শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্যে সাফল্য দেখাচ্ছে কম মূল্যের প্রযুক্তি

প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় বাংলাদেশ ব্যয়সাশ্রয়ী প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দেশে এনেছে চিকিৎসার ভারী প্রযুক্তি।

বিশ্বজুড়ে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার অগ্রগতিতে ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখেছে প্রযুক্তি। বাংলাদেশ এর ব্যতিক্রম নয়। গড় আয়ু বৃদ্ধি, শিশু স্বাস্থ্য ও পুষ্টির উন্নতি, মাতৃমৃত্যু হ্রাস, কার্যকর জন্মনিয়ন্ত্রণ—দেশের স্বাস্থ্য খাতের এসব অগ্রগতিতে বড় ভূমিকা রেখেছে প্রযুক্তি। নতুন প্রযুক্তি আমদানি, গ্রহণ ও ব্যবহারে স্বাস্থ্য বিভাগ সব সময় খোলামনের পরিচয় দিয়েছে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় সরকার সব সময় কম মূল্যের, জুতসই ও সহজে ব্যবহারযোগ্য প্রযুক্তিকে গুরুত্ব দিয়েছে। অন্যদিকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবসার পাশাপাশি এটাও চেয়েছে যে রোগীদের বিদেশ যাওয়া বন্ধ করতে দেশে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে।

জনস্বাস্থ্যবিদ, বিশিষ্ট চিকিৎসক, হাসপাতাল মালিক, চিকিৎসাযন্ত্র ব্যবসায়ী ও স্বাস্থ্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মূলত তিনটি পথ ধরে বিদেশের প্রযুক্তি বাংলাদেশে এসেছে বা আসছে। প্রথমত চিকিৎসক ও সরকারি কর্মকর্তারা স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিষয়ে সম্মেলনে, সেমিনারে বা কর্মশালায় যোগ দিতে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে যান। ওই সব অনুষ্ঠানে তাঁরা নতুন নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত হন, কিছু ক্ষেত্রে তাঁরা হাতে–কলমে প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগও পান। অনেকেই তখন ওই প্রযুক্তি দেশে ব্যবহারের জন্য উৎসাহী হয়ে পড়েন। দ্বিতীয়ত, বিশ্বের অনেক বড় বড় চিকিৎসাযন্ত্র প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান তাদের উৎপাদিত চিকিৎসাযন্ত্র সারা দুনিয়ায় বিক্রি করার চেষ্টা করে। বাংলাদেশে অনেক প্রযুক্তি দেশে এসেছে এসব ব্যবসায়ীর হাত ধরে। তৃতীয়ত, বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নতুন নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে রোগীদের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করে। চিকিৎসায় নতুন বা সাম্প্রতিকতম ওষুধ বা প্রযুক্তি ব্যবহারের ব্যাপারে মানুষের সহজাত আগ্রহ লক্ষ করা যায়।

চিকিৎসার নানা শাখা–প্রশাখাকে কেন্দ্র করে নতুন নতুন গবেষণা হচ্ছে, উদ্ভাবন হচ্ছে নতুন নতুন প্রযুক্তির। পাশাপাশি রোগনির্ণয়ের ক্ষেত্রেও নতুন প্রযুক্তি আসছে বাজারে। জনস্বাস্থ্যের উন্নতিতে এমন সব প্রযুক্তির উদ্ভাবন হচ্ছে, যার সঙ্গে স্বাস্থ্য বিভাগ বা চিকিৎসকদের কোনো সম্পর্ক নেই। যেমন পানি বিশুদ্ধকরণ প্রযুক্তি বা ডেঙ্গু প্রতিরোধে মশার ওষুধ ছিটানোর যন্ত্র।

যেভাবেই প্রযুক্তি আসুক না কেন, তা দেশের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার অগ্রগতিতে ভূমিকা রেখেছে। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, স্বাস্থ্যপ্রযুক্তি হতে হবে চিকিৎসার দিক থেকে কার্যকর, কারিগরি দিক থেকে ঝুঁকিমুক্ত এবং ব্যয়সাশ্রয়ী। সংস্থাটি আরও বলছে, নতুন প্রযুক্তি সাধারণত পুরোনো প্রযুক্তির চেয়ে ব্যয়বহুল হয়। নতুন প্রযুক্তি সব সময় স্বাস্থ্যব্যয় বাড়িয়ে দেয়।

শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্যে প্রযুক্তি

বাংলাদেশে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় সব সময় ব্যয়সাশ্রয়ী প্রযুক্তি ব্যবহার হতে দেখা গেছে। প্রশিক্ষণ পেয়ে মাঠকর্মীরা সহজেই এসব প্রযুক্তির ব্যবহার শিখেছেন। ক্যাঙারু তার শাবককে যেভাবে বুকে জড়িয়ে রাখে, তেমনি অকালিক ও কম ওজন নিয়ে জন্মানো নবজাতকের চিকিৎসায় ‘ক্যাঙারু মাদার কেয়ার’ নামের প্রযুক্তি দেশে ব্যবহৃত হচ্ছে। জন্মের পর কিছু নবজাতক নিশ্বাস নিতে পারে না। তাদের শ্বাসপ্রশ্বাস শুরু করতে ব্যবহার করা হচ্ছে ‘আম্বু ব্যাগ অ্যান্ড পেঙ্গুইন সাকার’ নামের প্রযুক্তি। শিশু নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হলে শ্বাসপ্রশ্বাসে জটিলতা হয়। শিশুদের শ্বাসপ্রশ্বাসের হার পরিমাপের জন্য সারা দেশের প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এখন ‘এআরই টাইমার’ ব্যবহার করা হচ্ছে। অন্যদিকে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হলে রক্তে অক্সিজেন কমে যায়। শিশুদের নিউমোনিয়া কোন পর্যায়ে আছে, তা পরিমাপ করার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে ‘পালস–অক্সিমিটার’। আবার নিউমোনিয়ার মতো শ্বাসতন্ত্রের রোগে ভোগা শিশুদের ভেন্টিলেশন সহায়তার দরকার হয়। ভেন্টিলেশন সহায়তার জন্য ‘বাবল সিপাপ’ নামের যন্ত্র ব্যবহার করা হয়। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) বিজ্ঞানী ড. মো. যোবায়ের চিসতী খুব কম ব্যয়ে ও সহজে ব্যবহারের জন্য বাবল সিপাপ তৈরি করেছেন। প্রযুক্তিটি বাংলাদেশে ব্যবহারের জন্য মূল্যায়নের পর্যায়ে রয়েছে।

গর্ভধারণকালে, প্রসবকালে ও প্রসব–পরবর্তী জটিলতায় মাতৃমৃত্যু হয়। মাতৃমৃত্যু কমাতে গবেষণা ও প্রযুক্তি উদ্ভাবনের চেষ্টার ইতিহাস অনেক পুরোনো। নতুন প্রযুক্তি আসায় আগের প্রযুক্তি বিদায় নিয়েছে। এর মধ্যে একটি প্রযুক্তির নাম কনডম ক্যাথেটার। কনডম জন্মনিয়ন্ত্রণে কাজে লাগে। কিন্তু স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সায়েবা আক্তার প্রসব–পরবর্তী অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ বন্ধে কনডম নিয়ে একটি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন। অনেকে একে ‘সায়েবা মেথড’ বলে। প্রসবকালে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হচ্ছে কি না, তা পরিমাপের জন্য ‘রক্ত শোষণকারী ম্যাট’ তৈরি করেছিলেন আইসিডিডিআরবির একজন বিজ্ঞানী। প্রসব–পরিস্থিতির অগ্রগতি জানার জন্য হাসপাতালগুলোতে এখন ডিজিটাল পার্টোগ্রাফ ব্যবহৃত হচ্ছে। অন্যদিকে কিছু মায়ের প্রসবে সহায়তার জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে ‘বার্থ চেয়ার’। এসব ছাড়াও নবজাতক, শিশু ও মায়ের স্বাস্থ্য ও পুষ্টির উন্নতিতে আরও নানা ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে।

বড় ভূমিকা বেসরকারি খাতের

চিকিৎসার জন্য বিদেশ থেকে প্রযুক্তি বা যন্ত্রপাতি আনার ইতিহাস বেশ পুরোনো। ক্যানসার নিয়ে মানুষের মনে অনেক ভীতি কাজ করে। সেই ক্যানসার চিকিৎসায় টেলিথেরাপি যন্ত্র প্রথম দেশে আনে কুমুদিনী হাসপাতাল, ১৯৫৩ সালে। আর ৪ ফেব্রুয়ারি দেশের প্রধান প্রধান সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিয়ে ল্যাবএইড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলেছে, ক্যানসার চিকিৎসার সর্বাধুনিক সব ব্যবস্থা তাদের আছে। ইউনাইটেড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তারা ২০১১ সালে ক্যানসার নির্ণয়ের ‘পেট সিটি স্ক্যান’ প্রযুক্তি আনে। এর অর্থ হচ্ছে দেশে চিকিৎসাপ্রযুক্তি আনার ক্ষেত্রে বেসরকারি হাসপাতালগুলো অগ্রণী ভূমিকা রেখে চলেছে। ল্যাবএইড গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ এম শামীম প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশের সব মানুষকে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবার আওতায় আনা সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়। এখানে বড় ভূমিকা রাখছে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সব সময় চেষ্টা করে রোগনির্ণয় ও চিকিৎসায় সর্বসাম্প্রতিক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে। বেসরকারি হাসপাতাল যত সহজে একটি যন্ত্র দেশে আনতে পারে, সরকারি প্রতিষ্ঠান তা পারে না।’

এ প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করে দেশের হৃদ্‌রোগ চিকিৎসা অনেক দূর এগিয়েছে। ইউনাইটেড, স্কয়ার, এভারকেয়ার, ল্যাবএইড, হার্ট ফাউন্ডেশন, আসগর আলী—এসব হাসপাতালে হৃদ্‌রোগের চিকিৎসা হচ্ছে আধুনিক সব প্রযুক্তি ব্যবহার করে। এসব হাসপাতালে আধুনিক যন্ত্রপাতি ও প্রশিক্ষিত জনবল থাকার কারণে হৃদ্‌রোগ চিকিৎসায় মানুষ এখন বিদেশে কম যাচ্ছে।

একাধিক বড় হাসপাতালের মালিক বলেছেন, চিকিৎসা দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা আছে। ভালো চিকিৎসকেরা সব সময় বাজারের সর্বশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করতে চান। বিদেশ থেকে তাঁরা চিকিৎসা, এমনকি যন্ত্র পরিচালনার ওপর প্রশিক্ষণ নিয়ে আসেন। দেশে অর্জিত জ্ঞান ব্যবহার করতে চান। তাঁরা সেই সুযোগ সহজে পান বেসরকারি হাসপাতালে। দেশে যত বিশেষায়িত চিকিৎসার শাখা হচ্ছে, তত নতুন নতুন চিকিৎসা প্রযুক্তি দেশে আসছে।

একইভাবে রোগনির্ণয়ের ক্ষেত্রেও বেসরকারি রোগনির্ণয় কেন্দ্র নতুন নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। সারা দেশে শত শত রোগনির্ণয় কেন্দ্র গড়ে ওঠার অন্যতম কারণ সহজে রোগনির্ণয় প্রযুক্তি আনতে পারা। কিছুদিন আগেও রোগনির্ণয় পরীক্ষার জন্য নমুনা দেশের বাইরে পাঠানো হতো। এখন বেসরকারি উদ্যোক্তারা আধুনিক রোগনির্ণয় কেন্দ্র গড়ে তোলার জন্য বড় বিনিয়োগ করছেন।

শুধু রোগনির্ণয় বা চিকিৎসা নয়, সেবার মান উন্নত করতে, হাসপাতাল জীবাণুমুক্ত রাখতে বেসরকারি হাসপাতালগুলো নতুন নতুন প্রযুক্তি আনছে। এমনই একটি প্রযুক্তির ব্যবহার হচ্ছে চট্টগ্রামের এভারকেয়ার হাসপাতালে। নিউম্যাটিক টিউব সিস্টেম (পিটিএস) নামের এ প্রযুক্তির (টিউবের মধ্য দিয়ে) মাধ্যমে রক্ত, টিস্যু বা প্রস্রাবের নমুনা অথবা ওষুধ দ্রুত ও নিরাপদে হাসপাতালের নির্দিষ্ট স্থানে বা রোগীর শয্যার পাশে পৌঁছে যায়।