রায়ের কপি পাওয়া ব্যয়সাপেক্ষ

২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিডিআর বিদ্রোহে ভারী অস্ত্র হাতে জওয়ানরা।  ফাইল ছবি
২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিডিআর বিদ্রোহে ভারী অস্ত্র হাতে জওয়ানরা। ফাইল ছবি

পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহ ও নৃশংস হত্যাযজ্ঞের ১১ বছর পূর্ণ হতে যাচ্ছে আজ বুধবার। ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে হত্যার ঘটনায় করা মামলার বিচারিক আদালতের রায়ের পর​ হাইকোর্টে মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন ও আপিলের ধাপ শেষ হয়েছে। এখন আপিল বিভাগে আপিল করার পালা।

আপিলের জন্য হাইকোর্টের রায়ের প্রত্যয়িত অনুলিপি লাগবে। ২৯ হাজার পৃষ্ঠার রায়ের প্রত্যয়িত কপি নিতে যে টাকা লাগবে, সেটা বহনে অক্ষম দণ্ডিত আসামিরা। এমনটি উল্লেখ করে কোর্ট ফি ছাড়াই কপি পেতে সুপ্রি​ম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের কাছে আবেদন করেছেন আসামিপক্ষের এক আইনজীবী। একেকটি প্রত্যয়িত অনুলিপি বাবদ খরচের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো থেকে একাধিক ধারণা পাওয়া গেছে। এতে দেখা যাচ্ছে, পৌনে দুই লাখ থেকে সাত–আট লাখ টাকা পর্যন্ত পড়তে পারে।

২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি বিডিআর (বিজিবি) সদর দপ্তর পিলখানাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিদ্রোহ করেন সীমান্তরক্ষী এই বাহিনীর একদল সদস্য। তাঁরা সেদিন ঢাকার পিলখানায় চালায় নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। নিষ্ঠুর আচরণ ও পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন সামরিক কর্মকর্তাদের অনেকের পরিবারের সদস্যরাও। দুই দিনব্যাপী ওই বিদ্রোহ শেষে ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনের মরদেহ উ​দ্ধার করা হয়।

ওই ঘটনার পর সীমান্তরক্ষী বাহিনীর পুনর্গঠন করা হয়। বাহিনীর নাম, পোশাক, পতাকা, মনোগ্রামসহ বেশ কিছু বিষয়ে পরিবর্তন আসে। ২০১১ সালের ২৩ জানুয়ারি থেকে বাংলাদেশ রাইফেলস (বিডিআর) দাপ্তরিকভাবে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) নামে পথচলা শুরু করে।

নৃশংস ওই হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় ২০০৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি লালবাগ থানায় হত্যা ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে মামলা হয়, যা পরে নিউমার্কেট থানায় স্থানান্তরিত হয়। ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বরে হত্যা মামলার রায় দেন বিচারিক আদালত।

রায়ের কপি পেতে খরচ কত

আসামিপক্ষের আইনজীবীরা জানান, তাঁরা হত্যা মামলায় আপিল বিভাগে আপিল করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এ জন্য হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায়ের প্রত্যয়িত কপি লাগবে। কিন্তু এই কপি পেতে যে খরচ পড়বে, সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন আসামিদের অনেকে।

এ জন্য কোর্ট ফি ছাড়া পূর্ণাঙ্গ রায়ের ফটো সার্টিফায়েড কপি পেতে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের কাছে ৩ ফেব্রুয়ারি আবেদন করেছেন আসামিপক্ষের আইনজীবী মো. আমিনুল ইসলাম। যিনি হাইকোর্টে মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকা সাবেক ডিএডি সৈয়দ তৌহিদুল আলমসহ দণ্ডপ্রাপ্ত সাড়ে তিন শর বেশি আসামির আইনজীবী ছিলেন।

মো. আমিনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, প্রত্যয়িত অনুলিপি হাতে পাওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে আপিল করার বাধ্যবাধকতা আছে। এ জন্য হাইকোর্টের রায়ের প্রত্যয়িত অনুলিপি লাগবে। তবে পূর্ণাঙ্গ রায়টি ২৯ হাজার ৫৯ পৃষ্ঠার। ফোলিও (একধরনের কাগজ) আকারে ওই রায়ের প্রত্যয়িত কপি নিতে হলে পৃষ্ঠাসংখ্যা দাঁড়াবে ৬০ হাজারের মতো। এ ছাড়া নিম্ন আদালতের রায়, সাক্ষী ও অন্যান্য কাগজপত্র আপিলে যুক্ত করতে হবে। এতে প্রচুর অর্থ লাগবে, যা দরিদ্র দণ্ডিতেরা বহন করতে অক্ষম।

রায়ের একেকটি প্রত্যয়িত অনুলিপি নিতে কত খরচ পড়তে পারে, তার একটা ধারণা দিয়েছেন আইনজীবী মো. আমিনুল ইসলাম। তাঁর ভাষ্য অনুযায়ী, সাধারণ প্রক্রিয়ায় কোর্ট ফি দিয়ে ফোলিওতে রায়ের প্রত্যয়িত অনুলিপি নিতে ৮-৯ লাখ টাকা লাগবে। অন্যান্য খরচসহ একজনের আপিল দায়েরে ২২-২৩ লাখ টাকা লাগবে। আর কোর্ট ফি দিয়ে সাদা কাগজে ফটোকপি করে রায়ের অনুলিপি নিতে লাগবে ২ লাখ টাকার মতো। এতে একজনের আপিল করতে প্রায় ৮ লাখ টাকা লাগবে। অন্যদিকে, কোর্ট ফি ছাড়া ফটোকপি করে রায়ের প্রত্যয়িত অনুলিপি নিতে লাগবে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা। এই কপি দিয়ে আপিল করতে গেলে আনুষঙ্গিক খরচসহ লাগবে প্রায় ৩ লাখ টাকা। এই আইনজীবী জানান, অনুলিপি পাওয়ার পরপরই আপিলের প্রক্রিয়া শুরু করা হবে।

>

পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহ ও নৃশংস হত্যাযজ্ঞের ১১ বছর পূর্ণ। একেকটি কপি পেতে কমপক্ষে পৌনে দুই লাখ টাকা লাগবে। আসামিপক্ষ বলছে, এত টাকা ব্যয় করা সম্ভব নয়।

জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল মো. আলী আকবর গত রোববার প্রথম আলোকে বলেন, হাইকোর্টের রায়ের ফটো সার্টিফায়েড কপির জন্য আবেদন এসেছে। বিধি অনুসারে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।

অবশ্য সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রের ভাষ্য, ইতিমধ্যে প্রত্যয়িত অনুলিপির জন্য ৩২৬টি আবেদন সংশ্লিষ্ট শাখায় এসেছে। কোর্ট ফি দিয়ে ফোলির মাধ্যমে রায়ের একটি অনুলিপি নিতে ২ লাখ ৬২ হাজার ৮০০ টাকার মতো পড়বে। ফটোকপি করে কোর্ট ফি দিয়ে রায়ের অনুলিপি নিতে প্রায় পৌনে দুই লাখ টাকা লাগবে। বর্তমান ব্যবস্থায় প্রতিদিন পাঁচ শ পৃষ্ঠা করে ফটোকপি করা হলেও একটি রায়ের কপি প্রস্তুত করতে অন্তত দুই মাস সময় লাগবে। কোর্ট ফি ছাড়া প্রত্যয়িত অনুলিপি দেওয়ার সুযোগ নেই।

অ্যাটর্নি জেনারেল গতকাল সাংবাদিকদের বলেছেন, ফটোকপিতে স্ট্যাম্প লাগিয়ে নেওয়া হলে একেকটি প্রত্যয়িত অনুলিপি নিতে লাগবে পৌনে দুই লাখ টাকার মতো। আর অন্যান্য প্রত্যয়িত অনুলিপির মতো ফোলিও দিয়ে নিতে হলে টাকা আরও অনেক বেশি লাগবে। আসামির পক্ষে এই টাকা ব্যয় করা সম্ভব হবে কি না, এটা একটা চিন্তার বিষয়। এমন একটা অবস্থা তৈরি হয়েছে, মনে হয় একটা জট সৃষ্টি হবে। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, এ ব্যাপারে তিনি প্রধান বিচারপতির দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করবেন, কীভাবে এর সমাধান করা যায়।

হত্যা মামলার দুই ধাপ শেষ

হত্যা মামলায় আসামি ছিলেন ৮৫০ জন। বিচারিক আদালতের রায়ে ১৫২ জনের মৃত্যুদণ্ড, ১৬০ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, ২৫৬ জনের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড হয়, আর খালাস পান ২৭৮ জন। দেশের ইতিহাসে আসামির সংখ্যার দিক থেকে সবচেয়ে বড় এই হত্যা মামলায় বিচারিক আদালতের রায়ের পর আসামিদের ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) হাইকোর্টে অনুমোদনের জন্য আসে। পাশাপাশি দণ্ডিত আসামি ও রাষ্ট্রপক্ষ খালাস পাওয়া ৬৯ জনের ক্ষেত্রে পৃথক আপিল করে।

পেপারবুক (মামলার বৃত্তান্ত) তৈরির পর ডেথ রেফারেন্স ও আপিল শুনানির জন্য তৎকালীন প্রধান বিচারপতি ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি তিন সদস্যের বিশেষ বেঞ্চ গঠন করে দেন। ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের ওপর ৩৭০ কার্যদিবস শুনানি শেষে বিচারপতি মো. শওকত হোসেন, বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী ও বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদারের সমন্বয়ে গঠিত বিশেষ বেঞ্চ ২০১৭ সালের ২৬ ও ২৭ নভেম্বর রায় ঘোষণা করেন। হাইকোর্টের রায়ে ১৩৯ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়। যাবজ্জীবন সাজা দেওয়া হয় ১৮৫ জনকে এবং বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয় ২২৮ জনকে। এ ছাড়া যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা তোরাব আলীসহ সাজা থেকে অন্যরা খালাস পান। হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় (২৯ হাজার ৫৯ পৃষ্ঠা) গত ৮ জানুয়ারি প্রকাশিত হয়। এর মধ্য দিয়ে বিচারপ্রক্রিয়ায় মামলাটির দুটি ধাপ শেষ হয়েছে। এখন আইনি প্রক্রিয়ায় সংক্ষুব্ধ পক্ষের আপিল বিভাগে আপিল করার সুযোগ রয়েছে।

অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম গতকাল সাংবাদিকদের বলেছেন, এ মামলায় এখন ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ১৩৯ জন, যাবজ্জীবন ১৮৫ জন ও অন্যান্য মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত ২২৮ জন। খালাস দেওয়া হয় ২৮৩ জনকে। খালাসের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র আপিল করবে।

বিস্ফোরক মামলাটি সাক্ষ্য গ্রহণ পর্যায়ে

বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় বিস্ফোরক আইনের মামলাটি এখনো বিচারিক আদালতের গণ্ডি পেরোয়নি। মামলাটির সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে। মামলাটি এখনো বিচারিক আদালতে সাক্ষ্য গ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে। এই মামলায় আসামি ৮৩৪ জন। ২৪ আসামি ইতিমধ্যে মারা গেছেন ও ২০ আসামি পলাতক। এই মামলায় সাক্ষী ১ হাজার ৩৪৪ জন। এই মামলায় আসামিদের অনেকেই হত্যা মামলায় ইতিমধ্যে সাজাপ্রাপ্ত।

এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি মোশাররফ হোসেন কাজল গত শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনাস্থল, সাক্ষী ও আসামি একই হওয়ায় ২০১১ সালের ১০ আগস্ট দুটি মামলায় (হত্যা ও বিস্ফোরক মামলা) একসঙ্গে অভিযোগ গঠন করা হয়। তবে আসামিপক্ষের আবেদনে মামলা দুটির বিচারকাজ পৃথকভাবে চলে। তিনি জানান, সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের এই মামলায় নিরাপত্তাজনিত কারণে আদালতে হাজির করা নিয়ে বিলম্ব হয়। তখন কাঠগড়া ঢেলে সাজানো হয়। যে কারণে বিচারকাজে দেরি হয়েছে। অবিলম্বে মামলাটি নিষ্পত্তি হবে বলে আশা করেন রাষ্ট্রপক্ষের এই কৌঁসুলি।

তবে আসামিপক্ষের আইনজীবী ফারুক আহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, মামলাটির চূড়ান্ত নিষ্পত্তি কবে হবে, তা অনিশ্চিত। হত্যা মামলায় বিচারিক আদালতে ২৭৮ জন খালাস পেলেও বিস্ফোরক মামলায় আসামি থাকায় তাঁরা বের হতে পারেননি। তাঁদের অনেকে জামিন আবেদন করেও বিফল হয়েছেন।

এই মামলার সাক্ষ্য গ্রহণের পরবর্তী দিন ধার্য রয়েছে আগামী ৮ মার্চ।

বিদ্রোহের বিচার 

বিজিবি সূত্র বলেছে, বিডিআরে বিদ্রোহের ঘটনায় সবচেয়ে বেশি জওয়ানের সাজা হয় অধিনায়কদের সামারি ট্রায়ালে (সংক্ষিপ্ত বিচার‍)। এতে ১১ হাজার ২৬৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়। তাঁদের মধ্যে ১০ হাজার ৯৭৩ জনের বিভিন্ন ধরনের সাজা হয়। সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ৮ হাজার ৭৫৯ জনকে চাকরিচ্যুত করা হয়। অন্যরা প্রশাসনিক দণ্ড শেষে আবার চাকরিতে যোগ দেন। দ্বিতীয় পর্যায়ে সারা দেশে বিশেষ আদালত গঠন করে বিচার করা হয়। সর্বশেষ মামলার রায় হয় ২০১২ সালের ২০ অক্টোবর। বিশেষ আদালতে মোট ৫৭টি মামলায় ৫ হাজার ৯২৬ জন জওয়ানের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড হয়। এঁদের মধ্যে ৮৭০ জনকে দেওয়া হয়েছে সাত বছরের কারাদণ্ড। আর বেকসুর খালাস পাওয়া ১১৫ জন চাকরি ফিরে পেয়েছেন। বিচার চলার সময় মারা গেছেন ৫ জন।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, পিলখানা হত্যা মামলায় হাইকোর্ট যে রায় দিয়েছেন, তা পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বড় রায়। কী কী পারিপার্শ্বিকতা ও কী ধরনের প্রেক্ষাপটে ওই ঘটনা ঘটেছে, তার বর্ণনা-বিশ্লেষণ রায়ে স্থান পেয়েছে। উচ্চ আদালতের রায়টি যদি উচ্চপর্যায়ের কর্তৃপক্ষ পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করে দেখে, তাহলে তারা নিজেদের প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনায় অনেক দিকনির্দেশনা খুঁজে পাবে।