বাংলাদেশ মিশনে রদবদল
যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতকে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে
বর্তমান সরকারের আমলে দেড় বছরের মধ্যে এই প্রথম বিদেশি মিশনে বড় ধরনের রদবদল হতে যাচ্ছে।
র্যাবের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর মিশনগুলোতে রদবদলের বিষয়টি সামনে আসে।
যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও সুইজারল্যান্ডে নতুন মুখ চূড়ান্ত।
চুক্তিতে রাষ্ট্রদূত থাকায় পেশাদার কূটনীতিকদের মধ্যে হতাশা।
বিদেশে বাংলাদেশ মিশনগুলোতে চলতি বছর বড় ধরনের রদবদল ঘটতে যাচ্ছে। এর মধ্যে মাত্র দুই মাস আগে ভারতে তিন বছরের চুক্তিতে যোগ দেওয়া হাইকমিশনারকে যুক্তরাষ্ট্রে এবং যুক্তরাষ্ট্রে চুক্তিতে থাকা রাষ্ট্রদূতকে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আগামী তিন মাসের মধ্যে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, চীন, জার্মানি, তুরস্ক, ডেনমার্ক ও ভুটানে রাষ্ট্রদূত পদে রদবদল হতে পারে।
পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন এসব দেশের মিশনে রাষ্ট্রদূত পদে পরিবর্তনের সিদ্ধান্তের বিষয়টি প্রথম আলোর কাছে নিশ্চিত করেন।
বর্তমান সরকারের আমলে দেড় বছরের মধ্যে এই প্রথম বড় ধরনের রদবদল হচ্ছে। ২০১৯ সালের শেষ দিকে ভারত, রাশিয়াসহ ১২টি দেশ এবং নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে রাষ্ট্রদূত পদে পরিবর্তন আনে সরকার।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, সাধারণত বছরের প্রথম ও শেষ ভাগে দুই দফা রাষ্ট্রদূত পদে পরিবর্তন স্বাভাবিক। তবে গত ডিসেম্বরে র্যাবের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞাকে কেন্দ্র করে ওয়াশিংটনে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত মো. শহীদুল ইসলামকে ফিরিয়ে আনা এবং গুরুত্বপূর্ণ একাধিক মিশনে রদবদলের বিষয়টি সামনে চলে আসে।
কূটনীতিকের কাজটি বিশেষায়িত। এতে পেশাদার কূটনীতিকদের ভালো করার সম্ভাবনাটাই বেশি। তবে পেশাদার কূটনীতিক হিসেবে চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর চুক্তিতে অনেককে নিয়োগ দেওয়ার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।তৌহিদ হোসেন, সাবেক পররাষ্ট্রসচিব
বেশ কয়েকটি মিশনে রাষ্ট্রদূত পদে পরিবর্তন হলেও কয়েকজন পেশাদার কূটনীতিক রাষ্ট্রদূত পদে যোগ দিতে পারছেন না। গত কয়েক বছর পেশাদার কূটনীতিকেরা চাকরির মেয়াদ শেষেও চুক্তিতে বাড়তি দায়িত্ব পালন করছেন। ফলে রাষ্ট্রদূত হিসেবে তাঁদের সুযোগ সংকুচিত হচ্ছে। এতে তাঁদের মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কূটনীতিক প্রথম আলোকে বলেন, আগে রাজনৈতিকভাবে রাষ্ট্রদূত নিয়োগ হতো। এখন পেশাদার কূটনীতিকেরা নিয়োগ পেয়ে বাড়তি সময় দায়িত্ব পালন করছেন। প্রতিবছর তিন থেকে চারজন এভাবে চুক্তিতে দায়িত্ব পেলে পেশাদার কূটনীতিকদের সুযোগ কমতে থাকবে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেন, বিদেশি মিশনগুলোতে রাজনৈতিক বিবেচনায় চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের বিষয়টি তিন দশকের বেশি সময় ধরে চালু রয়েছে। সুস্পষ্ট কোনো বিধান না থাকলেও স্বৈরশাসক এরশাদের আমল থেকে মোট মিশনের অন্তত ৩০ শতাংশ রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ হতো। ১৯৯১ সাল থেকে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারগুলোও সেই প্রথা অনুসরণ করে আসছে।
বিভিন্ন সময় বিদেশি মিশনে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগের হার ৩০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। এই মুহূর্তে ৫৮টি মিশনে ১৭ জন রাষ্ট্রদূত চুক্তিভিত্তিক ও প্রেষণে দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁদের মধ্যে সাবেক সচিব, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক, সাবেক অতিরিক্ত সচিব, সচিব মর্যাদার সাবেক কূটনীতিকের পাশাপাশি প্রতিরক্ষা বাহিনীর বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তারা রয়েছেন। ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, কানাডা, তুরস্ক, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মরক্কোতে সাবেক কূটনীতিক; জার্মানি, জাপান, সৌদি আরব ও ইরাকে সাবেক সচিব এবং কুয়েত, লেবানন, লিবিয়া ও মালদ্বীপে প্রতিরক্ষা বাহিনীর বর্তমান ও সাবেক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালন করছেন।
সাবেক পররাষ্ট্রসচিব তৌহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, কূটনীতিকের কাজটি বিশেষায়িত। এতে পেশাদার কূটনীতিকদের ভালো করার সম্ভাবনাটাই বেশি। তবে পেশাদার কূটনীতিক হিসেবে চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর চুক্তিতে অনেককে নিয়োগ দেওয়ার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।
র্যাবের নিষেধাজ্ঞায় রদবদল চূড়ান্ত
গত ডিসেম্বরে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র্যাব এবং এর সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দিলে দুই দেশের মধ্যে অস্বস্তি তৈরি হয়। এরপর থেকে ওয়াশিংটনে চুক্তিতে থাকা শহীদুল ইসলামকে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই ফেরানোর সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়। অবশ্য কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, গত বছরের দ্বিতীয়ার্ধ থেকেই ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্ক নিয়ে সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে একধরনের অস্বস্তি ছিল। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে দূতাবাসের ভূমিকা নিয়েও রাজনৈতিক মহলে অসন্তোষের কথা জানা যায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সরকারের একাধিক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে দীর্ঘ আলোচনা শেষে দিল্লিতে নিযুক্ত হাইকমিশনার মোহাম্মদ ইমরানকে ওয়াশিংটনে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে তিনি দিল্লিতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পান। নিয়মিত চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে তাঁকে আরও তিন বছরের জন্য চুক্তিতে দিল্লিতে হাইকমিশনার পদে নিয়োগ দেয় সরকার।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, এরই মধ্যে রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ ইমরানের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অ্যাগ্রিমো (তাঁকে গ্রহণে আপত্তি নেই মর্মে পত্র) পাঠানো হয়েছে।
পরিবর্তন যেসব মিশনে
দিল্লিতে মোহাম্মদ ইমরানের স্থলাভিষিক্ত হতে যাচ্ছেন জেনেভায় জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি মোস্তাফিজুর রহমান। পেশাদার এই কূটনীতিক এর আগে সিঙ্গাপুরে হাইকমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
অস্ট্রেলিয়ায় নিযুক্ত হাইকমিশনার মো. সুফিউর রহমানকে জেনেভায় জাতিসংঘে স্থায়ী প্রতিনিধি হিসেবে বদলির সিদ্ধান্ত হয়েছে। পেশাদার এই কূটনীতিক এর আগে শ্রীলঙ্কা ও মিয়ানমারে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেন।
ডেনমার্কে নিযুক্ত পেশাদার কূটনীতিক এম আল্লামা সিদ্দিকী অস্ট্রেলিয়ায় সুফিউরের স্থলাভিষিক্ত হচ্ছেন। আর ডেনমার্কে যাচ্ছেন ভুটানে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত এ কে এম শহীদুল করিম। ভুটানে যাচ্ছেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে প্রেষণে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যাওয়া শিবনাথ রায়।