রক্ত দেওয়া বাবাহারা ছেলেটি নিজেই ভেসে গেলেন রক্তে

রক্তমাখা স্কেচে মাহমুদ হাবিবকে স্মরণ করছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক–শিক্ষার্থীরাছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

মাহমুদ হাবিব। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাফিক ডিজাইন, কারুশিল্প ও শিল্পকলার ইতিহাস বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। মঙ্গলবার রাত পৌনে নয়টার পর থেকে শারীরিক বিচারে তিনি অতীত। ক্যাম্পাসের ভেতরে ট্রাকচাপায় চলে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।

মাহমুদ হাবিবের ফেসবুক ওয়ালে গিয়ে দেখা যায় বন্ধু, সহপাঠী ও সতীর্থদের আর্তনাদ। ফেসবুকে মাহমুদের পুরো নাম মাহমুদ হাবিব হিমেল। বাবার বাড়ি বগুড়ার শেরপুর উপজেলায়। লেখাপড়ার পাশাপাশি করতেন জনকল্যাণমূলক কাজ। ফেসবুকে তাঁর পরিচয়ে লেখা রয়েছে সহসভাপতি, বাঁধন, শহীদ শামসুজ্জোহা হল ইউনিট, রাবি জোন এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় সাংস্কৃতিক জোটের দপ্তর সম্পাদক। বাঁধন স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের অন্যতম একটি সংগঠন।

মাহমুদ হাবিব
ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

ফেসবুকে বাল্যবন্ধু পরিচয় দেওয়া ফয়সাল মাহমুদ নামের একজনের স্ট্যাটাস থেকে জানা গেল, মাহমুদ তাঁর মা–বাবার একমাত্র সন্তান। বাবা প্রয়াত, মা শারীরিকভাবে অসুস্থ। ফয়সাল মাহমুদের স্ট্যাটাসটি এমন, ‘আমার ছোটবেলার বন্ধু। সে আমাকে এ বায় বলে ডাকত। যাচ্ছি তার সাথে শেষবারের মতো দেখা করতে। আমি যখন প্রথম খবরটি শুনলাম, মনে হচ্ছিল হয়তো কোথাও ভুল হচ্ছে। এটা সম্ভবত অন্য কোনো হিমেল হবে। কিন্তু না, আমার ধারণাটা ভুল ছিল। এটাই প্রমাণ হলো যে আমাদের বন্ধু আর নেই। আসলেই নাই। সে ছিল তার বাবা–মায়ের একমাত্র ছেলে। কোনো ভাইবোন ছিল না তার। ছোটবেলায় তার বাবা মারা যায়। হিমেলের আম্মুও শারীরিকভাবে অসুস্থ অনেক আগে থেকেই। একমাত্র হিমেলকে নিয়েই তিনি বেঁচে আছেন বলা চলে। খবরটি শোনার পর আমার তখন হিমেলের আম্মুর কথা মনে পড়ল। সে যখন এই খবরটা পাবে, তার কী অবস্থা হবে? এইটা ভাবতেই ভয় লাগছে। যা–ই হোক, ভালো থাকিস বন্ধু।’

মেসেঞ্জারে ফয়সালের সঙ্গে যোগাযোগ করে নিশ্চিত হওয়া গেল মাহমুদের বাড়ির ঠিকানা। তিনি জানালেন, মাহমুদের বাবার বাড়ি বগুড়ার শেরপুর উপজেলার উলিপুর গ্রামে। আর নানাবাড়ি নাটোরে। তাঁর অসুস্থ মা এখন নাটোরেই থাকেন।

মাহমুদের ফেসবুক ওয়াল ছেয়ে গেছে সতীর্থদের শেয়ার করা রক্তমাখা স্কেচ আর স্মৃতিকথায়। তাঁদেরই একজন মুশাররফ হোসাইন তাঁর দীর্ঘ স্ট্যাটাসের শেষে লিখেছেন, ‘ভাই আজ সত্যি সত্যিই নিজের সব রক্ত দিয়ে রাবি ক্যাম্পাস রঞ্জিত করে সবাইকে ছেড়ে চলে গেছেন ওপারে। এই রক্তমাখা ক্যাম্পাসে আমি কী করে হাঁটব!’ মোমিনুর আকাশ নামের একজন তাঁর স্ট্যাটাসের একাংশে লিখেছেন, ‘দুইটা ভালো মানুষের মৃত্যুদিবস একই দিনে হলো “১লা ফেব্রুয়ারি”। আর একটা ব্যাপার আছে, সেটাও জেনে রাখ, তোর মৃত্যু আজও আমি মানতে পারি না। আবার হিমেল ভাইও চলে গেল, ভালো মানুষগুলো হারিয়ে যাচ্ছে জানিস তো।’ মোমিনুর আকাশের স্মরণ করা দ্বিতীয় মানুষটি হলেন আতিক-উল গণি দীপ্ত নামের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়াত আরেক শিক্ষার্থী।

সদ্য প্রয়াত মাহমুদের ফেসবুক ওয়ালে তিন মিনিটের একটি ভিডিও দেখা যায়, যেখানে বন্ধু-সহপাঠীরা নীল রঙের পলিথিনে ঢেকে মাহমুদের মরদেহ একটি অ্যাম্বুলেন্সে তুলছেন। শিক্ষার্থীদের কান্নার রোলে সেই ভিডিও হজম করা দুষ্কর। এর মধ্যে ‘আমার বন্ধুরে ভালোভাবে ধরেন...’ এ কান্নার আওয়াজ কোনোভাবেই সহ্য করা যাচ্ছিল না।

ট্রাকচাপায় দুমড়েমুচড়ে যাওয়া মাহমুদদের মোটরসাইকেল
ছবি: সংগৃহীত

মাহমুদের রক্তমাখা স্কেচ সংযুক্ত করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক কনক পিকে লিখেছেন, ‘আহা! হিমেল। আমার ফেসবুক তালিকার সর্বশেষ বন্ধু। আতঙ্কে আমার ছেলে কণাদের ঘুম আসছে না। ওর মাকে রাস্তায় হাঁটতে দেবে না আর। হিমেলের মায়ের কেমন লাগছে?’

ক্যাম্পাসের নির্মাণাধীন একটি একাডেমিক ভবনের কাজে ব্যবহৃত ট্রাকের চাপায় নিহত হন মাহমুদ। তাঁর মাথা বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে বলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি জানিয়েছেন। সেই বিষয় তুলে ধরে বুলবুল নামের এক শিক্ষার্থী লেখেন, ‘হিমেলের মা যদি জিজ্ঞেস করেন, আমার হিমেল বাবার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে কবরে শুইয়ে দিই, কেউ কি মাথাটা এনে দিতে পারবেন?’

আজ বুধবার সকালে জানাজার জন্য মাহমুদের মরদেহ মর্গ থেকে ক্যাম্পাসে আনা হবে। এমনটাই জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ–উপাচার্য চৌধুরী মো. জাকারিয়া। আর শিক্ষার্থীরা চাইছেন তাঁদের দাবি করা ১০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণের বিষয়ে জানাজার আগেই ঘোষণা আসুক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে।