শিরায় মাদকগ্রহণকারীদের ২৭ শতাংশ এইচআইভি আক্রান্ত

সূত্র: আইইডিসিআর ও আইসিডিডিআরবি
সূত্র: আইইডিসিআর ও আইসিডিডিআরবি
>

পুরান ঢাকায় শিরায় মাদকগ্রণকারী ব্যক্তিদের চারজনের একজন এইচআইভি সংক্রমিত। জাতীয় কর্মসূচি ঠিকভাবে বাস্তবায়িত না হওয়ার অভিযোগ।

শিরায় মাদকগ্রহণকারী ব্যক্তিদের মধ্যে এইচআইভির প্রকোপ নাটকীয়ভাবে বেড়েছে। সর্বশেষ রক্ত পরীক্ষাভিত্তিক জরিপে দেখা গেছে, ঢাকার একটি অঞ্চলে শিরায় মাদকগ্রহণকারী ব্যক্তিদের ২৭ দশমিক ৩ শতাংশ এইচআইভিতে আক্রান্ত। এই জনগোষ্ঠীর চারজনে একজন এই রোগে আক্রান্ত। একই জরিপ বলছে, দেশে প্রথমবারের মতো নারী মাদকগ্রহণকারীদের মধ্যে এইচআইভি ঘনীভূত মহামারি আকারে দেখা দিয়েছে।

২০১৫ সালের জরিপে পুরান ঢাকার ৯ দশমিক ৯ শতাংশ শিরায় মাদকগ্রহণকারীর মধ্যে এইচআইভি সংক্রমণ শনাক্ত হয়। এক বছর পর ২০১৬ সালের জরিপে সেই হার বেড়ে হয় ২৭ দশমিক ৩ শতাংশ। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) ও আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) এই জরিপ করেছে। গত বছর নভেম্বরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জাতীয় এইডস/এসটিডি কর্মসূচি এই প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

এইচআইভির প্রকোপ বৃদ্ধিকে জাতীয় কর্মসূচির ব্যর্থতা বলছেন বিশেষজ্ঞরা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরাস বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মো. নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘জাতীয় এইডস/এসটিডি কর্মসূচির সংশ্লিষ্ট বাস্তবায়নকারী সংস্থা বা এনজিওদের ব্যর্থতা এর জন্য দায়ী।’ তিনি পরিস্থিতিকে আতঙ্কজনক আখ্যা দিয়ে বলেন, ‘শিরায় যারা মাদক নেয়, তারা এই সমাজেরই মানুষ। সমাজেই তাদের মেলামেশা। তাদের থেকে অন্য মানুষে এই সংক্রমণের ঝুঁকি বহুগুণে বেড়ে গেল।’

ওই জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এইচআইভি ঝুঁকি কমানোর সরকারি কর্মসূচির মূল্যায়ন হওয়া দরকার। এইচআইভি আরও ছড়িয়ে পড়ার আগে বাংলাদেশকে জরুরি ভিত্তিতে কাজ করতে হবে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে জাতীয় এইডস/এসডিটি কর্মসূচির ব্যবস্থাপক মো. বেলাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, উচ্চহারে এইচআইভি সংক্রমণের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে জাতীয় কর্মসূচিতে কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। এর মধ্যে আছে ঢাকা শহরের পাঁচটি কেন্দ্রে সমন্বিত সেবা চালু করা হয়েছে। সুই-সিরিঞ্জনির্ভরতা কমানোর জন্য মুখে সেবনযোগ্য বিকল্প থেরাপি (ওএসটি) দেওয়া হচ্ছে। মাঠপর্যায়ের নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়কে এইচআইভি নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচিতে যুক্ত করা হয়েছে।

সরকারি কর্মকর্তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশে এইচআইভি সংক্রমিত ব্যক্তির অনুমিত সংখ্যা ১১ হাজার ৭০০। শিরায় মাদকগ্রহণকারীর সংখ্যা ২৬ হাজার ১৮৬ থেকে ৩৩ হাজার ৬৭।

জরিপ ফলাফল: ঢাকার এ-১ (পুরান ঢাকা) এলাকার ৭২১ জন পুরুষ, ঢাকা এ-২ এলাকার ২৯১ জন পুরুষ, নারী ১৩৯ জন এবং হিলি এলাকার ১১৭ জন শিরায় মাদকগ্রহণকারীর রক্তের নমুনা পরীক্ষা করেন আইইডিসিআর ও আইসিডিডিআরবির গবেষকেরা। গবেষকেরা ঢাকা এ-১ এলাকার ২৭ দশমিক ৩ শতাংশ পুরুষের রক্তে এইচআইভির সংক্রমণ শনাক্ত করেন।

গবেষকেরা বলছেন, মাদকগ্রহণকারীরা শরীরে মাদক নেওয়ার সময় নিজেদের মধ্যে সিরিঞ্জ ও সুই ভাগাভাগি করেন। এ কারণে একজন এইচআইভি–আক্রান্ত ব্যক্তির শরীর থেকে এই ভাইরাস সহজে অন্যের শরীরে সংক্রমিত হয়।

ঢাকা এ-১ অঞ্চলে ২০০৪-০৫ সালে শিরায় মাদকগ্রহণকারী ব্যক্তিদের ৭ দশমিক ১ শতাংশ সংক্রমিত ছিল। ২০১১ সালে ছিল ৭ দশমিক ৩ শতাংশ। ২০১৫ সালে ছিল ৯ দশমিক ৯ শতাংশ। অতীতের জরিপগুলো থেকে দেখা যায়, সংক্রমণের হার ধীরগতিতে বেড়েছে। কিন্তু ২০১৬ সালে হঠাৎ করে তা বেড়ে ২৭ দশমিক ৩ হয়েছে; অর্থাৎ এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর চারজনের একজন এইচআইভি আক্রান্ত।

২৭.৩ শতাংশের বা ১২৭ জন শিরায় মাদকগ্রহণকারীর বিস্তারিত তথ্য প্রতিবেদনে দেওয়া হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, এদের ৫৪ দশমিক ৭ শতাংশ রাস্তায় থাকে, এদের ৩০ দশমিক ৪ শতাংশ বিবাহিত, গত এক বছরে এরা গড়ে ৩ দশমিক ৭ জনের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক করেছে। এদের ৬২ দশমিক ২ শতাংশ তথ্য সংগ্রহের আগের সপ্তাহে অন্যের কাছ থেকে সিরিঞ্জ ও সুই ধার নিয়েছিল।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, কোনো বিশেষ জনগোষ্ঠীর ৫ শতাংশ যদি কোনো রোগে আক্রান্ত হয়, তাহলে পরিস্থিতিকে ঘনীভূত মহামারি বা কনসেন্ট্রেটেড এপিডেমিক বলে। ঢাকা এ-১ অঞ্চলে এই পরিস্থিতি বেশ কয়েক বছর ধরেই চলছে। অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, বিপদ হচ্ছে, এই বিশেষ জনগোষ্ঠী থেকে তা সাধারণ মানুষের মধ্যে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি থাকে। ২৭ দশমিক ৩ শতাংশ আক্রান্ত হওয়ার অর্থ এই ঝুঁকি আরও বহুগুণ বেড়ে গেল।

নারীদের মধ্যে এই সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে জরিপ প্রতিবেদনে। ২০০৪–০৫ সালে শিরায় মাদকগ্রহণকারী নারীদের মধ্যে এইচআইভির কোনো সংক্রমণ পাওয়া যায়নি। ২০১১ সালে ১.২ শতাংশ নারীর মধ্যে সংক্রমণ ধরা পড়ে। কিন্তু ২০১৬ সালের জরিপে ৫ শতাংশের মধ্যে সংক্রমণ পাওয়া গেছে।

কেন এমন হলো: শিরায় মাদকগ্রহণকারী ব্যক্তিরা যেন সিরিঞ্জ ও সুই নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি না করে তার জন্য সরকারি কর্মসূচি থেকে তাদের সিরিঞ্জ ও সুই সরবরাহ করা হতো। অধ্যাপক নজরুল ইসলাম ও নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আইসিডিডিআরবির একজন গবেষক অভিযোগ করেছেন, সিরিঞ্জ ও সুই সরবরাহ কর্মসূচি ঠিকমতো বাস্তবায়িত না হওয়ায় এই পরিস্থিতি হয়েছে। এই কর্মসূচি ঠিকমতো বাস্তবায়িত হচ্ছে না—এমন কথা জরিপ প্রতিবেদনেও আছে।

আজ বিশ্ব এইডস দিবস
আজ বিশ্ব এইডস দিবস। বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশেও দিনটি সরকারিভাবে পালিত হবে। দিনটির এ বছরের প্রতিপাদ্য, ‘এইচআইভি পরীক্ষা করুন, নিজেকে জানুন’।

দিনটি পালন উপলক্ষে সকাল সাড়ে নয়টায় জাতীয় সংসদের সামনে র‍্যালি বের করবে জাতীয় এইডস/এসটিডি কর্মসূচি। র‍্যালির পর খামরাবাড়ির কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে আলোচনাসভা হবে। সভায় দেশের এইডস পরিস্থিতির নতুন তথ্য উপস্থাপন করা হবে।

দিনটি উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও ইউনিসেফ যৌথভাবে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে র‍্যালি বের করবে আজ সকাল সাড়ে ৮টায়।