যানজটে বছরে ক্ষতি ৩৭ হাজার কোটি টাকা
যানজটের কারণে রাজধানীতে একটি যানবাহন ঘণ্টায় যেতে পারে গড়ে ৫ কিলোমিটার। ১২ বছর আগেও এই গতি ছিল ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকার ফলে যাত্রীদের মানসিক চাপ তৈরি হচ্ছে। এই চাপ আবার কাজ করছে অন্যান্য রোগের উৎস হিসেবে।
পাশাপাশি যানজটের কারণে শুধু ঢাকায় দৈনিক ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। যার আর্থিক ক্ষতি বছরে প্রায় ৩৭ হাজার কোটি টাকা। যানজটের পরিস্থিতি দিন দিন যেভাবে খারাপ হচ্ছে, তাতে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণও যে বাড়বে, তা বলা বাহুল্য।
গতকাল শনিবার রাজধানীতে আয়োজিত ‘ঢাকা মহানগরীর যানজট: আর্থিক ও স্বাস্থ্যগত সমস্যা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। বৈঠকের আয়োজক ছিল বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এআরআই) এবং রোড সেফটি ফাউন্ডেশন। বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয় বুয়েটের এআরআই-আইটিএন ভবনের সেমিনার হলে।
বৈঠকে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন এআরআইয়ের পরিচালক অধ্যাপক মো. মোয়াজ্জেম হোসেন। তাতে যানজটের আর্থিক ও স্বাস্থ্যগত সমস্যা, যানজটের কারণ, যানজট থেকে উত্তরণের উপায়সহ বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরা হয়।
আর্থিক বিষয়
২০১৫ সালের সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (আরএসটিপি) অনুযায়ী, ঢাকায় দৈনিক প্রায় ৩ কোটি ৬০ লাখ যাত্রা (ট্রিপ) হয়। একজন মানুষ কোনো একটি বাহনে উঠে নির্ধারিত গন্তব্যে নামলে একটি যাত্রা বা ট্রিপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বর্তমানে যানজটে দৈনিক ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে।
যানজটের আর্থিক ক্ষতি নিয়ে একাধিক গবেষণায় ভিন্ন ভিন্ন তথ্য উঠে এসেছে। গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০ হাজার থেকে ৫৫ হাজার কোটি টাকার বার্ষিক ক্ষতি হচ্ছে। এ থেকে বলা যায়, গড়ে বছরে যানজটের কারণে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ বছরে ৩৭ হাজার কোটি টাকা। তবে সড়ক খাতে বিনিয়োগ, যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ ও যানজট নিরসনে রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে এই ক্ষতির অন্তত ৬০ শতাংশ বা ২২ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করা যেত।
স্বাস্থ্যগত সমস্যা: যানজটের ফলে মানসিক স্বাস্থ্যে বড় প্রভাব পড়ছে বলে গোলটেবিল বৈঠকে জানানো হয়। মূল প্রবন্ধে বলা হয়, যানজট ৯ ধরনের মানবিক আচরণকে প্রভাবিত করছে। দুর্ঘটনায় পঙ্গুত্ব থেকে শুরু করে সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার মতো বিষয়গুলো যানজটে প্রভাবিত হচ্ছে।
জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের (নিটোর) সাবেক পরিচালক অধ্যাপক মুহম্মদ সিরাজ-উল-ইসলাম বলেন, যানজটে বসে থাকলে মানসিক চাপ তৈরি হয়। নানান রকম দুশ্চিন্তা ভর করে। এই মানসিক চাপ সব ধরনের রোগের উৎস। চাপের ফলে নাগরিকদের মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়, যুদ্ধংদেহী মনোভাব চলে আসে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ফারাহ্ দীবা বলেন, যানজটের কারণে মানসিক অশান্তি তৈরি হয়, যার প্রভাব পড়ে পরিবারসহ বিভিন্ন সামাজিক সম্পর্কে। ব্যক্তির কর্মদক্ষতা, কর্মস্পৃহা নষ্ট হয়ে যায়। যে চালকেরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা একটানা গাড়ি চালান, তাঁদের দুর্ঘটনা ঘটানোর আশঙ্কা বেশি থাকে। আর উচ্চমাত্রার শব্দদূষণের ফলে দীর্ঘস্থায়ী বধিরতা তৈরি হতে পারে।
হেঁটেই পৌঁছানো যাবে আগে: এখন ঘণ্টায় গড়ে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার গতিতে চলছে যানবাহন। এভাবে চলতে থাকলে আর কিছুদিন পর হেঁটেই গাড়ির আগে যেতে পারবে মানুষ।
২০১৬ সালে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের ‘নগর পরিস্থিতি-২০১৬: ঢাকা মহানগরে যানজট, শাসন ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিত’ শীর্ষক এক গবেষণায় বলা হয়েছিল, ২০০৪ সালে ঢাকার রাস্তায় প্রতি ঘণ্টায় গাড়ির গতিসীমা ছিল গড়ে ২১ দশমিক ২ কিলোমিটার। যানবাহনের পরিমাণ যদি একই হারে বাড়তে থাকে এবং তা নিরসনের কোনো উদ্যোগ না নেওয়া হয়, তাহলে ২০২৫ সালে এই শহরে যানবাহনের গতি হবে ঘণ্টায় চার কিলোমিটার, যা মানুষের হাঁটার গতির চেয়ে কম।
যানজটের পেছনের কারণ: মূল প্রবন্ধে বলা হয়, ঢাকায় বড় সড়কের সংখ্যা হাতে গোনা। ট্রাফিক মোড়গুলো শহরের বিষফোড়া। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সড়কে অবৈধ পার্কিং, ফুটপাতের অবৈধ দখল, ভাসমান বিক্রেতাদের সড়ক দখল, যত্রতত্র যাত্রী ওঠানো-নামানো, খোঁড়াখুঁড়ির কারণে সড়কের প্রশস্ততা কমে যাওয়া অন্যতম। তা ছাড়া দুই শতাধিক কোম্পানির অধীনে শহরের বাস সেবা পরিচালিত হওয়ার ফলে যাত্রী ওঠানো নিয়ে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হওয়া এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর দায়িত্বহীনতাও যানজটের অন্যতম কারণ।
আবার বৈঠকে একাধিক আলোচক বলেন, ঢাকা বর্তমানে নাগরিকদের শহর নয়, ‘গডফাদারদের’ শহর। ঢাকার কয়েক লাখ অনিবন্ধিত রিকশা এবং ফুটপাতের কয়েক হাজার অবৈধ হকারের কাছ থেকে টাকা আদায় করেন গডফাদাররা। বাস, লঞ্চ টার্মিনালগুলো গডফাদারদের দখলে থাকায় যাত্রীসেবার বদলে দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে।
সমন্বয়হীনতা: বৈঠকে আলোচকেরা সরকারি বিভিন্ন সংস্থার সমালোচনা করেন। তাঁদের মতে, সরকারি সংস্থাগুলো শহরকে বসবাস উপযোগী করে গড়ে তোলার পরিবর্তে শহরকে ধ্বংসের প্রতিযোগিতায় নেমেছে। তাঁরা অভিযোগ করেন, সরকারি এক সংস্থার সঙ্গে অন্য সংস্থার কাজে সমন্বয় নেই।
এআরআইয়ের সহকারী অধ্যাপক কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ বলেন, সব পেশার, সব বয়সী মানুষ যানজটের ফলে ভুক্তভোগী। সরকারের বিভিন্ন সংস্থা যানজট নিরসনে কাজ করছে। কিন্তু তাদের কার্যক্রমে সমন্বয়ের ঘাটতি রয়েছে। যানজট নিরসন একক কোনো সংস্থার পক্ষে সম্ভব নয়। সমন্বিতভাবে উদ্যোগ নিতে হবে।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপপরিচালক দেবাশীষ বর্ধন বলেন, বিভিন্ন সংস্থা সমন্বয়হীনভাবে সড়ক খোঁড়াখুঁড়ি করায় যানজট বাড়ছে। ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা একটি সড়ক দিনের বেলায় ভালো দেখে এসেছেন, রাতের বেলায় সে সড়কে খোঁড়াখুঁড়ি শুরু হয়ে গেছে। তিনি আরও জানান, শহরে বিভিন্ন স্থানে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলেও অনেককেই যানজটের কারণে সঠিক সময়ে হাসপাতালে পৌঁছানো সম্ভব হয় না। যানজট কমানো গেলে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও কমানো যেত।
সমাধানের পথ: বৈঠকে আলোচকেরা ঢাকার যানজট কমাতে বাস সেবা আরও বিস্তৃত ও উন্নত করা, রেলে যাত্রী পরিবহন বাড়ানো, ব্যক্তিগত গাড়ি কমানো, ঢাকায় জনসংখ্যার চাপ কমাতে বিকেন্দ্রীকরণসহ বিভিন্ন পরামর্শ দেন।
বুয়েটের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক সরওয়ার জাহান বলেন, ২০১৫ সালে করা আরএসটিপি বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন হবে ১ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা। যাঁরা এ পরিকল্পনা করেছেন, তাঁরা ঢাকার সমস্যা কতটা মাথায় রেখে করেছেন তা ভাবনার বিষয়। ঢাকার যে আর্থসামাজিক পরিস্থিতি, তাতে বাস সেবা মূল সমাধান। ভবিষ্যতে ব্যক্তিগত গাড়ি নিষিদ্ধ না করলে এ শহর অকার্যকর হয়ে যাবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এম এম আকাশ বলেন, যানজট সমস্যাটি বহুমাত্রিক। ঢাকায় যদি জনসংখ্যা বাড়তেই থাকে, তাহলে পরিকল্পনা করে সমাধানে পৌঁছানো যাবে না। ঢাকায় জনসংখ্যার চাপ কমাতে হলে বিকেন্দ্রীকরণ ব্যবস্থা গড়তে হবে।
যানজট নিরসনে কার্যকর উদ্যোগ নিতে সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরকারের ওপর চাপ বাড়াতে হবে বলে মনে করেন এআরআইয়ের পরিচালক মো. মোয়াজ্জেম হোসেন। তিনি বলেন, ফুটপাত দখলমুক্ত করা, পৃথক বাস লেন তৈরি, ট্রাফিক মোড়গুলোর বিষয়ে পরিকল্পিত ব্যবস্থা নিতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান এ আই মাহবুব উদ্দিন আহমেদ বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন।