত বছরের ৫ জানুয়ারি সন্ধ্যায় জামায়াত ও বিএনপির আড়াই থেকে তিন শ নেতা-কর্মী রামদা, হকিস্টিক, লোহার রড, লাঠি ও বোমা নিয়ে মালোপাড়ায় অতর্কিতে হামলা চালান। তাঁরা ১০-১৫টি বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করেন। আতঙ্কিত লোকজন বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে থাকেন। এ সময় তাঁরা শতাধিক বাড়িঘর ভাঙচুর এবং ঘরে থাকা মালামাল লুটপাট করেন। অন্তত ১০টি বাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেন তাঁরা। তাঁদের হামলায় অন্তত ২০ জন আহত হন। এ সময় আতঙ্কিত চার শতাধিক নারী-পুরুষ-শিশু পাশের ভৈরব নদ সাঁতরে ও ইঞ্জিনচালিত নৌকায় করে পার হয়ে দেয়াপাড়া গ্রামের পালপাড়া এলাকার পূজামণ্ডপে আশ্রয় নেন।
ওই ঘটনায় অভয়নগর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মহসিন হাওলাদার বাদী হয়ে ৩৯ জনের নাম উল্লেখ করে ও আড়াই শতাধিক অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির নামে মামলা দায়ের করেন। এ পর্যন্ত মামলার এজাহারভুক্ত আটজন আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। আদালতে তাঁদের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী আরও তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে পুলিশ জানায়। তাঁরা সবাই এখন জামিনে আছেন। ওই বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি বহুল আলোচিত এ মামলাটি পুলিশের জেলা গোয়েন্দা শাখায় (ডিবি) স্থানাস্তর করা হয়। এরপর গত ২৫ মে মামলাটি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি) পাঠানো হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত মামলাটির অভিযোগপত্র দেওয়া হয়নি।
যশোর সিআইডির পরিদর্শক আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করা হয়েছে। অহেতুক কেউ যাতে হয়রানির শিকার না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা হয়েছে। বারবার যাচাই-বাছাই করা হয়েছে। এ জন্য তদন্তে সময় কিছুটা বেশি লেগেছে। খুব শিগগির মামলার চার্জশিট দেওয়া হবে।’
অভয়নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ছয়রুদ্দীন আহম্মেদ বলেন, ‘মালোপাড়ায় ১০ জন পুলিশের একটি ক্যাম্প আছে। পরিস্থিতি আমাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। সুতরাং তাঁদের আতঙ্কিত হওয়ার কিছুই নেই।’