নারী নির্যাতনের ঘটনা দেশে এখন অন্যতম আলোচিত বিষয়। এই ঘটনাগুলো কেবল ইদানীং ঘটছে, তা নয়। অনেক আগে থেকেই ঘটনাগুলো ঘটে আসছে। অনেক ঘটনা চাপা পড়ে যায়, সামনে আসে না। এখন এই ঘটনাগুলো উন্মোচিত হচ্ছে।
সম্প্রতি ধর্ষণ, নারীর প্রতি সহিংসতা ও নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পেয়েছে। এর পেছনে কয়েকটি কারণ রয়েছে বলে মনে হয়। একটি হলো করোনা মহামারি। মানুষ অনেক দিন ঘরে বন্দী রয়েছে। মানুষের স্বাভাবিক কাজ না থাকলে রিপুর তাড়না প্রবল হয়। সবাই এই তাড়না নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। এমন পরিস্থিতিতে এ ধরনের অপরাধ বৃদ্ধি পায়।
আমরা যে পুঁজিবাদী সমাজে বাস করছি, সেখানে যাদের ক্ষমতা আছে, তারা ক্ষমতা প্রয়োগ করে ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যায়। নৈতিকতার অবক্ষয় যে নেই, তা নয়; তবে রাজনৈতিক প্রভাব এ ক্ষেত্রে প্রধান। অপরাধীরা মনে করে, রাজনৈতিক প্রভাব ও প্রশ্রয়ের সুযোগ নিয়ে পার পেয়ে যাবে। তাদের কিছু হবে না। এই ভাবনা তাদের বেপরোয়া করে তোলে।
অন্য আরেকটি কারণ হলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা আগের মতো নেই। তাদের একাংশ অন্য কাজে মনোযোগী থাকে; কক্সবাজারে মেজর (অব.) সিনহার হত্যার পর তা আরও স্পষ্ট হয়েছে।
নারীর প্রতি সহিংসতা, ধর্ষণ; এসবের প্রতিকারের উপায়ের কথা ভাবলে প্রথমেই আসে অপরাধীদের কঠিন শাস্তি নিশ্চিত করার বিষয়টি। প্রকাশ্যে শাস্তি দিতে হবে বা শাস্তি দেওয়ার বিষয়টি ব্যাপকভাবে জানাতে হবে। সবাই যদি শাস্তি কার্যকর করার ঘটনা জানতে পারে, তবে সামাজিকভাবে এর প্রভাব সৃষ্টি হবে। সবাই বুঝবে এ ধরনের কাজ করলে কঠিন শাস্তি রয়েছে, তা আর এড়ানো যাবে না।
তা ছাড়া ধর্ষণ বা নারী নির্যাতনের মামলাগুলো এমনভাবে পরিচালিত হয় যে অনেক ক্ষেত্রে অভিযোগকারীই দোষী পরিগণিত হয়। তাদের নানাভাবে দোষ দেওয়া হতে থাকে, সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন করা হয়, বদনাম ছড়ানো হয়। সব মিলিয়ে যে নারী সহিংসতার শিকার হলেন, তাঁর প্রতি একটা ঘৃণার পরিবেশ তৈরি করা হয়। এ কারণে নির্যাতনের শিকার অনেকেই মুখ খুলতে চান না, আইনের আশ্রয় নিতে চান না। সমাজের এই বর্বর মানসিকতা পরিবর্তনের জন্য আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। এই সামাজিক আন্দোলন দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ হিসেবে সরকার ও বিরোধী সব রাজনৈতিক দলকে মাঠপর্যায়ে নেমে প্রতিবাদ–প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। সাধারণ মানুষ পথে নেমেছে। কিন্তু সরকার বা বিরোধী দলকে আমরা এখনো সেভাবে প্রতিবাদ–প্রতিরোধে সোচ্চার দেখছি না। তরুণেরা এগিয়ে এসেছেন, এটা আশার কথা।
পাশাপাশি সুস্থ বিনোদন এবং সুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চার ক্ষেত্র সৃষ্টি করতে হবে। এতে মানুষের ভেতর মানবিক মূল্যবোধের বিকাশ ঘটবে, নারীদের প্রতি মনোভাবের পরিবর্তন আসবে।
তবে মোদ্দা কথা হচ্ছে, এই ভোগসর্বস্ব পুঁজিবাদী সমাজের পরিবর্তন করতে হবে। এই সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পিতৃতান্ত্রিক। এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে। নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে পুরুষ কী ভূমিকা নেবে, বিষয়টি তা নয়। এটি আসলে নারী বা পুরুষের বলে আলাদা কোনো বিষয় নয়। এটি সবার বিষয়, এটি একটি মানবিক কর্ম। সবাই মিলেই এটি করতে হবে। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যম একটি বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। এ ধরনের সহিংসতা–বর্বরতার ঘটনাগুলো সামনে তুলে ধরতে হবে। ঘটনাগুলো আড়াল থেকে যত সামনে আসবে, তত বেশি জনমতের সৃষ্টি হবে। সমাজবদলের আন্দোলনকে তা আরও বেগবান করে তুলবে।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়