২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলনের ঘোষণা

সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে শিক্ষার্থীদের অনশন চলছে। অনশনে অসুস্থ হয়ে পড়া এক শিক্ষার্থীকে হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে। শুক্রবার সকালে
ছবি: আনিস মাহমুদ

সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শাবিপ্রবি) আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের একাংশের শুরু করা আমরণ অনশনের তৃতীয় দিনেও উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগের দাবি বিষয়ে কোনো যৌক্তিক সমাধান আসেনি। যদিও প্রচণ্ড ঠান্ডায় একে একে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন অনশনরত শিক্ষার্থীরা। এ অবস্থায় ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা শুক্রবার ঘোষণা দিয়েছেন, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত ঘরে ফিরবেন না তাঁরা।

এদিকে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরীকে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের কাছে পাঠিয়েছেন। শুক্রবার বেলা একটা থেকে বেলা তিনটা পর্যন্ত তিনি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তিন দফা ও উপাচার্যের সঙ্গে এক দফা বৈঠক করেন।

আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা গত মঙ্গলবার রাতে উপাচার্য ফরিদ উদ্দিনকে গত বুধবার দুপুর ১২টার মধ্যে পদত্যাগের আহ্বান জানিয়েছিলেন। পদত্যাগ না করায় ওই দিন দুপুরের পর তাঁর বাসভবনের সামনে অনশন শুরু করেন ২৪ জন ছাত্রছাত্রী। শুক্রবার সন্ধ্যায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত অনশন চলছিল। তবে অসুস্থ হয়ে পড়ায় ১৪ জনকে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এর বাইরে অনশনকারী এক ছাত্রের বাবা হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হওয়ায় গত বৃহস্পতিবার ভোরে বাড়িতে গেছেন তিনি।

আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা জানান, হাসপাতালে চিকিৎসাধীন শিক্ষার্থীদের কেউ অনশন ভাঙেননি। তাঁরা আবার কর্মসূচিতে যোগ দিতে চান। সব মিলিয়ে ৯ জন এখনো অনশন করছেন। তবে তাঁদের শারীরিক অবস্থাও ক্রমে অবনতির দিকে যাচ্ছে। তাঁরা জ্বর ও নিম্ন রক্তচাপে ভুগছেন। সবার শরীরে স্যালাইন পুশ করেছেন চিকিৎসকেরা। তবে অনশন চালিয়ে যাবেন তাঁরা।

এরই মধ্যে শুক্রবার বেলা তিনটার দিকে শিক্ষামন্ত্রী মুঠোফোনে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি সাদিয়া আফরিনের সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় দীপু মনি শিক্ষার্থীদের কয়েকজন প্রতিনিধিকে ঢাকায় আসার আমন্ত্রণ জানিয়ে তাঁর সঙ্গে আলোচনা করে দাবির বিষয়টি সুরাহা করার অনুরোধ জানান।

সাদিয়াসহ আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী কয়েকজন সন্ধ্যায় সাংবাদিকদের জানান, শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিদল তৈরি করা হয়েছে। শিক্ষামন্ত্রীকে তাঁরা এটাই বলতে চান, উপাচার্যের পদত্যাগ ছাড়া কর্মসূচি কোনো অবস্থাতেই বন্ধ করা হবে না। তবে তাঁরা আন্দোলন ফেলে ঢাকায় যেতেও ইচ্ছুক নন। তাঁরা ভার্চ্যুয়ালি শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে আগ্রহী। এর বিকল্প হিসেবে শিক্ষামন্ত্রীকে সিলেটে আসার জন্য তাঁরা অনুরোধ করছেন।

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে শফিউল আলম চৌধুরী সন্ধ্যা সোয়া ছয়টায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘শিক্ষামন্ত্রী তাঁদের (শিক্ষার্থীদের) সঙ্গে কথা বলেছেন। তবে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিরা ভার্চ্যুয়ালি কথা বলতে চান। এর পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষামন্ত্রী আবার আমাকে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেছেন। তিনি তাঁদের বলতে বলেছেন, “যে অচলাবস্থা হয়েছে, সেটা ভার্চ্যুয়ালি আলোচনা করে সমাধান সম্ভব নয়।’’ তাই শিক্ষার্থীদের ঢাকায় আসার জন্য আবার অনুরোধ করতে বলেছেন। যদি তাঁরা ঢাকায় যান, তাহলে বিষয়টা তিনি দ্রুততম সময়ের মধ্যে সমাধানের চেষ্টা করবেন।’

এর আগে গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ১২টা থেকে ১টা ১০ মিনিট পর্যন্ত উপাচার্যের পদত্যাগ চেয়ে শত শত শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মশাল মিছিল করেন।

আলোচনায় বসতে চান শিক্ষামন্ত্রী

বিশেষ প্রতিবেদক, ঢাকা জানান, আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনায় বসার আগ্রহ প্রকাশ করে শিক্ষামন্ত্রী জানিয়েছেন, আন্দোলনকারীদের প্রতিনিধিদল যত দ্রুত ঢাকায় আসবে, তত তাড়াতাড়ি আলোচনায় বসতে চান তিনি। বিকেলে রাজধানীর মতিঝিলে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডে এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে শিক্ষামন্ত্রী এ কথা বলেন।

দীপু মনি বলেন, ‘আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব বিষয়ে সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে চাই না। তবে সেখানে আমাদের শিক্ষার্থীরা অনশন করছেন, কেউ কেউ কিছুটা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে গেছেন। আমি এখন ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলেছি, কারও কোনো আশঙ্কাজনক কিছু নেই।’ তিনি বলেন, ‘তাঁরা (শিক্ষার্থী) একটি প্রতিনিধিদল যদি পাঠাতে পারেন, যত দ্রুত সম্ভব তাঁরা এলে আলাপ-আলোচনা করতে চাই। শিক্ষক সমিতির নেতাদের সঙ্গেও একটু আলাপ করতে চাই।’

‘ভিসি পদ ফাঁকা আছে’

শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ভবনের দেয়ালে একই রকমের অর্ধশতাধিক দেয়ালচিত্র মারা হয়েছে। সেখানে উপাচার্যের মুখাবয়বের নিচেই লেখা ‘স্বৈরাচার্য’। আরও লেখা আছে ‘নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি: ভিসি পদ ফাঁকা আছে’। গত বৃহস্পতিবার থেকে এমন দেয়ালচিত্র দেখা যাচ্ছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আলমগীর কবির প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে ক্যাম্পাসে অনেক বহিরাগত আছেন। ওই বিজ্ঞপ্তি কারা দিয়েছেন, সেটি বলতে পারছেন না তিনি।

তবে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারীদের একজন সাদিয়া আফরিন বলেন, ‘উপাচার্যকে ক্যাম্পাসে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছে। এরপর প্রতিবাদের অংশ হিসেবে ‘নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি’ দিয়ে ‘চিকা’ মারা হয়েছে।

উপাচার্য পদত্যাগ করবেন, আশা আনু মুহাম্মদের

প্রতিবেদক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জানান, উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদের ‘সম্মানবোধ’ জাগ্রত হলে তিনি পদত্যাগ করবেন বলে আশা প্রকাশ করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। ফরিদ উদ্দিন আহমেদের উদ্দেশে তিনি বলেছেন, ‘নিজের সম্মানবোধ থাকলে অন্যদের সম্মান করতে শিখুন। পদত্যাগ করলে আপনার সম্মানটা থাকবে।’

বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে আয়োজিত এক সংহতি সমাবেশে অংশ নিয়ে আনু মুহাম্মদ এ কথা বলেন। উপাচার্যকে অপসারণ, শিক্ষার্থীদের ওপর হামলাকারী পুলিশ ও ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের বিচার করা, শিক্ষার্থীদের নামে করা মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে এবং শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনের সমর্থনে বামপন্থী ছাত্রসংগঠনগুলো এ সমাবেশের আয়োজন করে।

শাবি উপাচার্যকে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে বললেন জাবির ছাত্রীরা

প্রতিনিধি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় জানান, উপাচার্য ফরিদ উদ্দিনকে নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ও বর্তমান পাঁচ শতাধিক ছাত্রী। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্যের জন্য তাঁর পদত্যাগও দাবি করেছেন তাঁরা। শুক্রবার এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের নবম ব্যাচ থেকে ৪৯তম ব্যাচ পর্যন্ত ৫০৪ জন ছাত্রীর সই করা বিবৃতিতে এ আহ্বান জানানো হয়।

শিক্ষার্থীদের পাশে অন্যান্য সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক সংগঠন

শিক্ষার্থীদের দাবির প্রতি সংহতি জানিয়ে সংস্কৃতিকর্মীরাও মাঠে নেমেছেন। সংহতি জানিয়েছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনও। শুক্রবার বিকেলে সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে ‘সিলেটের সংস্কৃতিকর্মী’ ব্যানারে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় অংশ নেন সংস্কৃতিকর্মীরা।

হাসপাতালে চিকিৎসাধীন শিক্ষার্থীদের সকালে দেখতে গিয়েছিলেন সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মাসুক উদ্দিন আহমদ ও সাধারণ সম্পাদক মো. জাকির হোসেন। এ সময় তাঁরা শিক্ষার্থীদের চিকিৎসার খোঁজখবর নেন। ‘জাগো সিলেট আন্দোলন’ নামের একটি সংগঠনও নগরের মেন্দিবাগ এলাকায় উপাচার্যের পদত্যাগ চেয়ে সভা করেছে।

একই দিন প্রগতিশীল ছাত্র জোটের কেন্দ্রীয় নেতারা সিলেটে এসে চিকিৎসাধীন শিক্ষার্থীদের পাশে গিয়ে সংহতি প্রকাশ করেছেন। বাম গণতান্ত্রিক জোট সিলেট শাখার নেতারাও চিকিৎসাধীন শিক্ষার্থীদের দেখতে হাসপাতালে যান।

শাবিপ্রবি ছাত্রলীগের সাবেক নেতারা সকালে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করে আলোচনার মধ্য দিয়ে সমস্যা সমাধানে আহ্বান জানিয়েছেন। পরে উপাচার্যের সঙ্গেও দেখা করে আলোচনার মাধ্যমে অচলাবস্থা নিরসনের অনুরোধ জানান তাঁরা। বিশ্ববিদ্যালয়টির শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মো. মকদ্দুছ আলী, সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাসুম বিল্লাহ, সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক প্রদীপ চন্দ্র দাস প্রমুখ এ সময় উপস্থিত ছিলেন।

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সূত্রপাত হয় ১৩ জানুয়ারি। ওই দিন রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের প্রাধ্যক্ষ জাফরিন আহমেদের বিরুদ্ধে অসদাচরণের অভিযোগ তুলে তাঁর পদত্যাগসহ তিন দফা দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন হলের কয়েক শ ছাত্রী। ১৫ জানুয়ারি সন্ধ্যায় ছাত্রলীগ ছাত্রীদের আন্দোলনে হামলা চালায়। পরদিন বিকেলে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি ভবনে উপাচার্যকে অবরুদ্ধ করেন। তখন শিক্ষার্থীদের লাঠিপেটা ও তাঁদের লক্ষ্য করে শটগানের গুলি ও সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ে পুলিশ। ওই দিন রাতে বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ও শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার নির্দেশ দেয় কর্তৃপক্ষ। শিক্ষার্থীরা তা উপেক্ষা করে উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। ওই হামলার প্রতিবাদে ঢাকা, রাজশাহী, জাহাঙ্গীরনগর, খুলনা, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ করছেন শিক্ষার্থী এবং বিভিন্ন নাগরিক ও রাজনৈতিক সংগঠন।