চীনে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের পর সেখান থেকে অভিজ্ঞতা নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কিছু কৌশলের কথা বলেছে, যার মাধ্যমে সংক্রমণটি রোধ করা যায়। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। বাংলাদেশও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ অনুযায়ী সংক্রমণ দমানোর জন্য যা যা করার দরকার, তা করেছে। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণে ধীর গতি ও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সমন্বয়হীনতা ছিল। করোনা ব্যবস্থাপনায় প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও গ্রহণ করেনি। এমনকি করোনা পরীক্ষায় প্রয়োজনীয় সংখ্যক পিসিআর মেশিন ও টেস্ট কিটেরও সংকট ছিল।
সরকার সঠিক সময় সঠিক সিদ্ধান্ত যেমন নিতে পারেনি, তেমনি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সমন্বিতভাবে যে কাজগুলো করা উচিত, সেটিও সেভাবে করা হয়নি। এর পরিণতিতে যখন লকডাউন (অবরুদ্ধ) করা উচিত ছিল, তখন করা হয়নি। এ ছাড়া লকডাউন ও সাধারণ ছুটি নিয়েও একটি সংশয় ছিল। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ আইনেরও যথাযথ বাস্তবায়ন হয়নি।
সমন্বয়হীনতার কারণে সংক্রমণের হার বেড়েছে। আমরা দেশে সংক্রমণের যে হার দেখছি, সেটিও প্রকৃত হার না। এটা শুধু আমরা যাদের পরীক্ষা করছি, তাদের মধ্যে সংক্রমণের হার। সংক্রমিত প্রকৃত মানুষের সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি হবে।
যাই হোক আমরা মানুষকে ঘরে আবদ্ধ রাখতে চেষ্টা করেছি, গণপরিবহন বন্ধ করেছি। পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধি মানার জন্য মানুষকে জানানো হয়েছে, কিন্তু জানানোটাই যথেষ্ট নয়, এটার জন্য জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা দরকার এবং সম্পৃক্ত করা দরকার। এ ক্ষেত্রে আমরা ব্যর্থ হয়েছি।
জনগণ যথাযথভাবে উদ্বুদ্ধ ও সম্পৃক্ত হয়নি। পাশাপাশি যারা স্বাস্থ্যবিধি মানেনি তাদের মানতে বাধ্য করার জন্য সরকারের যা করা উচিত ছিল সেটা করতে পারেনি। এসবের ফলে দৈনিক সংক্রমণের হার এখন বাড়ছেই।
এর মধ্যেই সরকারি পদক্ষেপে যান চলাচল শুরু হয়েছে, অফিস-আদালত খুলে দেওয়া হচ্ছে। এর আগেই পোশাক কারখানা ও পাটকল খুলে দেওয়া হয়েছে। পৃথিবীর যেকোনো দেশেই লকডাউন তুলে দেওয়ার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ৬টি পরামর্শ আছে। যার প্রথমটি হচ্ছে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আসতে হবে। আমরা প্রথম শর্তটিই মানিনি। এতে সংক্রমণের হার আরও বাড়বে। তার পরিণতিতে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা ও স্বাস্থ্যসেবার সক্ষমতার ওপর চাপ বাড়বে। এখনই অনেকেই হাসপাতালে শয্যা পাচ্ছে না, আইসিইউ ফাঁকা পাওয়া যাচ্ছে না, সংক্রমণ বাড়লে এই সংকট আরও তীব্র হবে। এতে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর হার বেড়ে যাবে।
পুরো দেশের সব একবারে খুলে না দিয়ে সংক্রমণের হার অনুযায়ী দেশের জেলাগুলোকে সবুজ (জেলায় রোগী ১০০–এর কম) ও হলুদ (রোগী ১০০-৩০০) জেলা হিসেবে চিহ্নিত করা যেত। সবুজ জেলায় অর্থনৈতিকসহ সব ধরনের কর্মকাণ্ড চলবে। হলুদ জেলার যেসব উপজেলায় রোগী ১০০–এর কম, সেগুলো সবুজ জেলার মতো বিবেচিত হবে। আর যেসব জেলায় রোগী ৩০০–এর ওপর, সেগুলো লাল হিসেবে চিহ্নিত হবে এবং সেখানে কঠোর লকডাউন আরোপ করতে হবে। পাশাপাশি সবুজ জেলা বা যেসব উপজেলায় রোগী কম সেগুলোতে সব রোগী চিহ্নিত করে আইসোলেটেড (বিচ্ছিন্ন) করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। এসব রোগীর সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনের (সঙ্গনিরোধ) ব্যবস্থা করতে হবে। এভাবে অবস্থার উন্নতি হলে ধীরে ধীরে সব খুলে দিতে হবে।
সে অনুযায়ী ঢাকা শহর এখন কঠোর লকডাউনের আওতায় থাকা উচিত। এটি না করে লকডাউন শিথিল করে ১৫ দিন পর্যবেক্ষণ করে দেখার কোনো সুযোগ নেই।
তারপরও সরকার যখন সব খুলে দিচ্ছে তখন সংক্রমণ বাড়বে, জনগণ স্বাস্থ্য ও জীবনের ঝুঁকিতে পড়বে। এখন জনগণকে ব্যক্তি পর্যায়ে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। ব্যক্তি পর্যায়ে স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য সব স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। এর মধ্যে অবশ্যপালনীয় যেসব বিষয় আছে সেগুলো হলো: সামাজিক দূরত্ব মেনে চলতে হবে, ফেস শিল্ড ও মাস্ক পরতে হবে, হাত ধোয়া বা স্যানিটাইজের অভ্যাস করতে হবে, যতটা সম্ভব কোনো জায়গায় হাত রাখা যাবে না। আর কোনো অবস্থাতেই হাত না ধুয়ে বা স্যানিটাইজ না করে নাকে–মুখে হাত দেওয়া যাবে না। এগুলো কঠোরভাবে মানতে হবে। আর কারও মধ্যে উপসর্গ দেখা দিলে নিজেকে ঘরে বিচ্ছিন্ন রেখে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
মনে রাখতে হবে করোনাভাইরাস নিজে নিজে হেঁটে আসে না, কেউ তাকে বহন করে নিয়ে আসে। এমন অবস্থায় বাজার বা দোকান থেকে আনা দ্রব্যাদির মোড়ক বা কাঁচা শাকসবজি বা ফলমূল এমনকি গায়ের কাপড়েও করোনা থাকতে পারে। তাই এসব ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। বাইরে থেকে ঘরে আসার পর জামাকাপড় ধুয়ে নিতে হবে। শাকসবজি ও মাছ-মাংস ভালো করে সেদ্ধ করে খেতে হবে।
মোজাহেরুল হক: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের সাবেক উপদেষ্টা