রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে কূটনৈতিক নাটক মিয়ানমারের
মিয়ানমারের রাখাইন থেকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের আজ দুই বছর হলো। সাম্প্রতিক ইতিহাসে এটি সবচেয়ে বড় মানবিক সংকট বলে স্বীকৃত। রাখাইনের ২০১৭ সালের ওই নৃশংসতাকে গণহত্যা বলছে জাতিসংঘ। কক্সবাজারের বিপুল এলাকাজুড়ে মাত্র কয়েক মাসের মাথায় যে সাত লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছিল, দুই বছরে তাদের একজনকেও ফেরত পাঠানো যায়নি।
কূটনীতিক এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকেরা বলছেন, বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ঢলের শুরু থেকেই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিশেষ করে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন জোট, পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশ, মানবাধিকার সংগঠন ও গণমাধ্যম বাংলাদেশের পাশে আছে। অথচ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অনেকটা আড়ালে রেখে প্রত্যাবাসনের চেষ্টা হয়েছে দুবারই। মিয়ানমার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে একধরনের কূটনৈতিক নাটক খেলেছে। চীনের সরাসরি মধ্যস্থতায় বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সর্বশেষ ২২ আগস্ট রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের তারিখ ঠিক করে। এর আগে ২০১৮ সালের ১৫ নভেম্বর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের প্রথম তারিখ ঠিক হয়েছিল। দুটি চেষ্টাই ব্যর্থ হয়।
সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে রোহিঙ্গা সংকটকে ঘিরে মিয়ানমারের ওপর নতুন করে চাপ আসতে পারে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালত (আইসিসি) আর আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতেও (আইসিজে) রোহিঙ্গা নিধনের অভিযোগে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরুর প্রক্রিয়া এগিয়ে চলেছে। এ বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে মিয়ানমার এবার চীনের হাত ধরে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য রাজি হয়েছিল। ২২ আগস্ট রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের দিন যখন আন্তর্জাতিক মহল কক্সবাজারে চোখ রাখছিল, তখন মিয়ানমারের প্রশাসনিক রাজধানী নেপিডোতে দেশটির সেনাপ্রধান সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের সঙ্গে দেখা করেন চীনের রাষ্ট্রদূত শেন হেই। রাখাইনের রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আন্তর্জাতিক মহল চাপ দিলে চীন যে মিয়ানমারের পাশে থাকবে, সেটি তিনি ওই বৈঠকে উল্লেখ করেছেন।
এদিকে দুই দফা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর বাংলাদেশের পরবর্তী কৌশল কী, সেটা এখনো স্পষ্ট নয়। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের দুই বছরের মাথায় প্রত্যাবাসনের বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, চীনের বিশেষ উদ্যোগ ও মিয়ানমারের অনুরোধে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের তারিখ ঠিক হয়েছিল। ২২ আগস্ট রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু না হলেও রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর জন্য প্রস্তুতির প্রক্রিয়া চালু আছে।
তবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ব্যর্থ হওয়ায় বাংলাদেশের দিকে আঙুল তুলছে মিয়ানমার। দেশটির সরকারি গণমাধ্যম গ্লোবাল নিউ লাইট অব মিয়ানমারের গত শুক্রবারের খবরে বলা হয়েছে, সম্ভাব্য প্রত্যাবাসনকারীদের কাছে স্বেচ্ছায় ফেরার ব্যাপারে যথাযথ আবেদনপত্র বিলি করা হয়নি। এ ছাড়া হিন্দু সম্প্রদায়ের ৪০০ জনকে দ্রুত ফেরত পাঠানোর বিষয়টিও বাংলাদেশ অগ্রাহ্য করেছে।
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন বলেন, মিয়ানমার সরকারের বিষয়ে রোহিঙ্গাদের মধ্যে আস্থার সংকট আছে। কাজেই রোহিঙ্গাদের আস্থা ফেরানোর দায়িত্ব নিতে হবে মিয়ানমারকেই।
>রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ২ বছর হলো
প্রত্যাবাসন নিয়ে অনিশ্চয়তা
এখন বাংলাদেশকে দোষ দিচ্ছে মিয়ানমার
রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের প্রক্রিয়ায় যুক্ত লোকজনের সঙ্গে কথা বলে ধারণা পাওয়া গেছে, রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফেরত পাঠাতে ২০১৭ সালের নভেম্বরে মিয়ানমারের সঙ্গে প্রত্যাবাসনের চুক্তি করেছিল বাংলাদেশ। এ সংকট সমাধানের জন্য বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় পন্থাকে উপায় হিসেবে দেখছে। বাংলাদেশ এ সমস্যা সমাধানে দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় উপায়ের কথা সব সময় বলছে। কিন্তু মিয়ানমার যে আসলেই প্রত্যাবাসন চাইছে না, সেটা তারা দুই দফায় প্রমাণ করেছে। কারণ, রাখাইনে এখনো প্রত্যাবাসনের উপযোগী পরিবেশ ফেরেনি।
এদিকে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের দুই বছর উপলক্ষে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর গতকাল এক বিবৃতিতে রোহিঙ্গাদের উদাত্ত সহযোগিতার জন্য বাংলাদেশের প্রশংসা করেছে। বিবৃতিতে বলা হয়, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এখনো বৈষম্য অব্যাহত থাকায় কফি আনানের নেতৃত্বাধীন কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য মিয়ানমার সরকারকে অব্যাহতভাবে সহযোগিতা করে যাবে যুক্তরাষ্ট্র। কারণ, এটা মিয়ানমার ও বাংলাদেশে পালিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গাসহ রাখাইনের সব জনগোষ্ঠীকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে সেরা উপায়। রোহিঙ্গারা যাতে স্বেচ্ছায়, মর্যাদাপূর্ণভাবে ও টেকসই উপায়ে রাখাইনে তাদের আদি নিবাসে বা পছন্দসই জায়গায় ফিরে যেতে পারে, সে ব্যাপারে মিয়ানমারকে উৎসাহ জোগাতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়াস অব্যাহত থাকবে।
বাংলাদেশের কূটনীতিকেরা মনে করেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে ব্যর্থ প্রমাণ করে মিয়ানমার ও তার সমর্থকেরা এ দেশের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি নষ্ট করার পাঁয়তারা করছে। কারণ, এখন পর্যন্ত নানা রকম ঝুঁকি থাকার পরও উদারভাবে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয়েছে বাংলাদেশ। তবে ২০১৭ সালের আগস্টে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার ক্ষেত্রে মোটামুটি জাতীয় ঐকমত্য তৈরি হয়েছিল। দুই বছরের মাথায় এসে কক্সবাজারের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিলে রোহিঙ্গাদের এত ব্যাপক পরিসরে আশ্রয় দেওয়াটা ঠিক ছিল কি না, সে প্রশ্ন এখন বড় হয়ে আসছে।
যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ূন কবীর এ বিষয়ে গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের সময় আমাদের মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোকে বিবেচনায় নিতে হবে। দেশটিতে রোহিঙ্গাদের বিষয়ে সরকার, সামরিক ও ধর্মীয় নেতৃত্ব এক কাতারে রয়েছে। তাই বন্ধুদেশগুলোর সহযোগিতার পাশাপাশি এ সমস্যার দ্রুত সমাধানের জন্য মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত রাখতে বাংলাদেশকে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।’
এম হুমায়ূন কবীরের মতে, অর্থনৈতিক স্বার্থের পাশাপাশি ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেও এ সংকটে চীনের বিশেষ স্বার্থ রয়েছে। মিয়ানমারে নিজেদের বিনিয়োগের পাশাপাশি জাপানের বিনিয়োগ নিয়ে চীনের একধরনের সতর্কতা আছে। আবার বাইরের দেশ এ অঞ্চলে অবারিতভাবে চলে আসুক, এটাও চীন চাইছে না। তাই রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে চীন বিশেষ উদ্যোগী হয়েছে।
রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে ২০১৭ সালের নভেম্বরের প্রত্যাবাসন চুক্তিতে পথনকশা করা আছে। এর বাইরে যদি চীন, জাপানের মতো বন্ধুদেশ কোনো উদ্যোগ নিতে চায়, তবে তাদের সুস্পষ্ট করে কয়েকটি বিষয় বলা উচিত। এসব দেশকে রাখাইনে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ব্যাপারে দায়িত্ব নিতে হবে। রোহিঙ্গারা যেন ফিরে গিয়ে অবাধে চলাফেরা করতে পারে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। রোহিঙ্গাদের আদি বাড়ি বা জমিতে ফেরানোর নিশ্চয়তা থাকতে হবে। সামগ্রিকভাবে রাখাইনে নিরাপত্তাসহ প্রত্যাবাসনের উপযোগী পরিবেশ হয়েছে কি না, রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর আগে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে রোহিঙ্গা মাঝি (রোহিঙ্গাদের নেতা) ও গণমাধ্যমকর্মীদের মিয়ানমারের রাজ্যটিতে নেওয়ার ব্যবস্থা করা।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মনে করেন, চীন, জাপানসহ মিয়ানমারের ঘনিষ্ঠ দেশের মধ্যস্থতায় পরের দফা প্রত্যাবাসনের সময়সীমা ঠিক করার সময় বাংলাদেশের এ বিষয়গুলো সামনে আনা উচিত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের পরিচালক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনকে সামনে রেখে রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে মিয়ানমারের ওপর বড় পরিসরে চাপ আসতে যাচ্ছিল। তাই সেটিকে সরিয়ে দিতে মিয়ানমার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে একধরনের কূটনৈতিক নাটক করেছে। ২০১৮ সালের ১৫ নভেম্বরও মিয়ানমার একই কাজ করেছিল। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মিয়ানমার শুরু থেকে এখন পর্যন্ত আন্তরিক নয়। তিনি বলেন, ‘দুই দফার ঘটনা থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত, যাতে করে মিয়ানমারের ফাঁদে আমরা আটকে না যাই।’