যশোরে ১৫ টাকার পেঁপে ঢাকায় যেভাবে ৪০ টাকা
দক্ষিণাঞ্চলে পাইকারি সবজির বড় বাজার যশোরের বারীনগর। সবজির এই মোকামে কৃষক এক কেজি পেঁপে বিক্রি করেন ১৩ থেকে ১৫ টাকায়। সেই পেঁপে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূরে ঢাকার কারওয়ান বাজার অবধি পৌঁছাতে পৌঁছাতে খুচরা বাজারে দাম ওঠে ৪০ টাকা। লাউ, কচুর লতিসহ অন্যান্য সবজির ক্ষেত্রেও প্রায় একই চিত্র দেখা গেল।
যশোরের সবজি ঢাকায় এসে কীভাবে দাম দ্বিগুণ-তিনগুণ হয়ে যায়, পথে ট্রাকে চাঁদা নেওয়া হয় কি না, তা দেখার জন্য গত মঙ্গলবার দুপুর সাড়ে ১২টায় তিন টনের সবজিবাহী একটি পিকআপ ভ্যানে চড়ে বসলাম। পিকআপ ভ্যানটি যশোরের বারীনগর পাইকারি সবজি হাট থেকে গাজীপুরের কোনাবাড়ী হয়ে ঢাকার কারওয়ান বাজার ও পুরান ঢাকার শ্যামবাজারে যায়। পুরোটা সময় ট্রাকচালকের পাশে বসে দেখা গেল, পথে পথে শ্রমিক ইউনিয়ন, পুলিশ ও সিটি করপোরেশনের নামে টাকা নেওয়া হচ্ছে। কোথায় কাকে কত টাকা দিতে হয়েছে, তা-ও দেখা গেল। দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া ফেরিঘাটের অব্যবস্থাপনা ও ছোট সেতুর বড় টোল আদায়ের চিত্রও সামনে আসল।
পাইকারি সবজি ব্যবসায়ীরা বলছেন, পরিবহন ভাড়া, পথে পথে ও মাসিক চাঁদার কারণে সবজির দাম বাড়ছে।
‘ব্যানার’ থাকলে ঝামেলা নেই
তিন টনের পিকআপটিতে আট টনের মতো পটোল, লাউ, পেঁপে ও কচুর লতি ছিল। বেলা পৌনে তিনটার দিকে পিকআপটি মাগুরার ভায়নার মোড়ে পৌঁছালে চালক মুঠোফোনে একজনকে ডেকে নিয়ে তাঁর কাছ থেকে ট্রান্সপোর্ট এজেন্সির এক বছর মেয়াদি একটি কার্ড সংগ্রহ করেন। ছাপানো ওই কার্ডে ‘ট্রাফিক আইন মেনে চলুন, একটি দুর্ঘটনা সারা জীবনের কান্না’ লেখাসংবলিত একটি মনোগ্রাম রয়েছে। ছাপানো কার্ডটির নিচের দিকে ফাঁকা ঘরে হাতে লেখা গাড়ির নম্বর, মেয়াদ শুরু ও শেষ হওয়ার তারিখ এবং কোড নম্বর রয়েছে।
এই কার্ড কী কাজে লাগে—জানতে চাইলে চালক বলেন, ‘দিনের বেলায় শহরের ভেতরে গাড়ি নিয়ে ঢোকা যায় না। পুলিশ গাড়ি ধরে, অনেক সময় হয়রানিও করে। এই ব্যানার (কার্ড) দেখালে আর কোনো ঝামেলা করে না। এর জন্য মাসে দুই হাজার টাকা করে দিতে হয়।’
ফরিদপুরের মানিকতলা পেরিয়ে দৌলতদিয়া ঘাটের অন্তত চার কিলোমিটার দূরে ফেরি পারাপারের জন্য পিকআপটি যানজটে আটকা পড়ল। বিকেল পৌনে পাঁচটায় ঘাটে পৌঁছানোর পর একটু একটু করে গাড়ি ঘাটের দিকে এগিয়ে যায়। রাত পৌনে আটটায় ফেরিতে গাড়ি তোলার সুযোগ মেলে। ততক্ষণে সবজির পাটের বস্তা শুকিয়ে গেছে। ফেরি পার হওয়ার পর মানিকগঞ্জে ১০০ টাকা দিয়ে সবজির বস্তা পানি দিয়ে ভিজিয়ে নেওয়া হয়।
ঢাকার পথে পথে চাঁদা
পুরান ঢাকার শ্যামবাজার যাওয়ার পথে গুলিস্তানে পৌঁছালে তিন-চারজন গাড়ি থামিয়ে ৩০ টাকার একটি স্লিপ ধরিয়ে দেন। সেই স্লিপটি ঢাকা জেলা ট্রাক ট্যাংকলরি কাভার্ড ভ্যান শ্রমিক ইউনিয়নের। স্লিপে লেখা, ‘মৃত ও পঙ্গু শ্রমিকদের কল্যাণার্থে সার্ভিস চার্জসহ ৩০ টাকা’।
শ্যামবাজার লালকুঠি মোড়ে পৌঁছালে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নামে ৭০ টাকা টোল আদায় করা হয়। টাকা নিয়ে টোল ফি আদায়ের একটি রসিদ চালকের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়। তাতে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ইজারাদার হিসেবে এক ব্যক্তির নাম লেখা ছিল।
শ্যামবাজার প্রবেশের মুখে সদরঘাটে পোশাক পরা পাঁচ থেকে ছয়জন ট্রাফিক পুলিশ একটি বেঞ্চ নিয়ে বসে ছিলেন। তখন রাত সোয়া দুইটা। সাদাপোশাক পরা একজনের এক হাতে লাঠি, অন্য হাতে লেজার লাইট। লেজার লাইট চালকের চোখে ফেলে গাড়ি থামালেন পুলিশের ওই সদস্য। গাড়ি থামিয়ে চালক বলেন, ‘স্যার, ছোট গাড়ি, মালও (পণ্য) কম। ১০০ টাকা নেন।’ কোনো প্রমাণপত্র ছাড়াই ১০০ টাকা দিতে হলো।
এখানেই শেষ নয়, বুড়িগঙ্গা নদীর পাড়ের রাস্তায় পণ্য নামানোর সময় এক ব্যক্তি গাড়ির দিকে এগিয়ে এলেন। অভিযোগ আছে, তিনি বিট পুলিশের নামে টাকা তোলেন। চালকের কাছে এসে ১০০ টাকা দাবি করেন। আর কেউ টাকা নিতে আসবে না শর্তে তাঁকে ৫০ টাকা দিয়ে রক্ষা পান চালক।
যশোর থেকে ঢাকার শ্যামবাজার পর্যন্ত পৌঁছাতে পিকআপের ভাড়া ১৩ হাজার টাকা ঠিক করা হয়েছিল বলে চালক জানালেন। এ ছাড়া মোট পাঁচ স্থানে ৩৫০ টাকা চাঁদা দিতে হলো। সেতুর টোল ও ফেরির ভাড়া বাবদ গুনতে হলো আরও ১ হাজার ৩৭০ টাকা। সব মিলিয়ে তিন টনের ট্রাকটি আট টন সবজি নিয়ে ঢাকা পর্যন্ত পৌঁছাতে ভাড়াসহ ব্যয় ১৪ হাজার ৭২০ টাকা।
কারওয়ান বাজারের দর
গত মঙ্গলবার রাতে যশোর থেকে যে পটোল, পেঁপে, লাউ ও কচুর লতি কারওয়ান বাজারে আনা হয়েছিল, পরদিন বুধবার তার দাম কেজিতে কোনোটা দুই থেকে তিন গুণ বেশি দামে খুচরায় বিক্রি হতে দেখা যায়। যশোরে পটোলের পাইকারি দাম কেজিতে ৪৫-৪৬, পেঁপে ১৩-১৫, লাউ ১৮-২০, কচুর লতি ৩৮-৪০ টাকা ছিল। কারওয়ান বাজারে গতকাল বুধবার খুচরা বাজারে পটোল ৮০ টাকা, পেঁপে ৩৫-৪০, লাউ প্রতিটি ৬০-৭০, কচুর লতি ৭০-৮০ টাকা কেজি বিক্রি করতে দেখা যায়।