মন্তব্য প্রতিবেদন
রাষ্ট্রপতিকে বিব্রত করবেন না
বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ ১৯৯৬–২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকার আমলে রাষ্ট্রপতি ছিলেন। নানামুখী চাপের মুখে তাঁকে কাজ করতে হয়েছে। তৎকালীন বিরোধী দল বিএনপি বিভিন্ন দাবি ও অভিযোগ নিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে যেত। কখনো কখনো রাষ্ট্রপতি কিছু উদ্যোগ বা চেষ্টা নিলেও তাতে কোনো ফল হয়নি। শেষ দিকে বিএনপি আর যেত না। একপর্যায়ে আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গেও রাষ্ট্রপতির দূরত্ব তৈরি হয়।তখনকার প্রেক্ষাপটে ‘রাষ্ট্রপতিকে বিব্রত করবেন না’ শিরোনামে মন্তব্য প্রতিবেদন লিখেছিলেন প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান। ১৯৯৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল। প্রয়াত সাহাবুদ্দীন আহমদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সেই লেখাটি পুনঃপ্রকাশ করা হলো।
দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা নিরসনের একটি উদ্যোগ নেওয়ার জন্য চেম্বার ফেডারেশনের নেতারা রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে অনুরোধ জানাবেন। এ উদ্দেশ্যে আজ তাঁরা রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। একই রকম প্রস্তাব দিয়েছেন গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেন। তাঁরা বলছেন, রাষ্ট্রপতি সরকার ও বিরোধী দলের সঙ্গে কথা বলে দেশকে আসন্ন সংঘাতময় পরিবেশ থেকে মুক্ত করতে পারেন। আসলেই রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ কি কিছু করতে পারেন? কোনো উদ্যোগ নিলে তিনি কি সফল হবেন?
সত্যিকার অর্থে আমরা দেখি যে রাষ্ট্রপতি হিসেবে সাহাবুদ্দীন আহমদের উপস্থিতি দেশের সকল মহলের মধ্যে বিশেষ আশাবাদ সৃষ্টি করেছিল। তিনি দ্রুত বড় বড় জাতীয় ইস্যুতে বলিষ্ঠ অবস্থান নিয়েছিলেন। তিনি কার্যত ‘জাতির বিবেক’ হিসেবে আবির্ভূত হন দেশবাসীর সামনে।
বিগত সময়কালের অভিজ্ঞতায় দেখা যায় যে রাষ্ট্রপতি একাধিকবার সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সমঝোতার প্রচেষ্টা নিয়েছিলেন। সেটা তিনি করেছিলেন একান্ত তাঁর নিজস্ব দায়িত্ববোধ থেকেই। শুধু তা-ই নয়, তিনি প্রথম থেকেই ছাত্ররাজনীতি, শিক্ষায়তনে সন্ত্রাস, রাজনৈতিক সংঘাত ও দলাদলি, ঋণখেলাপি সংস্কৃতি, সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যকার বিদ্যমান অসহিষ্ণুতা সম্পর্কে কড়া সমালোচনামূলক বক্তব্য রেখেছেন। এসব বিষয়ে অনেক পরামর্শ তিনি দিয়েছেন। কোনো কোনো সময় সমঝোতার কিছু উদ্যোগ নিয়েছেন। কিন্তু সরকার বা বিরোধী দল কেউ তাঁর কোনো কথা শোনেনি।
আমরা দেখেছি, বিগত সময়কালে বিএনপি নেতৃত্ব বারবার রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের কাছে তাঁদের দাবি ও অভিযোগের কথা নিয়ে গেছেন। বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক সংকট সমাধানে তাঁর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। কখনো কখনো রাষ্ট্রপতি এ রকম কিছু উদ্যোগ বা চেষ্টা নিয়েছেন। তবে তাতে কোনো ফল হয়নি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বা কোনো কোনো মন্ত্রীর কাছে তিনি বিএনপির অভিযোগগুলো তুলে ধরেছেন। নানা সমস্যা-সংকট সমাধানে যেখানে সরকারের কিছু করণীয় আছে, সেসব তিনি বলেছেন।
ইদানীং দেখা যাচ্ছে যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বা মন্ত্রীরা তেমন আর যান না রাষ্ট্রপতির কাছে। এতে মনে হয় সরকারের সঙ্গে রাষ্ট্রপতির কিছুটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। আজকাল সরকারের কোনো কোনো দায়িত্বশীল নেতার মুখে এমন কথাও শোনা যায় যে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করা ভুল হয়েছে।
সংবিধানের ৪৮ (২) ধারা অনুযায়ী ‘রাষ্ট্রপ্রধান রূপে রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের অন্য সকল ব্যক্তির ঊর্ধ্বে স্থান লাভ করিবেন।’ সংবিধানের ৪৮(৩) ধারা অনুযায়ী, ‘অন্য সকল দায়িত্ব পালনে কেবল প্রধানমন্ত্রীর নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত তাঁহার অন্য সকল দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কার্য করিবেন।’ ১৯৯১ সালে পঞ্চম জাতীয় সংসদে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ মিলে যৌথভাবে সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির অবস্থানের এই হাল করে রেখেছেন। রাষ্ট্রপতির এই অক্ষম অবস্থান জেনেও বিরোধী দলে থাকার সময় কখনো আওয়ামী লীগ এবং কখনো বিএনপি রাষ্ট্রপতির কাছে ধরনা দেন তাঁদেরই সৃষ্ট রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের জন্য, তাঁদের মধ্যে সমঝোতা সৃষ্টির জন্য।
অন্যদিকে, বিএনপি প্রথম দেড়-দুবছর রাষ্ট্রপতির কাছে যেমন যেত নানা অভিযোগ নিয়ে, এখন আর সে রকম যায় না। বিএনপি নেতারা বলেন, রাষ্ট্রপতি কিছু করেন না। তাঁর কাছে গিয়ে আর কী হবে? তিনি যখন কিছু করতে পারেন না, তখন তাঁর পদত্যাগ করা উচিত।
এভাবেই রাষ্ট্রপতি সম্পর্ক সরকার এবং বিরোধী দলের মধ্যে শীতলতা সৃষ্টি হয়েছে। যদিও আমরা জানি যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ সদস্য এবং সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের অনুরোধে অবসরজীবন থেকে ফিরে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ রাষ্ট্রপতির পদ অলংকৃত করতে সম্মত হয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের প্রার্থী হলেও বিএনপি তাঁর বিরোধিতা করেনি, বরং তাঁকে অভিনন্দিত করেছিল। ১৯৯৬ সালের ৯ অক্টোবর সাহাবুদ্দীন আহমদকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়েছিলেন। এ সিদ্ধান্ত সরকারের একটি উজ্জ্বল সিদ্ধান্ত হিসেবে স্বীকৃত হয়েছিল সর্বমহলে।
সত্যিকার অর্থে আমরা দেখি যে রাষ্ট্রপতি হিসেবে সাহাবুদ্দীন আহমদের উপস্থিতি দেশের সকল মহলের মধ্যে বিশেষ আশাবাদ সৃষ্টি করেছিল। তিনি দ্রুত বড় বড় জাতীয় ইস্যুতে বলিষ্ঠ অবস্থান নিয়েছিলেন। তিনি কার্যত ‘জাতির বিবেক’ হিসেবে আবির্ভূত হন দেশবাসীর সামনে। পাশাপাশি এটাও আমরা লক্ষ করি যে রাষ্ট্রপতির কোনো কোনো বক্তব্য বাংলাদেশ টেলিভিশন, রেডিও এবং সরকারি বার্তা সংস্থা সেন্সর করে খণ্ডিতভাবে প্রচার করে। এতে রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ ক্ষুব্ধ হন এবং এসব সরকারি প্রচারমাধ্যমে তিনি তাঁর কার্যক্রমের সংবাদ দেওয়া বন্ধ করে দেন। এ রকম অন্তত দুবার হয়েছিল বলে জানা যায়।
এভাবেই ধীরে ধীরে রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে ঘিরে সমাজের বিভিন্ন স্তরে যে আশাবাদ সৃষ্টি হয়েছিল, সেটা আর তেমন রইল না। কারণ, এটা এখন সকলেই বুঝে গেছে যে রাষ্ট্রপতির প্রবল সদিচ্ছা থাকলেও দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তাঁর তেমন কোনো কিছু করার নেই। আর বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সংবিধানও রাষ্ট্রপতিকে কিছু করার ক্ষমতা দেয়নি। মূলত তাঁর কোনো ক্ষমতা নেই। সংবিধানের ৪৮ (২) ধারা অনুযায়ী ‘রাষ্ট্রপ্রধান রূপে রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের অন্য সকল ব্যক্তির ঊর্ধ্বে স্থান লাভ করিবেন।’ সংবিধানের ৪৮(৩) ধারা অনুযায়ী, ‘অন্য সকল দায়িত্ব পালনে কেবল প্রধানমন্ত্রীর নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত তাঁহার অন্য সকল দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কার্য করিবেন।’ ১৯৯১ সালে পঞ্চম জাতীয় সংসদে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ মিলে যৌথভাবে সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির অবস্থানের এই হাল করে রেখেছেন। রাষ্ট্রপতির এই অক্ষম অবস্থান জেনেও বিরোধী দলে থাকার সময় কখনো আওয়ামী লীগ এবং কখনো বিএনপি রাষ্ট্রপতির কাছে ধরনা দেন তাঁদেরই সৃষ্ট রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের জন্য, তাঁদের মধ্যে সমঝোতা সৃষ্টির জন্য।
এটা করে তাঁরা রাষ্ট্রপতিকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দেন বারবার। কারণ, বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব উভয়েই জানেন যে রাষ্ট্রপতি কিছু করতে পারেন না, তাঁর কোনো ক্ষমতা নেই। এসব জেনে-বুঝেও দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী নেতারা কেন রাষ্ট্রপতির কাছেই আবার যাচ্ছেন, সেটা বোধগম্য নয়। আর ড. কামাল হোসেনও ভালো করেই জানেন যে আমাদের দেশের রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্বকে বুঝিয়ে কেউ সমঝোতায় আনতে পারেননি কোনো দিন। এমনকি কমনওয়েলথ মহাসচিব চিফ এমেকা আনিয়াওকুর প্রতিনিধি স্যার স্টিফেন নিনিয়ান ঢাকায় প্রায় দুমাস অবস্থান করেও বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের মধ্যে কোনো সমঝোতা করতে পারেননি। তবে এটা ঠিক যে আমাদের দেশের প্রধান দুই দলের নেতারা অহরহ ছুটে যান পশ্চিমা কোনো কোনো দেশের দূতদের কাছে। কখনো সফরকারী বিদেশি সরকারপ্রধানের কাছেও ধরনা দেন আমাদেরই প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রীরা। কিন্তু কেউ কোনো দিন সফল হননি কোনো সমঝোতা করতে।
আসলে দেশের সরকার ও বিরোধী দলের রাজনীতিকদের সৃষ্ট রাজনৈতিক সংকট বা অচলাবস্থা দূর করতে হবে সংসদের ভেতরে এবং বাইরে আলোচনার মাধ্যমে। এই সংকটের সমাধান শুধু রাজপথের আন্দোলনের জয়-পরাজয়ে নিষ্পত্তি হওয়ার নয়। দেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংকট যেমন রাজনীতিবিদদের নিজেদের তৈরি, তেমনি সমাধানও তাঁদেরই করতে হবে। অন্য কেউ তা করতে পারবে না। এমনকি রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদও নন। তাহলে তাঁকে বিব্রত করা কেন?