২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন আরও দীর্ঘায়িত হতে পারে

মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতি সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করবে বাংলাদেশ।

ফাইল ছবি।

২০১৭ সালের পর থেকে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে মূল বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে রোহিঙ্গা সংকট। এ সময়ে অং সান সু চির বেসামরিক সরকার রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বাংলাদেশের সদিচ্ছাকে মূল্যায়ন করেনি। তাঁর এ অবস্থানে দেশটির সেনাবাহিনীর মতেরই প্রতিফলন দেখা গেছে। এখন মিয়ানমারে সামরিক সরকার আবার ক্ষমতা দখল করায় দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত সমস্যায় খুব বেশি পরিবর্তন আসবে না বলেই মনে করা হচ্ছে। বরং রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পুরো প্রক্রিয়া আরও দীর্ঘায়িত হতে পারে।

মিয়ানমারে ক্ষমতার পালাবদল, রোহিঙ্গা সংকটে কী প্রভাব ফেলতে পারে, সে সম্পর্কে কয়েকজন কূটনীতিক ও দুজন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকের সঙ্গে কথা বলে এমন ধারণা পাওয়া গেছে। তবে ঢাকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা মনে করছেন, এবার উল্টোটাও ঘটতে পারে। ১৯৮০ ও ১৯৯০–এর দশকে সেনাশাসনের সময়ই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন হয়েছিল। ওই সময় বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের অধিকাংশই ফেরত গেছে। কাজেই এবারও সামরিক শাসনের সময় হুট করে প্রত্যাবাসন হলেও হতে পারে।

গতকাল সোমবার মিয়ানমারের ক্ষমতার পালাবদলের পর বাংলাদেশ একটি বিবৃতি দিয়েছে। এতে বলা হয়েছে, নিকট প্রতিবেশী মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া আর সাংবিধানিক পন্থা সমুন্নত থাকার প্রত্যাশা করে বাংলাদেশ। আর বন্ধুপ্রতিম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ সে দেশে শান্তি ও স্থিতিশীলতা দেখতে চায়। রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায়, নিরাপদ ও টেকসই প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমারের সঙ্গে কাজ করছে বাংলাদেশ। এ প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে বলে আশা করে বাংলাদেশ।

এ নিয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন গতকাল সন্ধ্যায় তাঁর দপ্তরে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা চাইব না প্রত্যাবাসন নিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে যে আলোচনা চলছে, তা শ্লথ হয়ে পড়ুক। সেখানে নতুন সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। আমরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের পর যত শিগগিরই সম্ভব এ আলোচনা অব্যাহত রাখতে নতুন প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করব।’

সীমান্তে নজরদারির বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রসচিব বলেন, মিয়ানমারের ক্ষমতার পালাবদলের কারণে যাতে দুই দেশের সীমান্তে অনুপ্রবেশ ও অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো ঘটনা না ঘটে, সে ব্যাপারে বাংলাদেশ সতর্ক থাকবে।

কূটনৈতিক সূত্রগুলো মনে করে, মিয়ানমারে বেসামরিক নেতৃত্বের পরিবর্তে সামরিক সরকার ক্ষমতা নেওয়ায় রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে দেশটির মনোভাবের নীতিগত কোনো পরিবর্তন হবে না। তাই আইসিজে ও আইসিসিসহ আন্তর্জাতিক পরিসরে চাপ বাড়ানোর বিষয়ে বাংলাদেশকে মনোযোগী থাকতে হবে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে চীনের ভূমিকা কেমন হবে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কী প্রতিক্রিয়া দেখাবে, সেসব বিষয়ও এখন সামনে চলে আসছে।

দুই দেশের সীমান্তে অনুপ্রবেশ ও অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো ঘটনা যাতে না ঘটে, সে ব্যাপারে বাংলাদেশ সতর্ক থাকবে।
মাসুদ বিন মোমেন, পররাষ্ট্রসচিব

ঢাকা, ইয়াঙ্গুন, নিউইয়র্ক ও জেনেভার কূটনৈতিক সূত্রগুলোর মতে, চীন এখন বৈশ্বিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে যাচ্ছে। এ মুহূর্তে একটি অগণতান্ত্রিক সরকারকে নিরঙ্কুশ সমর্থন দেওয়ার বিষয়ে সাবধান থাকবে দেশটি। কয়েক বছর ধরে অবশ্য সু চির বেসামরিক সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বজায় রেখেছে চীন। এখন ক্ষমতার পালাবদলের পরে মিয়ানমারের সামরিক সরকারের সঙ্গে একই সম্পর্ক রাখবে তারা। দু–এক দিনের মধ্যেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে।

ঢাকার কূটনীতিকেরা বলছেন, সু চিকে আটকের পর পশ্চিমা শক্তিগুলো এবার অতীতের মতো জোরালো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। এতে বোঝা যাচ্ছে সু চির প্রতি তাদের সহানুভূতি আর আগের জায়গায় নেই। রোহিঙ্গা নৃশংসতার দায় সু চির ঘাড়ে অনেকটাই চেপেছে। আইসিজেতে দেশটির সেনাবাহিনীর পক্ষে সাফাই গেয়ে নিজের ভাবমূর্তিকে তলানিতে নিয়েছেন মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রতীক সু চি। অবশ্য এত কিছুর পরও মিয়ানমারের ওপর এখনই চরম অবস্থানে যাওয়ার ব্যাপারে পশ্চিমা দেশগুলো হিসাব–নিকাশ করবে। কারণ, ২০১৫ সালে মিয়ানমারের জাতীয় নির্বাচনের পর সেখানে ব্যবসা ও বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরিতে পাশ্চাত্যের দেশগুলো ভূমিকা রেখেছে। এখন পশ্চিমা দেশগুলো বেশি চাপ দিলে মিয়ানমার আরও বেশি চীনের দিকে ঝুঁকে পড়বে। এটা বিবেচনায় রাখবে পশ্চিমা দেশগুলো। আবার গণতান্ত্রিক সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতায় আসা একটি সামরিক সরকারের সঙ্গে তারা কেমন সম্পর্কে যাবে, সেটা দেখার জন্য অপেক্ষায় থাকতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনাসাইড স্টাডিজের (সিজিএস) পরিচালক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, মিয়ানমারের গণতন্ত্র নিয়ে বরাবরই প্রশ্ন ছিল। কারণ, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সু চিকে মেনে নিলেও তাঁর হাতে ক্ষমতা ছিল না। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের যুক্তি ছিল, মিয়ানমারের গণতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখতে হবে। পরে তো দেখা গেল পশ্চিমারাসহ সবাই মিয়ানমারের সঙ্গে ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী জানে, পাশ্চাত্যের দেশগুলো মুখে যতই বড় কথা বলুক, তারা ব্যবসা–বাণিজ্য বোঝে। এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তারা সামরিক সরকারকে কতটা চাপ দেবে, তা দেখতে হবে।

মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের ভূমিকার বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, মিয়ানমারের সঙ্গে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য যে চুক্তি হয়েছে, তা বাস্তবায়নের জন্য সময়সূচি ধরে কাজ চালিয়ে যেতে হবে। কারণ, অতীতেও সেনাশাসনের সময় বড় আকারে প্রত্যাবাসন হয়েছিল। কাজেই পরিবর্তিত পরিস্থিতি সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করতে হবে।