রাসায়নিক থেকেই চুড়িহাট্টার আগুন
>• পুরান ঢাকার চকবাজারে ২০ ফেব্রুয়ারি ভয়াবহ আগুন লাগে
• আগুনের ঘটনায় এখন পর্যন্ত অন্তত ৭১ জনের মৃত্যু হয়েছে
• আগুনের ঘটনায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ৬ সদস্যের তদন্ত কমিটি করে
• বুধবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়
রাজধানীর চকবাজারের চুড়িহাট্টায় আগুনের সূত্রপাত রাসায়নিকের গুদাম থেকেই হয়েছিল বলে নিশ্চিত হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি। তাদের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চুড়িহাট্টা মোড়ে কোনো বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার ছিল না। পুড়ে যাওয়া গাড়ির গ্যাস সিলিন্ডার অক্ষত ছিল। বিস্ফোরিত কোনো পিকআপের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। সিলিন্ডার বিস্ফোরণেরও কোনো আলামত পাওয়া যায়নি। আগুন লাগে নন্দকুমার রোডে হাজী ওয়াহেদ ম্যানশনের দোতলার রাসায়নিক গুদাম থেকে।
পুরান ঢাকার চকবাজারে ২০ ফেব্রুয়ারি ভয়াবহ আগুনের পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ৬ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৭১ জনের মৃত্যু হয়েছে। কমিটির আহ্বায়ক মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী গতকাল বুধবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের কাছে প্রতিবেদন জমা দেন।
চুড়িহাট্টার ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয়, বিস্ফোরক পরিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিস, ঢাকা জেলা প্রশাসন ও ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন আলাদা তদন্ত কমিটি করে। বিস্ফোরক পরিদপ্তরও গ্যাস সিলিন্ডার থেকে আগুনের সূত্রপাতের কোনো আলামত পায়নি। ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন বলেছে, ওয়াহেদ ম্যানশনের দোতলায় বৈদ্যুতিক সুইচ অন করার সময় স্ফুলিঙ্গ থেকে বা অসাবধানতাবশত জ্বালানো আগুন
থেকে এই অগ্নিকাণ্ড ঘটে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হাজী ওয়াহেদ ম্যানশনের দোতলায় কী ধরনের রাসায়নিক পদার্থ ছিল, অথবা সুগন্ধির ক্যানগুলোতে কী ধরনের গ্যাসের অস্তিত্ব ছিল, তা বিশেষজ্ঞ দিয়ে ফরেনসিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পরই জানা যাবে। ২৩ পৃষ্ঠার এ প্রতিবেদন ফায়ার সার্ভিস, ঢাকা জেলা প্রশাসনসহ এ–সংক্রান্ত বিভিন্ন কমিটির প্রতিবেদন পর্যালোচনা, প্রত্যক্ষদর্শী, আহত ব্যক্তি ও তাঁদের স্বজন, এলাকাবাসী, চিকিৎসক, উদ্ধারকর্মীর সাক্ষাৎকার, ভিডিও ফুটেজ ও স্থির চিত্র পর্যালোচনা এবং চুড়িহাট্টা এলাকা পরিদর্শন করে তৈরি করা হয়েছে। এ ধরনের অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে প্রতিবেদনে পাঁচটি স্বল্পমেয়াদি সুপারিশ ও ২৬টি দীর্ঘমেয়াদি সুপরিশ করা হয়েছে।
তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা নিশ্চিত হয়েছি, ওয়াহেদ ম্যানশনের দোতলার রাসায়নিক গুদাম থেকে আগুন লেগেছে। বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার বা গাড়ির গ্যাস সিলিন্ডার থেকে আগুনের সূত্রপাতের যে কথা বলা হচ্ছিল, তা সঠিক নয়।’ তিনি বলেন, ‘কমিটির সুপারিশ আমরা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছি। সুপারিশ বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট সংস্থা, ব্যক্তিকে চিঠি দেওয়া হবে। পুরো বিষয়টি আমরা তদারক করব।’
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওয়াহেদ ম্যানশনের দোতলায় প্রচুর পরিমাণে সুগন্ধি ক্যান, লাইটার রিফিল করার ক্যান, কাস্টার অয়েলের ছোট কাচের বোতল ও টিনের ক্যান, নেইলপলিশের বোতল, ছোট ও বড় বাল্বের গুদাম ছিল। দোতলায় কয়েক বস্তা রাসায়নিক পদার্থ ছিল, যা প্রচণ্ড তাপে শক্ত হয়ে গিয়েছিল। এ ছাড়া ভবনের নিচতলায় প্রচুর পরিমাণে রাসায়নিকের মজুত পাওয়া গেছে। কমিটি পুরো পর্যালোচনায় একমত হয়েছে যে আগুনের সূত্রপাত ওয়াহেদ ম্যানশনের দোতলার রাসায়নিক গুদাম থেকেই হয়েছিল।
চুড়িহাট্টার রাজমহল হোটেলের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ ও ঘটনাস্থলের পাশের শেখ হায়দার বক্স লেনের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ পরীক্ষা করেছে তদন্ত কমিটি। ফুটেজ অনুযায়ী, ২০ ফেব্রুয়ারি রাত ১০টা ৩২ মিনিট ২৬ সেকেন্ডে বিস্ফোরণের ঘটনাটি ঘটেছে। বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে সুগন্ধি ক্যানভর্তি কার্টুনসহ ক্যান, আস্ত ইট ও ইটের টুকরো ওপরের দিক থেকে নিচের দিকে ছিটকে পড়ছিল। সঙ্গে ছিল ভয়াবহ আগুন। কমিটির মতে, যদি ওয়াহেদ ম্যানশনের সামনের রাস্তায় গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হতো, তাহলে এই ভবনের দ্বিতীয় তলার পশ্চিম দিকের দেয়াল ভেঙে নিচের দিকে ছিটকে পড়ার কথা নয়।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন থেকে ওয়াহেদ ম্যানশনের ঠিকানায় ১৬টি ট্রেড লাইসেন্স ইস্যু করা হয়েছিল। সিটি করপোরেশন কমিটিকে জানিয়েছে, তারা শুধু দোকান পরিচালনার জন্য লাইসেন্স দিয়েছে। তবে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর ও বিস্ফোরক পরিদপ্তর থেকে তাদেরকে কোনো লাইসেন্স দেওয়া হয়নি।
কমিটির ৩১ দফা সুপারিশ
আগুনের ঘটনা যাতে আর না ঘটে, সে জন্য বিভিন্ন সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি। এতে স্বল্প মেয়াদে অবৈধ, অননুমোদিত বা লাইসেন্সবিহীন রাসায়নিক কারখানা ও গোডাউন ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে প্রচলিত আইন অনুযায়ী সমন্বিত অভিযান পরিচালনা, আবাসিক এলাকায় সব ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ দাহ্য রাসায়নিক ব্যবসার লাইসেন্স না দেওয়া এবং অবিলম্বে পুরান ঢাকার আবাসিক এলাকায় সব ধরনের রাসায়নিক, প্লাস্টিক, পলিথিন, জুতা, নকল ওষুধ, নকল প্রসাধন তৈরির কারখানাসহ অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ দাহ্য রাসায়নিক কারখানা ও গোডাউনের তালিকা করে অতি ঝুঁকিপূর্ণ ও স্বল্প ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করার কথা বলা হয়েছে।
দীর্ঘমেয়াদি সুপারিশে বলা হয়, জরুরি ভিত্তিতে আবাসিক এলাকা থেকে জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর গুদাম বা কারখানা সরিয়ে নেওয়া, স্থানীয় ব্যক্তিদের এসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে ভাড়া না দিতে সচেতন করা, অগ্নিপ্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইন, ২০০৩ ও ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড অনুযায়ী ভবন নির্মাণ নিশ্চিত করা, লাইসেন্সবিহীন কারখানার মালিকদের আইনের আওতায় আনা, ফায়ার সার্ভিসের লাইসেন্স ছাড়া অন্য কোনো সংস্থা লাইসেন্স দেবে না বিষয়টি জানিয়ে নির্দেশ জারি করা, রাসায়নিক কারখানার পাশে বহুতল ভবন নির্মাণ না করা, একই কক্ষে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক মজুত না রাখা, রাসায়নিক ট্রেড লাইসেন্স নবায়নের সময় ফায়ার সার্ভিসের অনাপত্তি নেওয়া, পুরান ঢাকার রাস্তাঘাট প্রশস্ত করা, এসব এলাকায় নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, ব্যর্থতায় ব্যবসার লাইসেন্স বাতিল করা ইত্যাদি।
২০১০ সালের ৪ জুন পুরান ঢাকার নিমতলীতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পরও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ইকবাল খান চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছিল। ওই অগ্নিকাণ্ডে ১২৪ জনের প্রাণহানি হয়। সে সময় তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে এ ধরনের অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে ১৭ দফা সুপারিশ করা হয়েছিল।