রবীন্দ্রনাথের শ্রীভূমি বনাম লিন্ডসের এডিনবরা

স্বাধীনতার ৫০ বছরে রাজধানী ঢাকা যেমন বড় হয়েছে, তেমনি সম্প্রসারিত হয়েছে দেশের পুরোনো শহরগুলোও। বড় শহরের পরিবর্তন ও বাসযোগ্যতা নিয়ে ধারাবাহিক আয়োজন।

পর্যটননগরী সিলেটকে দুই ভাগ করেছে সুরমা নদী। সুরমার ওপর ব্রিটিশ আমলে নির্মিত কিনব্রিজ। সেখানে আসেন পর্যটকেরা।ছবি : আনিস মাহমুদ

স্কটল্যান্ডের নাগরিক রবার্ট লিন্ডসে ১৭৭৮ থেকে ১৭৯০ সাল পর্যন্ত সিলেটের কালেক্টর পদে দায়িত্ব পালন করেন। আত্মজীবনী ওরিয়েন্টাল মিসচেলানিজ: এনেকডোট অব ইন্ডিয়ান লাইফ–এ তিনি সিলেট নিয়ে লিখেছেন, ‘শহর তখন ছোটখাটো বাজারমাত্র ছিল। অধিবাসীদের গৃহ ছিল পাহাড়ের ওপর অবস্থিত ও বনজঙ্গলের আড়ালে ঢাকা।’

লিন্ডসের দেখা সেই ‘ছোটখাটো বাজার’ ঠিক এক শ বছর পর (১৮৭৮ সালে) পৌরসভায় রূপান্তরিত হয়। এর ১২৪ বছর পর ২০০২ সালে পৌরসভাটি সিটি করপোরেশনে উন্নীত হয়। এই রূপান্তরে সিলেট বড় হয়েছে, এর উন্নয়ন হয়েছে নানাভাবে; কিন্তু অনেকটাই হারিয়ে গেছে লিন্ডসের দেখা পাহাড় আর বন।

* সিলেট নগরের আয়তন ২৬ দশমিক ৫০ বর্গকিলোমিটার
* জনসংখ্যা প্রায় ৮ লাখ
* ১৮৭৮ সালে পৌরসভা হয়, ২০০২ সালে সিটি করপোরেশন
* বাড়ির সংখ্যা প্রায় ৭৫ হাজার

সিলেটে এখন চারদিকে কেবল চাকচিক্যময় বহুতল ভবন ও বিপণিবিতান। শহর ও শহরতলির মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া স্রোতস্বিনী ছড়া দখল ও সংকোচনে মৃতপ্রায়। দিঘি ও পুকুর ভরাট হয়ে গড়ে উঠছে সুউচ্চ দালান। হারিয়ে গেছে শিশুদের খেলার জায়গা। দ্রুত বড় হতে থাকা শহরে রাস্তাঘাট সরু ও ভাঙাচোরা। যানজট, মশার উপদ্রব ও পানির তীব্র সংকটে নগরবাসী নাকাল।

সিলেট দেশের আটটি বিভাগীয় শহরের একটি। দেশের দীর্ঘতম নদী সুরমার উত্তর পারে প্রায় ৭০০ বছর আগে এ শহরের যাত্রা শুরু হয়। সম্প্রসারিত হওয়ার পর মূল শহর এখন দুই ভাগে বিভক্ত—উত্তর ও দক্ষিণ। উত্তরের শহরতলিতে রয়েছে সারি সারি টিলা, পাহাড় ও চা-বাগান। দক্ষিণেও সবুজ কিছু কিছু টিকে আছে। শহর থেকে একটু দূরে হাকালুকি হাওর। সব মিলিয়ে দেশের বাকি বিভাগীয় শহরের চেয়ে সিলেট আলাদা। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই অঞ্চলকে বলেছিলেন ‘সুন্দরী শ্রীভূমি’। তবে পরিকল্পনাহীন নগরায়ণ সুন্দরী শ্রীভূমির সৌন্দর্যটাই নষ্ট করে শহরকে করছে প্রাণহীন, বিবর্ণ ও পাংশুটে।

শহরকে বড় করার যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সেটি পরিকল্পিত হবে। নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করা হবে। এর বাইরে মূল শহরের সমস্যাগুলো দূর করার কাজ চলছে। নগরে অবশিষ্ট থাকা দিঘি, পুকুর, পাহাড় ও টিলা সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
আরিফুল হক চৌধুরী, সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র

সিলেটের শ্রী হারানোর শুরু মোটামুটি দুই দশক আগে। প্রবীণ ব্যক্তিরা বলছেন, চলতি শতাব্দীর শুরুর দিকেও সিলেট শহরে খোলামেলা পরিবেশ ছিল। মানুষের বসতিও ছিল বর্তমান জনসংখ্যার ৪ ভাগের ১ ভাগ। কিন্তু সিটি করপোরেশন প্রতিষ্ঠার পরপরই বদলে যেতে থাকে পুরো শহর। মানুষ বাড়তে থাকে। পাড়া-মহল্লায় তৈরি হতে থাকে বহুতল ভবন ও বস্তি। সে তুলনায় নাগরিক সুবিধা কমই বেড়েছে।

সিলেট শহরের প্রবীণ নাগরিকদের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও লেখক তুষার করের আক্ষেপ, সিলেটে পাহাড় ও টিলা কেটে এবং শহরের প্রাণ জলাশয়গুলো ভরাট করে বহুতল ভবন ও ঘরবাড়ি নির্মিত হচ্ছে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, চাকচিক্য বাড়লেও সবখানেই অপরিকল্পিত নগরায়ণের ছাপ সুস্পষ্ট। তাই শহরে যেন আর প্রাণ নেই।

একনজরে সিলেট

১৮৭৮ সালে সিলেট যখন পৌরসভা হিসেবে যাত্রা শুরু করে, তখন আয়তন ছিল পৌনে ২ কিলোমিটারের মতো। এখন শহরের আয়তন সাড়ে ২৬ বর্গকিলোমিটার। তবে সিটি করপোরেশন ২০১৪ সালে নগরের পরিধি আরও বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়। এ বিষয়ে গত বছর এক গণবিজ্ঞপ্তিতে সিটি করপোরেশন এলাকা ৫৭ কিলোমিটারে উন্নীত করার প্রাথমিক সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়।

চা–বাগান মোড়ানো সিলেট বিমানবন্দর সড়ক
ছবি : আনিস মাহমুদ

সিলেট শহরে এখন প্রায় আট লাখ মানুষ বাস করে। বাড়ির সংখ্যা প্রায় ৭৫ হাজার। পরিকল্পিত এলাকা খুব কম। বেশির ভাগ এলাকায় বাড়ি নির্মাণে কোনো জায়গা ছাড়া হয়নি। ফলে এলাকাগুলো ঘিঞ্জি হয়ে গেছে। ঢাকার অভিজাত এলাকা যেমন গুলশান–বনানী, তেমনি সিলেটে ধনীদের বাস শাহজালাল উপশহর ও হাউজিং এস্টেট এলাকায়। মধ্যম আয়ের মানুষ সব এলাকায় রয়েছে। তবে নিম্নবিত্তদের বাস রেলস্টেশনসহ বিভিন্ন এলাকার বস্তিতে।

সিলেট প্রবাসী–অধ্যুষিত শহর। দেশের যে কয়টি শহরে দরিদ্র মানুষ কম বসবাস করে, তাদের মধ্যে সিলেট একটি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, সিলেট জেলায় দারিদ্র্যের হার ১৩ শতাংশ, যা দেশের সার্বিক দারিদ্র্যের হারের অর্ধেকের মতো।
সিলেটের জন্য মহাপরিকল্পনা তৈরি হয় ২০১১ সালে। তবে সে অনুযায়ী শহরকে গড়ে তোলার বিশেষ তাগিদ দেখা যায় না। করপোরেশনের নজর সম্প্রসারণ পরিকল্পনার দিকে। সিলেট সিটির মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘শহরকে বড় করার যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সেটি পরিকল্পিত হবে। নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করা হবে। এর বাইরে মূল শহরের সমস্যাগুলো দূর করার কাজ চলছে। নগরে অবশিষ্ট থাকা দিঘি, পুকুর, পাহাড় ও টিলা সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’

নগরের সুবিধা, নাগরিকের ভোগান্তি

সিলেট শহরের বড় সমস্যা ভাঙাচোরা রাস্তাঘাট। সিটি করপোরেশনের হিসাবে, শহরের ২০ শতাংশ সড়কেই খানাখন্দ। অনেক সড়কে সড়কবাতি নেই। সরু রাস্তাঘাট ও ঘিঞ্জি এলাকার কারণে অনেক জায়গায় জরুরি প্রয়োজনে অ্যাম্বুলেন্স কিংবা ফায়ার সার্ভিসের যানবাহন ঢুকতে পারে না।

সিলেট নগরের কবি নজরুল চত্বর।
ছবি: আনিস মাহমুদ

শহরে জলাবদ্ধতার সমস্যা অনেকটা দূর হয়েছে। তবে কিছু এলাকার মানুষকে এখনো বর্ষাকালে এ সমস্যায় ভুগতে হয়। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, মশার উৎপাত থাকে বছরজুড়ে। অনেক এলাকায় রয়েছে পানির তীব্র সংকট। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বাগবাড়ি, ঝরনারপাড় ও বারুতখানা।

সিটি করপোরেশনের পানি সরবরাহ শাখার নির্বাহী প্রকৌশলী আলী আকবর বলেন, নগরে দিনে পানির চাহিদা আট কোটি লিটার। সিটি করপোরেশন সরবরাহ করতে পারে সাড়ে চার কোটি লিটারের মতো। অবশ্য পাঁচ কোটি লিটার পানি শোধনের ক্ষমতাসম্পন্ন একটি শোধনাগার প্রকল্প মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।

সিটি করপোরেশন জানিয়েছে, নগরে দিনে প্রায় ৩২০ মেট্রিক টন বর্জ্য উত্পাদিত হয়। পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা এসব গৃহস্থালি ময়লা ও শহরের আবর্জনা পরিষ্কার করেন। তবে অভিযোগ আছে, শুধু গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোতে নিয়মিত ময়লা-আবর্জনা অপসারণ কার্যক্রম চালানো হয়। অনেক এলাকায় তা নিয়মিত নয়।

সিলেটে বঙ্গবন্ধু হাইটেক পার্ক ও নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা এবং সিলেট থেকে সরাসরি লন্ডন ও মধ্যপ্রাচ্যে ফ্লাইট চালু—এসব কারণে অনেক ধরনের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
আবু তাহের মো. শোয়েব, সিলেট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি

সিলেট শহরে দিন দিন যানবাহনের সংখ্যা বাড়ছে, বাড়ছে যানজট। ধনী পরিবারগুলো নিজস্ব গাড়ি কিনছে। ফলে ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যাপকভাবে বাড়ছে। সঙ্গে মোটরসাইকেল। তবে নগর ও শহরতলির অভ্যন্তরে সাধারণ মানুষের জন্য সহজলভ্য এবং পছন্দের বাহন রিকশা ও সিএনজিচালিত অটোরিকশা। যানবাহন বাড়লেও কয়েকটি সড়ক ছাড়া বাকি রাস্তা অপ্রশস্ত। কর্তৃপক্ষের যানবাহনের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের কোনো উদ্যোগ নেই।
যানজটের একটি বড় কারণ অবৈধ স্ট্যান্ড। শহরে অন্তত ৪৬টি স্থানে ট্রাক, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, মাইক্রো এবং ব্যাটারিচালিত টমটমের অবৈধ স্ট্যান্ড রয়েছে। বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় এসব উচ্ছেদেও ব্যবস্থা নিতে পারছে না সিটি করপোরেশন। কিন্তু এসব অবৈধ স্ট্যান্ড মানুষের ভোগান্তি বাড়াচ্ছে।

দিঘি ভরাট, মাঠও বিলীন

সিলেট শহরটি একসময় দিঘি ও পুকুরের শহর হিসেবে পরিচিত ছিল। সাগরদিঘিরপাড়, লালদিঘিরপাড়, রামেরদিঘিরপাড়, ধোপাদিঘিরপাড়, মাছুদিঘিরপাড় ও বিলপাড়—বিভিন্ন এলাকার নামগুলো সেই প্রমাণই বহন করে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, দুই দশকে শহরের অন্তত ৬০টি পুকুর ও দিঘি ভরাট হয়ে গেছে। টিকে আছে ২৩টি।
নগরের দাড়িয়াপাড়া এলাকার বাসিন্দা ধ্রুব গৌতম বলেন, দুই দশক আগেও তাঁদের এলাকায় ১৫ থেকে ২০টি পুকুর ছিল। এখন একটিও নেই।

সিলেটে নগরের দিঘীগুলো ভরাট হয়ে যাচ্ছে। সিলেট নগরের মজুমদারবাড়ি দিঘী এলাকায়।
ছবি: আনিস মাহমুদ

শিশু–কিশোরদের খেলার মাঠও দিন দিন কমে যাচ্ছে। সিটি করপোরেশন জানিয়েছে, নগরে এখন তিনটি খেলার মাঠ অবশিষ্ট রয়েছে। তবে নতুন করে প্রস্তুতের চেষ্টা চলছে আরও তিনটির। নগরের শাহি ঈদগাহ এলাকায় সদর উপজেলার খেলার মাঠটিতে বছরজুড়ে নানা ধরনের মেলা লেগে থাকে। সেখানে খেলাধুলা করতে পারে না শিশু–কিশোরেরা।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আবদুল করিম চৌধুরী বলেন, দুই দশক আগেও নগরে ব্যক্তিমালিকানাধীন অনেক জমি ফাঁকা ছিল। সেসব জায়গায় শিশু-কিশোরেরা খেলতে পারত। এখন সেসব জায়গায় ভবন উঠে গেছে। খেলার জায়গা না থাকায় শিশু-কিশোরেরা মুঠোফোন নিয়ে পড়ে থাকে।


শিক্ষা–স্বাস্থ্য–বিনোদন

বাসিন্দারা বলছেন, সিলেট শহরে গত দুই দশকে উচ্চশিক্ষা ও চিকিৎসার সুযোগ বেড়েছে। সব মিলিয়ে নগরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে ৮৬টি, আর হাসপাতাল ও ক্লিনিক রয়েছে ৪১টি। ধনীরা ছাড়া বেশির ভাগ মানুষ সিলেটেই চিকিৎসা নেন, রাজধানীমুখী হন না। তবে সারা দেশে শিক্ষার মান নিয়ে যে প্রশ্ন, সিলেট তার বাইরে নয়।
তবে সিলেটে সংস্কৃতিচর্চা এখনো দাপটের সঙ্গে টিকে আছে। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সিলেট বিভাগীয় প্রতিনিধি শামসুল আলম জানান, নগর এবং কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক অন্তত দেড় শ সাংস্কৃতিক সংগঠন রয়েছে। আশার কথা হচ্ছে, এখনো তরুণেরা সংস্কৃতিচর্চায় থাকছেন। গান-নৃত্য-আবৃত্তি-অভিনয়ে মুখর করছেন মঞ্চ। অবশ্য বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সিনেমা হলগুলো। দেড় দশক আগেও সিলেটে ছয়টি সিনেমা হল ছিল। এখন নন্দিতা সিনেমা হলটিই কেবল টিকে আছে।

ব্যবসার পসার বেড়েছে

ব্যবসায়ীরা বলছেন, তিনটি কারণে সিলেটে ব্যবসা ও বিনিয়োগ সম্ভাবনা ভালো। প্রথমত, সিলেটের মানুষের মাথাপিছু আয় বেশি। স্থানীয় বাজারের পাশাপাশি ভারতের সাত রাজ্যে পণ্য রপ্তানির সুযোগও রয়েছে। দ্বিতীয়ত, বিনিয়োগের জন্য গ্যাস রয়েছে। অন্যান্য খনিজ সম্পদ ও চা-বাগানকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড রয়েছে। তৃতীয়ত, পুরো সিলেট বিভাগে পর্যটনের বড় সম্ভাবনা রয়েছে।

সিলেট শহর
ছবি : আনিস মাহমুদ

সব মিলিয়ে সিলেট ঘিরে ব্যবসা–বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়ছে। শুধু স্থানীয় ব্যক্তিরা নন, অন্যান্য জেলার ব্যবসায়ীরাও সেখানে গিয়ে ব্যবসা করছেন। প্রবাসীদের অনেকে সিলেটে বিনিয়োগ করতে চান।

সিলেট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আবু তাহের মো. শোয়েব বলেন, ‘সিলেটে বঙ্গবন্ধু হাইটেক পার্ক ও নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা এবং সিলেট থেকে সরাসরি লন্ডন ও মধ্যপ্রাচ্যে ফ্লাইট চালু—এসব কারণে অনেক ধরনের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।’

‘এখনো সুযোগ আছে’

রবার্ট লিন্ডসের দেশ স্কটল্যান্ডের রাজধানী এডিনবরার সঙ্গে সিলেটের একটা দিক দিয়ে মিল আছে। এডিনবরা পাহাড়ি শহর, সিলেটও তাই। যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ গবেষণা সংস্থা নাইট ফ্রাঙ্কের ‘সিটি ওয়েলবিং ইনডেক্স–২০২০’ অনুযায়ী, এডিনবরা বিশ্বের সেরা ২০টি শহরের একটি। এ সূচকে জীবনযাত্রার মান, শহরে সবুজ কতটুকু ইত্যাদি বিবেচনায় নেওয়া হয়।

সিলেট বিশ্বের না হোক, অন্তত এই অঞ্চলের সেরা একটি শহর কি হতে পারত? স্থপতি রাজন দাশ প্রথম আলোকে বলেন, শহরকে পরিকল্পিত করার সুযোগ এখনো আছে। কিছুদিন পর চাইলে হয়তো সেটা আর করা যাবে না।

অভিমত: উদ্যোগ না নিলে সিলেটের পরিণতিও ঢাকার মতো হবে

সিলেট দেশের পুরোনো শহরের একটি। কত ইতিহাস, কত ঐতিহ্য ও কত বৈচিত্র্য এ শহরের। সৃজনশীলতা দিয়ে শহরটিকে বাসযোগ্য ও আনন্দময় শহরে রূপ দিতে হবে। সিলেটের পর্যটনকেন্দ্রিক অপার সম্ভাবনা রয়েছে। এখানকার মণিপুরি ঐতিহ্য অন্য শহরে নেই। সিলেটে নির্মিত পুরোনো আসামটাইপ-জাতীয় বাড়িঘর চিহ্নিত করে রক্ষণাবেক্ষণ করা যেতে পারে।

স্থপতি জেরিনা হোসেন, সভাপতি, বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউট, সিলেট শাখা

শহরের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ঐতিহ্য-সংস্কৃতি-ইতিহাস সংরক্ষণের উদ্যোগ নিতে হবে। পর্যটক এলে কীভাবে ঐতিহ্য উপভোগ করবেন, এটা বিবেচনায় নিয়ে শহরকে পরিকল্পিতভাবে গড়ে তুলতে হবে। এসব বিষয় ছাড়াও বাসা-বাড়ি-রাস্তাঘাট নির্মাণসহ যাবতীয় উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রেও পরিকল্পনামাফিক অগ্রসর হতে হবে।

সিলেট শহরকে পরিকল্পিতভাবে গড়ে তুলতে হলে কয়েকটি বিষয় প্রথমেই বিবেচনায় রাখতে হবে। সেটা হচ্ছে, নগরে হাঁটাচলার জন্য সুপরিসর ফুটপাত ও উন্মুক্ত স্থান থাকতে হবে। এখন রাস্তা ঘেঁষে বহুতল বিপণি ও ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে, এটা করা যাবে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভবন নির্মাণের নীতিমালা মানা হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে কঠোরতা দেখাতে হবে সিটি করপোরেশনকে। অপরিসর ও সরু রাস্তাঘাট প্রশস্ত করতে উদ্যোগ নিতে হবে। রিকশা, সিএনজিচালিত অটোরিকশা আর ব্যক্তিগত গাড়ি চলাচল করলেই হবে না, গণপরিবহন চলাচলের সুযোগও তৈরি করতে হবে। চারপাশে এক ইঞ্চিও জায়গা না রেখে, গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা না রেখেই অনেক বাসাবাড়ি ও বিপণিবিতান হচ্ছে। বিশাল ভবন হচ্ছে, অথচ রাস্তা-ফুটপাত সে অনুযায়ী হচ্ছে না, এটা অপরিকল্পিত।

সিলেট শহরের পুকুর-দিঘি-টিলা হারিয়ে যাচ্ছে। এগুলো অক্ষত রেখেও উন্নয়ন সম্ভব। প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের কারণেই সিলেট একটা অনন্য শহর হতে পারত। এখনো অবশ্য পরিকল্পনামাফিক আদর্শ শহর তৈরির সুযোগ আছে। উদ্যোগ না নিলে সিলেটের পরিণতিও ঢাকার মতো হবে।