শাসন ও উন্নয়নের সম্পর্ক নিয়ে খুবই গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করা জরুরি : নুরুল ইসলাম

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর সমাপ্তিলগ্নে তিনটি প্রশ্ন নিয়ে প্রথম আলো মুখোমুখি হয়েছিল দেশের তিনজন বরেণ্য জ্যেষ্ঠ নাগরিকের। এঁরা প্রত্যেকে মুক্তিযুদ্ধকালে কিংবা এর আগের উত্তাল রাজনৈতিক উত্থান–পতনের সময়ে নানাভাবে জড়িত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের হিসাব–নিকাশ নিয়ে একই প্রশ্ন করা হয়েছিল এই তিনজনকে। তাঁদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ

নুরুল ইসলাম, জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ, বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের সহ–সভাপতি

প্রশ্ন :

জাতি নানা রাজনৈতিক উত্থান–পতনের মধ্য দিয়ে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে এসে পৌঁছেছিল। আপনি নিজেও সেই ঘটনাক্রমের অংশ ছিলেন। একাত্তরে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কল্পনাটা আপনার কাছে কেমন ছিল?

স্বাধীনতা চাওয়ার পেছনে আমাদের একটাই উদ্দীপনা ছিল। আমরা চেয়েছিলাম একটা গণতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক দেশ।

প্রশ্ন :

গত ৫০ বছরে বাংলাদেশ যে জায়গায় এসে পৌঁছেছে, তার সঙ্গে আপনার কল্পনার রাষ্ট্রের কোথায় মিল, কোথায় অমিল?

স্বাধীনতার পর আমাদের মূল গুরুত্ব দিতে হয়েছিল পুনর্গঠন আর পুনর্বাসনের দিকে। প্রবৃদ্ধির পূর্বশর্ত হিসেবে অর্থনীতির জমিন ফিরিয়ে আনার ব্যাপার ছিল। এর জন্য বিশদ পরিকল্পনা করতে হয়েছিল। আমাদের ভাবতে হয়েছিল খাদ্যসমস্যা নিয়ে। জোর দিতে হয় খাদ্য উৎপাদন বাড়ানো আর সমাজের দরিদ্র ও ঝুঁকিগ্রস্তদের কল্যাণে সুষম বণ্টনের দিকে। আমরা অত্যন্ত সফল একটি জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ নীতি গ্রহণ করতে পেরেছিলাম। কৃষিখাতে আধুনিক ইনপুট প্রয়োগকে খুব গুরুত্ব দেওয়া হয়। বাড়তে থাকা উৎপাদন বাজারজাত করার জন্য সড়ক অবকাঠামো উন্নয়ন করা হয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো অ-কৃষি খাতের অর্জন। এক্ষেত্রে ব্র্যাক বা গ্রামীণ ব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা আছে। শিক্ষার প্রসার, বিশেষ করে অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা বিস্তারে তারা ভালো ভূমিকা রেখেছে। বাজার প্রসারের সম্ভাবনার যে ইঙ্গিত এসেছে তাতে কৃষকেরা খুব ইতিবাচক সাড়া দিয়েছেন। বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির জন্য দুটো জিনিস এ পর্যন্ত ভূমিকা রেখে আসছে—তার একটি হলো বৈদেশিক আয়, আরেকটি রপ্তানি। যদিও এই রপ্তানি এখন পর্যন্ত মূলত একটি পণ্যে নির্ভর করে আছে। এই খাতে শ্রম কম দক্ষ, নারীদের শ্রমই সিংহভাগ। একটি উন্নয়নশীল দেশে এটি একটি লক্ষণীয় একটি ঘটনা। এসব আয় এসেছে দেশের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর হাত দিয়ে। এর ফলে গ্রামীণ উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়েছে। প্রথম প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছে ব্যয় করার ক্ষমতায়। প্রভাব পড়েছে অবকাঠামো নির্মাণে ও অকৃষিজ কার্যক্রম, অর্থাৎ ব্যবসা ও ক্ষুদ্র শিল্পে। এর জন্য দরকার ছিল বাজারের অভিগম্যতা আর গ্রামীণ অবকাঠামো। একে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির অগ্রগতির এক নতুন অবস্থা বলা যায়। অ-কৃষিখাত কৃষিখাতের জন্য ইনপুট ও বাজার জোগান দিয়েছে। আমরা বলি যে শিক্ষা ও স্বাস্থে আমাদের উল্লেখযোগ্য অর্জন আছে। তবে এই অর্জন সবার জন্য সমানভাবে কাজে লাগানোর অবকাশ রয়ে গেছে।

মুক্তিযুদ্ধাদের অমিত সাহস স্বাধীনতার স্বপ্নকে বাস্তব করে তুলেছিল, ১৯৭১
ছবি: অমিয় তরফদার

প্রশ্ন :

সুবর্ণজয়ন্তীর পরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নিরিখে ভবিষ্যতে কোনদিকে আমাদের সবচেয়ে বেশি নজর দিতে হবে বলে আপনি মনে করেন?

ইনপুট ও আউটপুটের হারে উৎপাদনের ক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে আছি। অংশত এর কারণ হচ্ছে, আমরা আমাদের কাজে লাগানো শ্রমকে যথেষ্ট প্রশিক্ষিত করিনি। আমাদের বিশেষ লক্ষ্য রাখা উচিত আয়ের অতি-বৈষম্যের প্রতি। আয়ের অতি-বৈষম্য পুঁজি বিদেশে স্থানান্তরের কারণ হয়ে উঠতে পারে। সেক্ষেত্রে দেশে বিনিয়োগের যথেষ্ট ইতিবাচক পরিবেশ ও প্রণোদনা আছে কি না তা নিশ্চিত করতে হবে। বৈষম্য মূলত একটি রাজনৈতিক সমস্যা। আমার মতে, এর ফলে বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হচ্ছে। অর্থনৈতিক নীতিমালা তৈরি করার জন্য স্বাধীন, নিখুঁত ও পক্ষপাতহীন উপাত্তের প্রয়োজন। সঙ্গে চাই অরাজনৈতিক বিশ্লেষণ। তা না হলে অর্থনৈতিক নীতিমালা তৈরি করা অসম্ভব। তা নিশ্চিত করতে পারলে রাজনীতিবিদরা আজ পার পেয়ে গেলেও আগামী দিনে তাদের ব্যর্থতার জন্য দোষের ভাগি হবেন। আর গবেষকদের উচিত রাজনীতিবিদেরা বুঝতে পারেন এমন ভাষায় তাদের গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করা। রাজনীতিবিদদের ভাষা গবেষকদের বুঝতে–শিখতে হবে। যে পরিবেশে রাজনীতিবিদেরা কাজ করে থাকেন, গবেষকদের সেই পরিবেশের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। দারিদ্র বিমোচন আর বৈষম্যের মধ্যে কি কোনো সম্পর্ক আছে, কোনটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ—এর একটি ফয়সালা হওয়া উচিত। বৈষম্যের চরিত্র আর বিস্তৃতি নিয়ে বাংলাদেশের গবেষকদের আলোচনা ও গবেষণা করা উচিত। সেই সঙ্গে আমি বলব, শাসন ও উন্নয়নের মধ্যেকার সম্পর্ক নিয়ে যেন খুবই গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করা হয়।