রোজিনার মুক্তি দাবি যুক্তরাজ্যপ্রবাসী সাংবাদিকদের
প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রোজিনা ইসলামকে সচিবালয়ে পাঁচ ঘন্টার বেশি সময় আটকে রেখে তাঁর ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানোর ঘটনা বাংলাদেশে সাংবাদিকতার জন্য এক অশনীসংকেত বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যুক্তরাজ্যপ্রবাসী সাংবাদিকেরা।
স্থানীয় সময় গতকাল বুধবার পূর্ব লন্ডনের আলতাব আলী পার্কে অনুষ্ঠিত মানববন্ধন কর্মসূচিতে বক্তারা বলেন, এই নির্যাতনের ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা না নেওয়া হলে সারা দেশে স্থানীয় প্রশাসনও সাংবাদিকদের সঙ্গে এমন আচরণ করতে পারে। তাই রোজিনা ইসলামের নিঃশর্ত মুক্তির পাশাপাশি সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে নির্যাতনকারী সরকারি কর্মকর্তা–কর্মচারীদের উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন তাঁরা।
সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের অবিলম্বে মুক্তি এবং নির্যাতনকারী সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিচারের দাবিতে এ মানববন্ধন কর্মসূচির আয়োজন করে যুক্তরাজ্যে বাংলা গণমাধ্যমকর্মীদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাব।
লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাবের সভাপতি এমদাদুল হক চৌধুরী বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নানা দুর্নীতি ও অনিয়ম নিয়ে রোজিনা ইসলাম বেশ কিছু অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করেছেন। ফলে সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মীদের কাছে খুব ভালোভাবেই পরিচিত। তাঁকে আটকে রেখে যেভাবে হেনন্তা করা হয়েছে, তাঁর সাংবাদিক পরিচয় নিয়ে যেভাবে বারবার প্রশ্ন করা হয়েছে এবং পরে যে প্রক্রিয়ায় মামলা দেওয়া হয়েছে—এতে পুরো ঘটনাটি পরিকল্পিত মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। তিনি বলেন, রোজিনা ইসলামকে টার্গেট করার মাধ্যমে সরকার ও আমলাদের দুর্নীতির বিষয়ে অনুসন্ধান না করতে একটি বার্তা দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। আমলাদের দুর্নীতি নিয়ে বেশি বেশি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করার মাধ্যমে প্রশাসনের দুর্নীতিবাজদের এই প্রচেষ্টা রুখে দিতে হবে।
সাপ্তাহিক সুরমার সাবেক সম্পাদক ও বর্তমানে যুক্তরাজ্যের স্থানীয় প্রশাসনে কর্মরত সৈয়দ মনসুর উদ্দিন বলেন, সরকারি চাকরিজীবীরা সরকারি তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষার শপথ করেন। আর একজন সাংবাদিকের শপথ হচ্ছে সত্য প্রকাশ করা। রোজিনা ইসলাম যদি সচিবালয় থেকে কোনো তথ্য নিয়েও থাকেন, তাহলে তিনি সঠিক কাজটিই করেছেন।
সত্যবাণীর সম্পাদক সৈয়দ আনাস পাশা বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনেক সফলতা রয়েছে। কিন্তু গুটিকয় আমলা আর মন্ত্রীর কারণে সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। তিনি বলেন, যেখানেই দুর্নীতি-অনিয়ম, সেখান থেকেই সাংবাদিক যেকোনো উপায়ে তথ্য নিয়ে আসবে—এটাই সাংবাদিকের কাজ।
সাপ্তাহিক দেশ সম্পাদক তাইসির মাহমুদ বলেন, আগে দেখতাম সন্ত্রাসীরা সাংবাদিকদের আক্রমণ করত। এখন দেখছি সরকারি কর্মচারীরা সাংবাদিকদের আক্রমণ করছে।
কবি ও সাংবাদিক হামিদ মোহাম্মদ বলেন, ‘ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কথা আমরা জানি। এখন প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের মধ্যে সিন্ডিকেট দেখা যাচ্ছে। এই সিন্ডিকেট জনগেণের করের অর্থ লুটপাট করছে। তাঁদের দুর্নীতির তথ্য প্রকাশের কারণে সাংবাদিকের ওপর চড়াও হচ্ছেন তাঁরা।’
সাংবাদিক বুলবুল হাসান বলেন, সরকারের শীর্ষ মহল থেকে প্রায়ই বলা হয়, সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে এবং গমাধ্যমের স্বাধীনতার পক্ষে। এ কথার সঙ্গে বাস্তবের মিল নেই।
একাত্তর টিভির প্রতিনিধি তানভির আহমদ বলেন, ‘আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করছি। আর একই সঙ্গে উপনিবেশিক আমলের কালো আইন টিকিয়ে রেখে সাংবাদিকতার কণ্ঠ রোধ করার চেষ্টা হচ্ছে—এটা জাতির জন্য ভীষণ লজ্জার।’
শতাধিক গণমাধ্যমকর্মীর উপস্থিতে অনুষ্ঠিত এ মানববন্ধন সমাবেশের সঞ্চালনা করেন লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ জুবায়ের। এতে বক্তব্য দেন লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মুহিব উদ্দিন চৌধুরী, সাবেক সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম, সাপ্তাহিক সুরমা সম্পাদক শামসুল আলম লিটন, বাংলা পোস্ট সম্পাদক ও প্রেসক্লাবের সহসভাপতি তারেক চৌধুরী, সাপ্তাহিক পত্রিকার প্রধান সম্পাদক মোহাম্মদ বেলাল আহমদ, সাপ্তাহিক জনমতের বার্তা সম্পাদক মুসলেহ উদ্দিন আহমদ, বিবিসির বাংলার মোয়াজ্জেম হোসেন, ভয়েস অব আমেরিকার সাবেক সাংবাদিক শামীম চৌধুরী, টেলিভিশন অনুষ্ঠান উপস্থাপক উর্মি মাযহার, রুপি আমিন, বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রতিনিধি আ স ম মাসুম, কালের কণ্ঠের প্রতিনিধি জুয়েল রাজ প্রমুখ।
অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, এত দিন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন দিয়ে সাংবাদিকদের হয়রানি এবং গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধের চেষ্টা করা হয়েছে। এখন ১৯২৩ সালে ব্রিটিশদের প্রণীত ‘অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট’ ব্যবহার করে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার সুযোগ বন্ধ করার চেষ্টা হচ্ছে। অবিলম্বের এই দুটি আইন সংশোধন করে সাংবাদিকতাকে এসব আইনের আওতামুক্ত করার দাবি জানিয়েছেন তাঁরা।