লোকালয় ঘেঁষে ফসলি জমিতে চালকল, পরিবেশের বারোটা

মাদারীপুরে যত্রতত্র গড়ে ওঠা স্বয়ংক্রিয় চালকলের নেই কোন বর্জ্য পরিশোধনাগার। তাই কারখানার দূষিত বর্জ্য গিয়ে মিশছে ফসলি জমিতে। সম্প্রতি রাজৈর উপজেলার মাতুব্বরবাড়ি এলাকায়ছবি: প্রথম আলো

পরিবেশ আইনের তোয়াক্কা না করে মাদারীপুরে জনবসতি ঘেঁষে গড়ে উঠেছে ছোট–বড় স্বয়ংক্রিয় ১৭টি চালকল (অটো রাইস মিল)। এসব চালকলের বর্জ্যে নষ্ট হচ্ছে ফসলি জমি, দূষিত হচ্ছে খালবিল, নদী। চালকলের ধোঁয়া ও ছাইয়ে গাছপালার পাতা পর্যন্ত কালো হয়ে গেছে। গাছে ফল ধরে না। এলাকার বয়স্ক ও শিশুরা ভুগছেন শ্বাসকষ্টে।

তথ্য অধিকার আইনে চলতি মাসের শুরুর দিকে মাদারীপুর জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ে আবেদন করেন এই প্রতিনিধি। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে পাওয়া তথ্য বলছে, জেলায় অনুমোদিত  স্বয়ংক্রিয় ১০টি বড় চালকল রয়েছে। এর মধ্যে রাজৈর উপজেলায় সাতটি, কালকিনিতে দুটি ও সদরে একটি চালকল রয়েছে। মালিকেরা নিজ উদ্যোগে চালকল স্থাপনের পর খাদ্য অধিদপ্তরে আবেদন করেই উৎপাদন শুরু করেন।

তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেলায় ছোট–বড় মিলিয়ে স্বয়ংক্রিয় ২০টি চালকল রয়েছে। সদর ও কালকিনির ৩টি কারখানা ছাড়া বাকি ১৭টির একটিও পরিবেশের নিয়মনীতি মেনে স্থাপন করা হয়নি। এ কারণে কারখানার গরম পানি, ছাই ও দূষিত বর্জ্যে আবাদি জমি ও নদীদূষণ হচ্ছে।

মাদারীপুরে স্বয়ংক্রিয় চালকলের সব বর্জ্য ফেলা হচ্ছে কুমার নদের পাড়ে। এ কারণে নদের একটি অংশ ভরাটও হয়ে গেছে। সম্প্রতি রাজৈর উপজেলার তাঁতিকান্দি এলাকার পলাশ অটো রাইস মিলের পাশে
ছবি: প্রথম আলো

এক গ্রামে চারটি চালকল

রাজৈর উপজেলার হোসেনপুর ইউনিয়নের তাঁতিকান্দি গ্রামে গত দুই বছরে মেসার্স জবেদা অটোরাইস মিল, মেসার্স রোকেয়া অটোরাইস মিল, মেসার্স জননী অটোরাইস মিল ও মেসার্স পলাশ অটোরাইস মিল নামে বড় বড় চারটি কারখানা স্থাপন করেছেন স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। এ ছাড়া এ গ্রামেই আছে ছোট আরও তিনটি স্বয়ংক্রিয় চালকল।

সম্প্রতি সরেজমিনে তাঁতিকান্দি গ্রামে চোখে পড়ল মেসার্স জবেদা অটোরাইস মিলটি। চালকলটির চারপাশ কালো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন। চালকলের ভেতরে ঢুকতেই দেখা গেল, শ্রমিকেরা কাজ করছেন। শ্রমিকদের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতার বালাই নেই। তাঁদের মুখমণ্ডলে কালো ছাইয়ের আস্তর পড়ে আছে। খাদ্য অধিদপ্তরের অনুমোদন থাকলেও চালকলটিতে নেই বর্জ্য পরিশোধনের ব্যবস্থা। তাই চালকলের সব বর্জ্য ফেলা হচ্ছে কুমার নদে। চুল্লি দিয়ে ধোঁয়ার সঙ্গে তুষের ছাই চারদিকে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে পড়ছে।
তাঁতিকান্দি গ্রামের বাসিন্দা দেলোয়ার শেখ প্রথম আলোকে বলেন, মিলের কাছাকাছি ১০ মিনিট দাঁড়ানো যায় না। ছাই উড়তে থাকে পুরো এলাকায়। গাছপালার পাতা কালো হয়ে গেছে। গাছে নতুন করে কোনো ফল ধরে না। এলাকায় শিশু ও বৃদ্ধরা শ্বাসকষ্টসহ নানা রোগে ভুগছে। এসব মিল এভাবে চলতে থাকলে এলাকায় বসবাস করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।

জানতে চাইলে মেসার্স জবেদা অটো রাইস মিলের মালিক মো. দেলোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘অটো রাইস মিল চালালে কিছু ক্ষতি হবে, আবার উপকারও হবে। এখানে সব নিয়ম মেনেই মিলটি করা হয়েছে। সবকিছুর অনুমোদন আছে আমাদের।’

পরিবেশের ভারসাম্য ঠিক রাখতে চালকলগুলো বন্ধ চান হোসেনপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. হাবিবুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মিলগুলো পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে চালানোর কথা বলে মালিকপক্ষ ইউপি থেকে অনাপত্তি সনদ নেয়। মিলের উৎপাদন শুরুর পর এলাকাবাসী আমাদের কাছে অভিযোগ জানায়, ছাই উড়ে ঘরবাড়ি, গাছপালা ও পরিবেশ দূষিত হচ্ছে, নদীতে মিলের বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। পরিবেশ ও খাদ্য অধিদপ্তর চাইলে এগুলো বন্ধ করতে পারে।

মাদারীপুরে যত্রতত্র গড়ে ওঠা স্বয়ংক্রিয় চালকলের নেই কোন বর্জ্য পরিশোধনাগার। তাই কারখানার দূষিত বর্জ্য গিয়ে মিশছে ফসলি জমিতে। সম্প্রতি রাজৈর উপজেলার মাতুব্বরবাড়ি এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

বর্জ্যে ফসলের ক্ষতি

২০১৯ সালের ৭ অক্টোবর হোসেনপুর ইউনিয়নের মাতুব্বরবাড়ি এলাকার ঘনবসতি ও ফসলি জমির মধ্যে গড়ে ওঠা জননী অটো রাইস মিলের যাত্রা শুরু হয়। মিলটির উদ্বোধন করেন মাদারীপুর-২ আসনের সাংসদ শাজাহান খান। চালকলটির চারপাশে ফসলি জমি। জমির মাঝখানে হওয়ায় গরম পানি, ছাই ও দূষিত বর্জ্য ফেলা হয় চালকলের পেছনের একটি খোলা জায়গায়। এ ছাড়া রাজৈর উপজেলার কামালদী এলাকার মেসার্স সাদিয়া এন্টারপ্রাইজ অটো রাইস মিল, নয়াকান্দি এলাকার মেসার্স রতন অটো রাইস মিলসহ অন্তত ১০টি চালকলের বর্জ্যের কারণে ফসলি জমির ক্ষতি হচ্ছে। এ বিষয়ে বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ করেও কোনো কাজ হয়নি বলে ভুক্তভোগীরা জানান।

মাতুব্বরবাড়ি এলাকার বাসিন্দা জাহাঙ্গীর মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছাই উড়ে অস্থির একটা অবস্থার মধ্যে আছি আমরা। জমিজমা সব শ্যাষ। রাতদিন শব্দের সমস্যা তো আছেই। ধুলাবালিতে কানা হয়ে যায় সব। দুই বছর ধরে নরক যন্ত্রণায় আছি আমরা।’

অনুমোদনের ব্যাপারে জানতে চাইলে জননী অটো রাইস মিলের মালিক মো. হেলাল মাতুব্বর বলেন, তাঁরা শ্রম মন্ত্রণালয়, পরিবেশ অধিদপ্তর, খাদ্য অধিদপ্তরসহ সব ধরনের লাইসেন্স নিয়ে মিল চালাচ্ছেন।


জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর মাদারীপুর কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, অটো রাইস মিলের ধোঁয়া ও ছাই পরিবেশ ও ফসলের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। রাজৈর উপজেলায় এর প্রভাব বেশি পড়ছে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় পরিবেশ ও খাদ্য অধিদপ্তরকে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে।

নজর নেই সংশ্লিষ্ট দপ্তরের

তথ্য অধিকার আইনে জানতে চাইলে মাদারীপুর খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় থেকে বলা হয়, চালকল করতে প্রথমে মালিক জমি নির্ধারণ করে কল স্থাপন করেন। পরে দলিলের কপি, বিদ্যুৎ বিলের কপি, পরিবেশের ছাড়পত্রসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দিয়ে খাদ্য অধিদপ্তরের নির্ধারিত প্রকৌশলীর কাছে আবেদন করতে হয়।

জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তর, ফরিদপুর কার্যালয়ের উপপরিচালক এ এইচ এম রাশেদ প্রথম আলোকে বলেন, তিন-চারটি অটো রাইস মিলের ছাড়পত্র আছে। কয়েকটার আবেদন করা আছে। তবে যাঁরা ছাড়পত্র নিয়েছেন তাঁদের বেশির ভাগই নবায়ন করছেন না। মিলগুলো সময়ের অভাবে পরিদর্শন করা হয়নি।

এ এইচ এম রাশেদ আরও বলেন, ‘অবৈধ রাইস মিলের বিষয়ে অভিযোগ আমরা পাইনি। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেব। তবে লাইসেন্স বা মিল বন্ধ করার এখতিয়ার আমাদের নেই। এটি খাদ্য অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণে।’

এদিকে ফসলি জমি ও লোকালয়ে চালকল করার ছাড়পত্র দেওয়ার বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরকে দায়ী করছে খাদ্য অধিদপ্তর। জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তা ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘পরিবেশের ক্ষতি হলে তা দেখার দায়িত্ব পরিবেশ অধিদপ্তরের। তারাই পদক্ষেপ নেবে। তা ছাড়া পরিবেশগত ছাড়পত্র ছাড়া একটি অটো রাইস মিলেরও অনুমোদন দেয় না খাদ্য বিভাগ।’

জানতে চাইলে মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক রহিমা খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে ফসলি জমি ও নদীদূষণ করে কোনো প্রতিষ্ঠান চালানো যাবে না। যাঁরা এসব চালকল চালাচ্ছেন, প্রশাসনের পক্ষ থেকে ওই কারখানার মালিককে সতর্ক করা হবে। তারপরও নির্দেশনা না মানলে নিয়ম ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।