শত মৃত্যুতেও দায় নেই নূর মোহাম্মদের

বগুড়ায় করতোয়া হোমিও হল অ্যান্ড ল্যাবরেটরিতে অভিযান চালিয়ে কনটেইনারভর্তি রেক্টিফায়েড স্পিরিট জব্দ করে পুলিশ। ৪ জানুয়ারি বগুড়া শহরের নাটাইপাড়া এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

১৯৯৮ সালে গাইবান্ধায় পয়লা বৈশাখের প্রাক্কালে বিষাক্ত মদ পান করে ৭১ জনের প্রাণহানি হয়। ওই ঘটনা তদন্তের পর পুলিশ জানতে পারে, গাইবান্ধার রিপা হোমিও হলের মালিক রবীন্দ্রনাথ সরকারের কাছ থেকে স্পিরিট কিনে পান করেছিলেন হতাহত ব্যক্তিরা। পুলিশি তদন্তে রবীন্দ্রনাথ সরকারকে ভেজাল মদ জোগান দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল বগুড়ার পারুল হোমিও ল্যাবরেটরির তৎকালীন মালিক নূর মোহাম্মদের বিরুদ্ধে। তবে শেষ পর্যন্ত তাঁর কিছু হয়নি। এরপর ২০০০ সালেও বগুড়ায় বিষাক্ত মদ খেয়ে ২২ জনের মৃত্যু হয়। ওই ঘটনায় পারুল হোমিও হলের তৎকালীন মালিক নূর মোহাম্মদের যুক্ততা ছিল। তদন্তে তাঁর সম্পৃক্ততাও পেয়েছিল পুলিশ। সেবারও তাঁর কিছুই হয়নি।

সর্বশেষ চলতি সপ্তাহে বগুড়ায় মদ্যপানে ১৮ জনের মৃত্যুর পর আবারও নূর মোহাম্মদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। শত মৃত্যুতেও নূর মোহাম্মদের কিছু হবে কি না, তা নিয়ে সন্দিহান এলাকার মানুষ।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্র জানায়, গাইবান্ধা ট্র্যাজেডিতে নূর মোহাম্মদের নাম এসেছিল। মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হয় বিএনপির আমলে, ২০০২ সালে। ওই সময় সবকিছু সামাল দিয়ে ফেলেন নূর মোহাম্মদ। মামলার তদন্তকারী সিআইডির কর্মকর্তা আবদুর রহমান শেষ পর্যন্ত শুধু রিপা হোমিও হলের রবীন্দ্রনাথ সরকার এবং সহযোগী মৃণাল কান্তির বিরুদ্ধে ২০০২ সালের ২৮ জুলাই আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। পরে আদালত রবীন্দ্রনাথ সরকারকে ১০ বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তার আগেই দেশত্যাগ করে পালিয়ে যান।

এবার আবার প্রাণহানির পর আলোচনায় বিতর্কিত হোমিও ব্যবসায়ী নূর মোহাম্মদ এবং তাঁর দুই ভাই নূর নবী এবং নূরে আলম। এর মধ্যে নূর মোহাম্মদ ইউনিসন ফার্মা (ইউনানি), নূর নবী ‘পারুল’ হোমিও ল্যাবরেটরি এবং নূর আলম পুনম হোমিও ল্যাবরেটরি চালাচ্ছেন। সম্প্রতি প্রাণহানির ঘটনায় তিন ভাইকেই আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে পারুল হোমিওর নূর নবীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। বাকি দুজন লাপাত্তা।

স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, দেশের রেকটিফায়েড স্পিরিটের ব্যবসায় তিন দশক ধরেই প্রভাবশালী নূর মোহাম্মদ (৬৫)। তাঁর পারুল হোমিও হল একসময় বগুড়া তথা উত্তরবঙ্গে স্পিরিট ও হোমিও সামগ্রীর একচ্ছত্র জোগানদাতা ছিল। একসময় পঞ্চগড়ের মার্শাল ডিস্টিলারিজ থেকে উৎপাদিত রেকটিফায়েড স্পিরিট ব্যবসার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ ছিল নূর মোহাম্মদের হাতে। গত বিএনপির আমলে তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ হিসেবে জেলায় পরিচিত ছিলেন। এখন ইউনিসন ফার্মা (ইউনানি) নামের একটি ওষুধ প্রস্তুতকারক কোম্পানি দিয়েছেন। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা মনে করেন, নূর মোহাম্মদ এখন প্রায় হাজার কোটি টাকার সম্পদের মালিক।

স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, দেশের রেকটিফায়েড স্পিরিটের ব্যবসায় তিন দশক ধরেই প্রভাবশালী নূর মোহাম্মদ (৬৫)। তাঁর পারুল হোমিও হল একসময় বগুড়া তথা উত্তরবঙ্গে স্পিরিট ও হোমিও সামগ্রীর একচ্ছত্র জোগানদাতা ছিল। একসময় পঞ্চগড়ের মার্শাল ডিস্টিলারিজ থেকে উৎপাদিত রেকটিফায়েড স্পিরিট ব্যবসার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ ছিল নূর মোহাম্মদের হাতে।

জেলার কয়েকজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব জানান, আশির দশকে বগুড়ায় ছাত্রদল করতেন নূর মোহাম্মদ। ১৯৮৭ সালে বগুড়ার সাতমাথায় ছাত্রদলের মিছিল থেকে প্রকাশ্যে জাসদ ছাত্রলীগের নেতা লাকীকে হত্যা করা হয়। ওই মামলার আসামি ছিলেন নূর মোহাম্মদ।

জেলা জাসদের বর্তমান সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুল লতিফ পশারি ওরফে ববি তখন জাসদ ছাত্রলীগের দপ্তর সম্পাদক ছিলেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, লাকী হত্যা মামলার আসামি ছিলেন ছাত্রদল নেতা নূর মোহাম্মদ। বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর ওই মামলার রায়ে সবাই খালাস পান।

স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, জেলা বিএনপির সাবেক দুই সভাপতিও ওই মামলার আসামি ছিলেন। পরবর্তীকালে নূর মোহাম্মদসহ সবাই বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিতি পান। তারেক রহমান ও হাওয়া ভবনের পরিচয় ব্যবহার করে নূর মোহাম্মদ এই খাতে ব্যবসা বিস্তার করেছেন। গত বিএনপি আমলে বগুড়ার ফুলবাড়ীতে নূর মোহাম্মদের কারখানা পরিদর্শনে গিয়েছিলেন তারেক রহমান। সেই ঘটনাও নানাভাবে ব্যবহার করতেন নূর মোহাম্মদ।

সর্বশেষ গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শুরুতেই ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি ৩৬ বোতল অ্যালকোহলসহ নূর মোহাম্মদকে গ্রেপ্তার করে র‍্যাব। সেই সময় কয়েক দিন হাজতবাস করতে হয় তাঁকে। এরপর ছাড়া পেয়েই আর বগুড়ায় থাকেননি তিনি। ঢাকায় থেকে ব্যবসার বিস্তার করেছেন। এখন প্রায় সময়ই বিদেশে থাকেন বলে জানা গেছে।

হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার কাজে রেকটিফায়েড স্পিরিট বা ইথানল অ্যালকোহল জোগান দেওয়ার নামে লাইসেন্স নিয়ে হোমিও ব্যবসায়ীরা বেশি লাভের আশায় কম দামের মিথানল বা ভিনেচার স্পিরিট ভেজাল দিয়ে তা মদ হিসেবে বিক্রি করছেন। মিথানল বা ভিনেচার আসলে কাঠের বার্নিশ। এটা সেবনের অনুপযোগী।
মো. মেহেদী হাসান, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের বগুড়ার উপপরিচালক

সর্বশেষ গত ২০ জানুয়ারি বগুড়া প্রেসক্লাবে জমিসংক্রান্ত বিষয় নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে হাজির হন নূর মোহাম্মদ। সেখানে তিনি বলেন, চীনের উদ্যোক্তাদের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে আয়ুর্বেদিক কারখানা দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছেন। প্রায় তিন শ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে আট বিঘা জমির ওপর কারখানা হবে। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরে হোমিও এবং আয়ুর্বেদিক শিল্পে তাঁর তিন শ কোটি টাকা বিনিয়োগ। এখানেও চীনাদের যুক্ততা রয়েছে।

এসব বিষয়ে কথা বলার জন্য যোগাযোগ করা হলেও নূর মোহাম্মদকে পাওয়া যায়নি। তিনি এখন দেশের বাইরে বলে একটি সূত্র জানিয়েছে।

বগুড়ায় মদের ছড়াছড়ি
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, হোমিও চিকিৎসায় অ্যালকোহল জোগানের কথা বলে বগুড়া শহরের সাতটি প্রতিষ্ঠান লাইসেন্স নিয়েছে। এর মধ্যে শহরের ফুলবাড়ী এলাকার পারুল হোমিও ল্যাবরেটরির নামে দুটি লাইসেন্সে বছরে ৪০০ লিটার রেকটিফায়েড স্পিরিট বিক্রির অনুমতি রয়েছে। এ ছাড়া করতোয়া হোমিও হল বছরে ২৯ লিটার, মাটিডালি এলাকার ফেরদৌস হোমিও হল বছরে ১০ লিটার, লতিফপুর কলোনির নিরাময় হোমিও ফার্মেসি বছরে ২২ লিটার, বেনুপুর হোমিও চেম্বার বছরে ১১ লিটার, দি মুন হোমিও হল বছরে ৫০ লিটার এবং তিনমাথা এলাকার খান হোমিও হলের বছরে ৩০ লিটার স্পিরিট বিক্রির অনুমোদন রয়েছে।

তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বগুড়া শহরের পাইকারি দোকানসহ অর্ধশত হোমিও দোকান থেকে প্রতি মাসে কমপক্ষে ২০ হাজার লিটার স্পিরিট বিক্রি হচ্ছে। এর মধ্যে অর্ধেকই বিক্রি হচ্ছে এই তিন ভাইয়ের মালিকানাধীন পারুল হোমিও ল্যাবরেটরি ও পুনম হোমিও ল্যাবরেটরি থেকে। এ ছাড়া ভেজাল মদ বিক্রির অন্যতম হোতা তিনমাথা এলাকার খান হোমিও হলের শাহিনুর রহমান। তিনিও এখন আত্মগোপনে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বগুড়া শহরের পাইকারি দোকানসহ অর্ধশত হোমিও দোকান থেকে প্রতি মাসে কমপক্ষে ২০ হাজার লিটার স্পিরিট বিক্রি হচ্ছে। এর মধ্যে অর্ধেকই বিক্রি হচ্ছে এই তিন ভাইয়ের মালিকানাধীন পারুল হোমিও ল্যাবরেটরি ও পুনম হোমিও ল্যাবরেটরি থেকে। এ ছাড়া ভেজাল মদ বিক্রির অন্যতম হোতা তিনমাথা এলাকার খান হোমিও হলের শাহিনুর রহমান।

জানা গেছে, বগুড়া শহরে হোমিও ব্যবসার আড়ালে দীর্ঘদিন ধরে ভেজাল মদের কারখানা খুলে বসেছেন কয়েকজন। তাঁরা হোমিও ওষুধ তৈরির আড়ালে ভেজাল মদ তৈরি করছেন। হোমিও চিকিৎসায় অ্যালকোহল জোগানের লাইসেন্স নিয়ে প্রকাশ্যে ভেজাল মদের কারবার খুলেছেন।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানেও হোমিও ব্যবসার আড়ালে বিপুল পরিমাণ মদ মজুতের প্রমাণ মিলেছে। এর মধ্যে বৃহস্পতিবার শহরের নাটাইপাড়া এলাকার একটি বাসায় করতোয়া হোমিও ল্যাবরেটরির কারখানা থেকে দেড় হাজার লিটার মদ জব্দ করা হয়েছে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, গত ১৫ অক্টোবর করতোয়া হোমিও ল্যাবরেটরি সর্বশেষ ২৯ লিটার স্পিরিট উত্তোলন করেছে। এত বিপুল পরিমাণ স্পিরিট তাদের কাছে কীভাবে এল, তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।

তবে পুলিশি হেফাজতে থাকা করতোয়া হোমিওর মালিক সাহেদুল আলম দাবি করেছেন, তাঁর মজুতে থাকা স্পিরিট তিনি বৈধভাবেই আমদানি করেছেন।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের বগুড়ার উপপরিচালক মো. মেহেদী হাসান প্রথম আলোকে বলেন, হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার কাজে রেকটিফায়েড স্পিরিট বা ইথানল অ্যালকোহল জোগান দেওয়ার নামে লাইসেন্স নিয়ে হোমিও ব্যবসায়ীরা বেশি লাভের আশায় কম দামের মিথানল বা ভিনেচার স্পিরিট ভেজাল দিয়ে তা মদ হিসেবে বিক্রি করছেন। মিথানল বা ভিনেচার আসলে কাঠের বার্নিশ। এটা সেবনের অনুপযোগী। এই কর্মকর্তা বলেন, ইথানল অ্যালকোহল কারখানা পর্যায়ে প্রতি লিটারের দাম ৪৫০ টাকা, মিথানল মাত্র ১২০ টাকা কেজি। বেশি লাভের আশায় মিথানল মিশিয়ে ইথানল বিক্রি করা হচ্ছে।