একুশে ফেব্রুয়ারি (১৯৫২) পূর্ববঙ্গ আইনসভার প্রথম বাজেট অধিবেশন শুরু। সে কথা মাথায় রেখেই একুশে ফেব্রুয়ারিতে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ফেব্রুয়ারির ৪ তারিখ থেকে পরবর্তী দুই সপ্তাহে সংঘটিত তৎপরতার চরিত্র লক্ষ করে অবাঙালিপ্রধান প্রশাসক কতৃর্পক্ষ হয়তো কিছুটা ভীত হয়েছিল অথবা ভাষার দাবিতে বাঙালি ছাত্রদের সাহস ও কর্মকাণ্ড তাদের অহংবোধে আঘাত করেছিল। তাই একুশের সাদামাটা কর্মসূচি নস্যাৎ করে দিতে তারা ২০ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারার নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এক মাসের জন্য ঢাকায় সভা-সমাবেশ, মিছিল-বিক্ষোভ—সবকিছু নিষিদ্ধ করা হয়। ২০ ফেব্রুয়ারি বিকেলে ছাত্র এলাকায় মাইকে ওই ঘোষণা ছাত্র-জনতা সবাইকে অবাক করে দেয়।
ছাত্র-বুদ্ধিজীবী-রাজনীতিকদের মধ্যে ওই নিষেধাজ্ঞার প্রতিক্রিয়া ছিল বিভিন্ন রকম। সামনে সাধারণ নির্বাচনের সম্ভাবনা মাথায় রেখে রাজনৈতিক নেতাদের অধিকাংশই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে নির্ধারিত কর্মসূচি পালনের পক্ষপাতী ছিলেন না। মওলানা ভাসানী পূর্বনির্ধারিত কর্মকাণ্ডের টানে ঢাকায় অনুপস্থিত থাকায় সেদিন তাঁর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানা যায়নি। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ, তমদ্দুন মজলিস এবং বিশেষ একটি ছাত্রাবাস ইউনিয়নের প্রতিনিধি ১৪৪ ধারা ভাঙা হঠকারী পদক্ষেপ বলে মনে করেন। আর আওয়ামী মুসলিম লীগের রাজনৈতিক সমর্থক স্থানীয় কমিউনিস্ট পার্টির অবস্থান ছিল অনেকটাই নিরক্ষরেখায়। এ নিয়ে ভিন্ন মতও রয়েছে। এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ এখানে নেই।
কিন্তু রাজনীতি-সচেতন সাধারণ ছাত্রদের মনোভাব ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাঁরা ছিলেন যেকোনো মূল্যে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে কর্মসূচি পালনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। একই মনোভাব ছিল যুবলীগ এবং ছাত্রনেতৃত্বের বাম অংশের। অধিকাংশ ছাত্রাবাস ইউনিয়নের নেতা অনুরূপ মনোভাব পোষণ করেছেন; যেমন ফজলুল হক হল, ঢাকা হল, মেডিকেল কলেজ, জগন্নাথ কলেজের ছাত্রসংগঠন। সেদিন সন্ধ্যায় হল-হোস্টেলের ছাত্রদের উত্তেজিত প্রতিক্রিয়া যাঁরা দেখেছেন, তাঁরাই জানেন, কতটা সাহসে ভর করে ওই সব ছাত্র ভাষার জন্য লড়াইয়ে নামতে প্রস্ত্তত ছিলেন। প্রয়োজনে জান বাজি। বাস্তবে তেমনটাই ঘটেছে।
রাজনীতিকেরা তো বরাবরই সুবিধার পথ ধরে হাঁটেন। জাতীয় স্বার্থ থেকে সেখানে রাজনৈতিক স্বার্থ তথা ব্যক্তিস্বার্থ প্রবল। ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের সিদ্ধান্ত তা-ই প্রমাণ করে। মওলানা ভাসানীর অনুপস্থিতির কারণে জনাব আবুল হাশিমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সংগ্রাম পরিষদের সভায় সব রাজনৈতিক নেতা এবং অধিকাংশ ছাত্রনেতা ১৪৪ ধারা অমান্য করে সরকারের সঙ্গে সংঘাতে যেতে রাজি হননি। স্বয়ং সভাপতিও তাঁদের সমর্থন করে বক্তব্য দেন। পূর্বোক্ত কর্মিসভায় সম্ভাব্য ১৪৪ ধারা সম্পর্কে ভাসানীর বক্তব্য বিচারে মনে হয়, সংগ্রাম পরিষদের এ বৈঠকে ভাসানী উপস্থিত থাকলে সিদ্ধান্ত ভিন্নতর হতো।
সংগ্রাম পরিষদের সিদ্ধান্তে আপত্তি জানান যুবলীগের নেতা অলি আহাদ, বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক আবদুল মতিন এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ ইউনিয়নের ভিপি গোলাম মাওলা। ১১-৩ ভোটের সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জয়ী হলেও ভিন্ন মতের গুরুত্ব উপেক্ষা করতে পারেননি বৈঠকের সভাপতি। তাই অলিখিত সিদ্ধান্ত, পরদিন অর্থাৎ একুশে ফেব্রুয়ারি সকালে আমতলায় উপস্থিত ছাত্রদের মতামতই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে। তবে সভাপতি সেই সঙ্গে একটা শর্ত জুড়ে দেন এই বলে যে যদি ছাত্রসভার মতামত সংগ্রাম পরিষদের সিদ্ধান্তের বিপক্ষে যায়, তাহলে এই পরিষদ বিলুপ্ত গণ্য হবে। আন্দোলনের পরবর্তী পর্যায়ে এ শর্তের কথা সংশ্লিষ্ট অনেকেই মনে রাখেননি; যেমন রাখেননি বক্তা নিজেও। এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন: সাধারণ ছাত্রকর্মীদের সম্মেলনে গঠিত সংগ্রাম পরিষদ কি কোনো বৈঠকের সভাপতি বিলুপ্ত ঘোষণা করতে পারেন?
সে রাতে হল-হোস্টেলগুলোতে ছাত্রদের চোখে ঘুম ছিল না। গভীর রাত পর্যন্ত তাঁরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেছেন। কেউ কেউ অন্যান্য ছাত্রাবাসের ছাত্রদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন, যাতে তাঁরা একুশের সকালে আমতলার সভায় হাজির হন। এসব আলোচনার মূল কথা ছিল একটাই, ১৪৪ ধারা অমান্য করার সিদ্ধান্তে নিশ্চিত থেকে নির্ধারিত কর্মসূচি পালন। সর্বোপরি অ্যাসেম্বলি ঘেরাও করে রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে প্রস্তাব নিতে এমএলএদের বাধ্য করা।
পরদিন বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণের আমতলায় অনুষ্ঠিতব্য ছাত্রসভায় সরকার আরোপিত ১৪৪ ধারা অমান্য করার গুরুত্ব রাজনীতি-সচেতন ছাত্ররা ঠিক ঠিক বুঝতে পেরেছিলেন। তাঁরা জানতেন, ওই বাধার শিকল ভাঙতে না পারলে ভাষার দাবি ও আন্দোলন মুখ থুবড়ে পড়বে। কিন্তু এ সহজ সত্যটা কেন জানি সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের সর্বোচ্চ নেতারা বুঝতে পারেননি, অথবা বুঝতে চাননি। তাঁরা তাঁদের রাজনৈতিক প্রয়োজনের গুরুত্বই বড় করে দেখেছেন।
আরও একটি বিষয় জেনে রাখা দরকার যে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ নামে সর্বদলীয় হলেও তাতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল আওয়ামী মুসলিম লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনগুলোর। তাদের মতামতে সমর্থন জানিয়েছেন কিছুসংখ্যক রাজনৈতিক নেতা, যাঁরা সাংবিধানিক রাজনীতির ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন অনেক বেশি। তাঁদের পথ ধরে সচেতন ছাত্রসমাজ চলতে চায়নি বলেই ‘একুশে’কে ঐতিহাসিক ‘একুশে’তে পরিণত করা সম্ভব হয়েছিল।
সূত্র: ভাষা আন্দোলন, আহমদ রফিক, প্রথমা প্রকাশন, ২০০৯