রোহিঙ্গাদের সুরক্ষার আবেদনে আইসিজের সিদ্ধান্ত আজ
গণহত্যাসহ সব ধরনের নিপীড়নের হাত থেকে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষায় অন্তর্বর্তী ব্যবস্থার বিষয়ে আজ স্থানীয় সময় সকাল ১০টায় শান্তি প্রাসাদে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) সিদ্ধান্ত ঘোষিত হবে। আদালতের প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আবদুলকোয়াই আহমেদ ইউসুফ আনুষ্ঠানিকভাবে এই আদেশ ঘোষণা করবেন। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মিয়ানমার সরকারের দীর্ঘ কয়েক দশকের জাতিগত বৈষম্য ও নিপীড়ন এবং ২০১৭ সালের সেনা অভিযানের পটভূমিতে গাম্বিয়া এই সুরক্ষার আবেদন করে।
মিয়ানমার ও গাম্বিয়া উভয়েই ১৯৪৯ সালে গৃহীত গণহত্যা সনদে স্বাক্ষরকারী দেশ। এই সনদের বাধ্যবাধকতা পূরণে মিয়ানমারকে বাধ্য করার লক্ষ্যেই এই মামলা। গাম্বিয়ার পক্ষে আদালতে প্রতিনিধি হলেন দেশটির আইনমন্ত্রী ও অ্যাটর্নি জেনারেল আবুবকর মারি তামবাদু এবং বিবাদী মিয়ানমারের পক্ষে দেশটির স্টেট কাউন্সেলর শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অং সান সু চি। আজ অবশ্য আদালতে সু চির উপস্থিত হওয়ার সম্ভাবনা কম। তাঁর জায়গায় মিয়ানমারের বিকল্প প্রতিনিধি স্টেট কাউন্সেলরের দপ্তরের ইউনিয়ন মন্ত্রী চ টিন্ট সোয়ে আদালতে উপস্থিত হবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
গত ডিসেম্বরের ১০ থেকে ১২ তারিখ তিন দিন এই আবেদনের ওপর শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। এতে উভয় পক্ষে আন্তর্জাতিক আইনের শীর্ষস্থানীয় বিশেষজ্ঞরা অংশ নেন। আন্তর্জাতিক আদালতের ১৫ জন স্থায়ী বিচারপতির সঙ্গে দুই বিরোধীয় রাষ্ট্রের মনোনীত দুজন অ্যাডহক বিচারপতি মামলার শুনানি গ্রহণ করেন। আদালত অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা গ্রহণের আদেশ দিলে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগের বিষয়ে আদালতে পরে আরও শুনানি হবে এবং তা নিষ্পত্তি হতে কয়েক বছর সময় লেগে যেতে পারে।
রায় ঘোষণার মাত্র তিন দিন আগে গত সোমবার নাটকীয়ভাবে মিয়ানমারের প্রতিষ্ঠিত একটি তদন্ত কমিটি বলেছে যে ২০১৭–এর রোহিঙ্গা সংঘাতে যুদ্ধাপরাধ এবং গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন ঘটেছে। তবে সেগুলোতে গণহত্যার উদ্দেশ্য ছিল না। ফিলিপাইনের রোজারিও জি মানালোর নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের এই কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৭–এর ২৫ আগস্ট থেকে ৫ সেপ্টেম্বর সময়ে রাখাইন রাজ্যে আরসা বিদ্রোহীদের সঙ্গে যা ঘটেছে, তা অভ্যন্তরীণ সংঘাত। তবে মিয়ানমার সরকার পুরো প্রতিবেদন প্রকাশ স্থগিত রেখে শুধু একটি সংক্ষিপ্তসার প্রকাশ করেছে। মানবাধিকার বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, আন্তর্জাতিক আদালতের কাছে রাষ্ট্রীয় বিচারপ্রক্রিয়াকে তুলে ধরার উদ্দেশ্যে এটি করা হয়ে থাকতে পারে।
গাম্বিয়ার পক্ষ থেকে জাতিসংঘ তথ্য অনুসন্ধানী দলের প্রতিবেদনে গণহত্যার উদ্দেশ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর পদ্ধতিগত হত্যা, নিপীড়ন চালানোর তথ্য তুলে ধরা হয়। বিশ্ব দীর্ঘদিন নীরব দর্শক হয়ে থাকায় এমনটি ঘটেছে দাবি করে গাম্বিয়ার প্রতিনিধিরা বলেন, গণহত্যা রাতারাতি ঘটে না, তার জন্য যুগ যুগ ধরে ঘৃণা আর বিদ্বেষ লালন করা হয়। একটি জাতিগোষ্ঠীকে মানবেতর প্রাণীতে পরিণত করার প্রক্রিয়া (ডিহিউম্যানাইজ) মিয়ানমার অনেক দিন ধরে অনুসরণ করে এসেছে। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার নামে অব্যাহত হত্যা-ধর্ষণ-লুণ্ঠন ও বাস্তুচ্যুতি ঘটিয়ে চলেছে, আর তা থেকে সুরক্ষা দেওয়ার দাবিতেই এই আবেদন উল্লেখ করে গাম্বিয়া অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা হিসেবে ৬টি পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশনা দেওয়ার জন্য আদালতের প্রতি অনুরোধ জানায়।
মিয়ানমারের পক্ষে অং সান সু চি এবং তাঁর আইনজীবীরা দাবি করেন, যা ঘটেছে তাতে অপরাধ হলেও হতে পারে, কিন্তু সেসব অপরাধে গণহত্যার উদ্দেশ্যে ছিল না। রোহিঙ্গাদের নাম উচ্চারণ না করে সু চি দাবি করেন, সন্ত্রাস মোকাবিলায় যেসব অপরাধ ঘটেছে, তাকে গণহত্যা বলা যায় না এবং নতুন করে গণহত্যার কোনো আশু ঝুঁকি নেই। পুরো বিষয়টিকে অভ্যন্তরীণ সংঘাত অভিহিত করে তাঁরা দাবি করেন, সশস্ত্র বাহিনীর যাঁরা গুরুতর অপরাধ করেছেন, সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে মিয়ানমার তাঁদের বিচার করবে। এই বিচারপ্রক্রিয়ার আন্তর্জাতিকীকরণ উচিত হবে না। তিনি বলেন, আদালতের যেকোনো অন্তর্বর্তী আদেশ বাংলাদেশে পালিয়ে আশ্রয় নেওয়া উদ্বাস্তুদের সম্ভাব্য পুনর্বাসনে বাধা তৈরি করবে।
আদালতে গাম্বিয়া রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা ও তাদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য যে ছয়টি অন্তর্বর্তীকালীন পদক্ষেপ নেওয়ার আবেদন জানিয়েছে সেগুলো হচ্ছে: রোহিঙ্গাদের গণহত্যাসহ সব ধরনের নিপীড়ন থেকে সুরক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করা, সামরিক ও আধা সামরিক বাহিনীসহ সব সশস্ত্র বাহিনী ও সংগঠনকে গণহত্যা সংঘটন ও গণহত্যার ষড়যন্ত্র থেকে নিবৃত্ত রাখা, গণহত্যার কোনো আলামত নষ্ট না করা, পরিস্থিতির অবনতি ঘটে এমন কোনো কিছু করা থেকে মিয়ানমার এবং গাম্বিয়াকে বিরত থাকতে বলা, এসব নির্দেশনা পালনের বিষয়ে মিয়ানমার এবং গাম্বিয়া চার মাসের মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন পেশ এবং জাতিসংঘের তদন্তকারীসহ অন্যদের তদন্তের প্রয়োজনে আরাকানে ধ্বংসপ্রাপ্ত রোহিঙ্গাদের গ্রামগুলোতে অবাধ প্রবেশাধিকার দেওয়া।
আন্তর্জাতিক আদালতের সিদ্ধান্ত সব রাষ্ট্রের জন্যই মেনে চলার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে এর ব্যতিক্রমও ঘটেছে। কোনো রাষ্ট্র এই আদালতের সিদ্ধান্ত প্রতিপালন না করলে অপর পক্ষ বিষয়টি বাস্তবায়নের জন্য নিরাপত্তা পরিষদের শরণাপন্ন হতে পারে।