রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আজ রোববার আন্দোলনরত সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে চড়াও হয়েছেন। এ সময় তাঁদের অনেককে গুলি করতে ও ইটপাটকেল ছুড়তে দেখা গেছে। এ সময় পুলিশ রাবার বুলেট, ছররা গুলি ও কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়ে। এতে শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন।
আজ রোববার বেলা সাড়ে ১১টা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ভবনের সামনে ও পরে বেলা দুইটার দিকে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চলে। বিশ্ববিদ্যালয় আগামীকাল সোমবার থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের কাল সকাল আটটার মধ্যে হল ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আজ রোববার সন্ধ্যায় সিন্ডিকেটের জরুরি বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। জনসংযোগ দপ্তরের প্রশাসক ইলিয়াছ হোসেন এ তথ্য জানিয়েছেন। হামলার ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে বলেও জানানো হয়েছে।
আন্দোলনরত সাধারণ শিক্ষার্থীদের অনেকে অভিযোগ করেছেন, প্রশাসন তাঁদের পরীক্ষার ফি বাড়ানোসহ সব সিদ্ধান্ত শিক্ষার্থীদের ওপর চাপিয়ে দিতে ছাত্রলীগকে ব্যবহার করছে। মূলত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের স্বার্থ রক্ষা করতেই ছাত্রলীগ তাঁদের ওপর অস্ত্র নিয়ে চড়াও হয়। তবে অস্ত্রবাজি ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার অভিযোগ অস্বীকার করেছে ছাত্রলীগ।
আহত শিক্ষার্থীদের মধ্যে ২৭ জনকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে কমপক্ষে ১২ জন রাবার বুলেটে আহত হয়েছেন। বিকেল থেকে ক্যাম্পাসে পুলিশের পাশাপাশি র্যাব সদস্যরাও টহল দিচ্ছেন। ক্যাম্পাসের বাইরে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) টহল দিচ্ছে।
হামলা চলাকালে বেলা দুইটার দিকে জনসংযোগ দপ্তরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, পরীক্ষাসহ বিভিন্ন বর্ধিত ফি প্রত্যাহার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। পরে এক সমাবেশে শিক্ষার্থীরা বর্ধিত ফি প্রত্যাহার, সন্ধ্যাকালীন মাস্টার্স কোর্স বন্ধ ও আজকের হামলাকারীদের বিচার দাবিতে আগামীকাল সোমবার থেকে সর্বাত্মক ছাত্র ধর্মঘটের ডাক দিয়েছেন।
যেভাবে হামলা শুরু: বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র, আন্দোলনরত শিক্ষার্থী ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বর্ধিত ফি প্রত্যাহার ও সন্ধ্যাকালীন মাস্টার্স কোর্স বন্ধের দাবিতে আন্দোলনে অনড় শিক্ষার্থীরা আজ সকাল থেকেই ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল করছিলেন। সকাল ১০টার দিকে কয়েক হাজার শিক্ষার্থী প্রশাসনিক ভবন ঘেরাও করে সমাবেশ করতে থাকেন।
এদিকে বর্ধিত ফি বাস্তবায়ন স্থগিত করার বিষয়ে প্রশাসনের ঘোষণায় আজ বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ক্যাম্পাসে আনন্দমিছিল বের করেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। মিছিল নিয়ে তাঁরা প্রশাসনিক ভবনের সামনে যান। একপর্যায়ে আন্দোলনরত সাধারণ শিক্ষার্থীদের সমাবেশের ভেতর তাঁরা ঢুকে পড়েন। ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা-কর্মীর হাতে এ সময় অস্ত্র ছিল বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন। তাঁরা অস্ত্র হাতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর চড়াও হন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। শিক্ষার্থীদেরকে ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা-কর্মী পিস্তল উঁচিয়ে গুলি করেন ও ইটপাটকেল ছোড়েন বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। তাঁরা আরও জানান, ছাত্রলীগ যখন অস্ত্র নিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালাচ্ছিল, তখন পাশে দায়িত্বরত পুলিশের সদস্যরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের দিকে রাবার বুলেট ও কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়েন। আতঙ্কিত শিক্ষার্থীরা সবাই নিজেদের জীবন বাঁচাতে ছোটাছুটি শুরু করে দেন। পুলিশের গুলি খেয়ে আহত হয়ে পড়ে থাকেন অনেকেই। কেউ কেউ দৌড়াতে গিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। কান্না, চিত্কার, গুলি, ককটেল—সবকিছু মিলিয়ে ভয়ংকর হয়ে ওঠে পরিবেশ।
অস্ত্র উঁচিয়ে ছাত্রলীগের ধাওয়া: হামলার একপর্যায়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের একটি অংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের ভেতরে অবস্থান নেন। বাকি শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসের বিভিন্ন জায়গায় ছোটাছুটি শুরু করেন। প্রত্যক্ষদর্শী শিক্ষার্থীরা জানান, মূল হামলার পর ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা পিস্তল উঁচিয়ে শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাসের বিভিন্ন দিকে ধাওয়া দিতে শুরু করেন। তাঁরা ক্যাম্পাসে ফাঁকা গুলি ছুড়তে থাকেন। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি ফয়সাল আহমেদ, পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক মোস্তাকিম বিল্লাহ ও সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সুদীপ্ত সালামকে অস্ত্র উঁচিয়ে গুলি ছুঁড়তে দেখা যায় বলে জানান প্রত্যক্ষদর্শীরা।
পরে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনের টুকিটাকি চত্বরে অবস্থান নেন। সেখানে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করে তাঁরা কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের পেছনে অবস্থান করেন। বেলা দুইটা পর্যন্ত তারা সেখানে অবস্থান করার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে ফিরে যান।
আহত হলেন যাঁরা: ছাত্রলীগ ও পুলিশের হামলায় আন্দোলনরত শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হন। এ ঘটনায় আহত অবস্থায় ২৭ জনকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (রামেক) ভর্তি করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে কমপক্ষে ১২জন রাবার বুলেটে বিদ্ধ হয়েছেন। আহত শিক্ষার্থীদের মধ্যে রয়েছেন গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মাহফুজা মায়া, দ্বিতীয় বর্ষের রাজিব, মাস্টার্সের রুবেল পারভেজ, আইন বিভাগের তারিন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের তৌহিদ। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যাঁরা ভর্তি হয়েছেন তাঁরা হলেন জাহিদ, অসিত, রশিদ, আবু সুফিয়ান, পরাগ, রবিউল ইসলাম, রাখি, মৌসুমী, লতিফ, নজরুল, সাজু, সোহেল, হাসিবুর ও আশিক। বাকি শিক্ষার্থীদের নাম জানা যায়নি। আহত অনেক শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয় চিকিত্সাকেন্দ্র থেকে প্রাথমিক চিকিত্সা নিয়েছেন।
ছাত্রদের হলে হলে বিক্ষোভ, পুলিশের বাধা: শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের সশস্ত্র হামলার খবর পেয়ে হলের আবাসিক শিক্ষার্থীরাও বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। তাঁরা হলের মধ্যেই বিক্ষোভ শুরু করেন। একপর্যায়ে মাদার বখশ হল ও সোহরাওয়ার্দী হল থেকে শিক্ষার্থীরা বের হতে শুরু করলে পুলিশ তাঁদের বাধা দেয়। পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়ে শিক্ষার্থীদের হলের মধ্যে আটকে রাখে।
ফের হামলা: প্রথম দফা হামলার পরে বেলা দুইটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাদার বখশ, সোহরাওয়ার্দী, শামসুজ্জোহাসহ কয়েকটি হলের শিক্ষার্থীরা সংগঠিত হয়ে আবারও বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে ক্যাম্পাসের দিকে যেতে শুরু করেন। তাঁদের মিছিলটি কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে গেলে পুলিশ আবারও রাবার বুলেট ও কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়ে সবাইকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এ সময় রাবার বুলেটে আহত সাতজন শিক্ষার্থীকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
ক্যাম্পাসে ভাঙচুর : দ্বিতীয় দফায় হামলার ঘটনার পর শিক্ষার্থীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। তাঁরা ক্যাম্পাসের বিভিন্ন প্রশাসনিক ভবনের জানালার কাচ ভাঙচুর করেন। শিক্ষার্থীরা দ্বিতীয় বিজ্ঞান ভবনের সামনে শিক্ষকদের দুটি গাড়ি ভাঙচুর করেন। একই সময়ে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা রবীন্দ্র কলা ভবনের বিভিন্ন জানালার কাচ ভাঙচুর করেন। এ ছাড়াও ভবনের বিভিন্ন অংশে তাঁরা ভাঙচুর চালান। বেলা আড়াইটার দিকে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের জুবেরী ভবনে (শিক্ষকদের আবাসিক ভবন) ভাঙচুর চালান। ভবনে উপস্থিত থাকা শিক্ষকেরা জানান, শিক্ষার্থীরা ভবনের নিচতলার বিভিন্ন কক্ষে ভাঙচুর চালান। তাঁরা ভবনের সামনে থাকা একটি প্রাইভেট কারও ভাঙচুর করেন। এর পাশাপাশি দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলার জানালা লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোড়েন তাঁরা। এ সময় ভবনে থাকা শিক্ষক ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। পরে শিক্ষার্থীরা আবার কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে গিয়ে সমাবেশ করেন। এ সময় পুলিশ কোনো বাধা দেয়নি। সমাবেশের পরে শিক্ষার্থীরা হলে ফিরে যান। সমাবেশ শেষে শিক্ষার্থীরা বর্ধিত ফি প্রত্যাহার, সন্ধ্যাকালীন মাস্টার্স কোর্স বন্ধ ও আজকের হামলাকারীদের বিচার দাবিতে আগামীকাল সোমবার থেকে সর্বাত্মক ছাত্র ধর্মঘটের ডাক দেন।
হামলার শিকার সাংবাদিকেরাও: হামলার পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত সাংবাদিকেরা নগর পুলিশের উপকমিশনার প্রলয় চিসিমের কাছে বক্তব্য জানতে চান। এ সময় তিনি বক্তব্য দেবেন না বলে জানান। একপর্যায়ে তাঁর সঙ্গে থাকা পুলিশের সদস্যরা সাংবাদিকদের লাঠিপেটা করেন ও রাবার বুলেট ছোড়েন। এতে ঢাকা ট্রিবিউনের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি নাজিম মৃধা ও শীর্ষ নিউজের প্রতিনিধি জাকির হোসেনসহ পাঁচজন সাংবাদিক আহত হন। বিশ্ববিদ্যালয় চিকিত্সাকেন্দ্রে আহত শিক্ষার্থীদের ছবি তুলতে গেলে মারধর করা হয়েছে আরও তিন সাংবাদিককে। তাঁরা হলেন স্থানীয় দৈনিক নতুন প্রভাত-এর ফটোসাংবাদিক গুলজার জুয়েল, সোনার দেশ-এর ফটোসাংবাদিক সামস রুমি, ফ্ল্যাশনিউজ-এর ফটোসাংবাদিক স্পর্শ দীপ।
অবশেষে বর্ধিত ফি প্রত্যাহার: শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগ ও পুলিশের হামলার পরে বেলা দুইটার দিকে জনসংযোগ দপ্তরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, পরীক্ষাসহ বিভিন্ন বর্ধিত ফি প্রত্যাহার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
পুলিশের বক্তব্য: প্রথমে ঘটনা সম্পর্কে বক্তব্য দিতে না চাইলেও পরে ক্যাম্পাসে দায়িত্বরত রাজশাহী মহানগর পুলিশের উপকমিশনার প্রলয় চিসিম সাংবাদিকদের বলেন, ‘কয়েক দিন থেকে শিক্ষার্থীরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করে আসছিলেন। কিন্তু আজ ছাত্রলীগের সঙ্গে তাঁরা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়লে পুলিশ আইনশৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে ব্যবস্থা নিয়েছে।
অস্ত্র নিয়ে হামলার কথা অস্বীকার করল ছাত্রলীগ: বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তৌহিদ আল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা মিছিল নিয়ে যাওয়ার সময় মিছিলের পেছন দিকে সমাবেশ থেকে ককটেল হামলা চালানো হয়। এতে উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে পুলিশ সবাইকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়।’ ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের পিস্তল উঁচিয়ে গুলি করার বিষয়ে তৌহিদ বলেন, ‘ক্যাম্পাসে কোনো ছাত্রলীগ নেতা-কর্মী অস্ত্র ব্যবহার করেননি।’
জরুরি সিন্ডিকেট: বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য অধ্যাপক চৌধুরী সারওয়ার জাহান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সন্ধ্যা সাতটায় জরুরি সিন্ডিকেট ডাকা হয়েছে। তার পরই ঘটনা সম্পর্কে প্রশাসন তাঁদের বক্তব্য জানাবেন।’
মঙ্গলবার থেকে চলছে আন্দোলন: বর্ধিত ফি প্রত্যাহার ও সন্ধ্যাকালীন মাস্টার্স কোর্স বন্ধের দাবিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা গত মঙ্গলবার থেকে ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করে আসছিলেন। দাবি আদায়ে গত বৃহস্পতিবার থেকে ‘বর্ধিত ফি ও বাণিজ্যিক সান্ধ্য কোর্সবিরোধী’ শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ব্যানারে তাঁরা ক্যাম্পাসে ধর্মঘট পালন করছিলেন। শ�