দেশের সড়ক ব্যবস্থাপনা ও দুর্ঘটনা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কাজ করে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট (এআরআই)। সড়ক দুর্ঘটনা কমানো এবং সড়ক নিরাপদ করতে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে পরামর্শ দিয়ে থাকে এআরআই। ঈদের সময়ের সড়ক দুর্ঘটনায়, বিশেষ করে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় কিশোর-তরুণেরা হতাহত হচ্ছে বেশি। এসব দুর্ঘটনার কারণ, প্রতিরোধের উপায়সহ সার্বিক বিষয়ে এআরআইয়ের পরিচালক ও পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামানের সঙ্গে কথা বলেছেন প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সামছুর রহমান।
প্রশ্ন :
এবার ঈদের ছুটির সময় সড়কে যত মানুষের মৃত্যু হয়েছে, তাদের প্রায় অর্ধেক মোটরসাইকেলের চালক ও আরোহী। এসব দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তিদের সংখ্যাও অনেক। এমন পরিস্থিতির কারণ কী?
হাদিউজ্জামান: এবার সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত মোটরসাইকেলচালক ও আরোহীদের বড় অংশের বয়স ১৫ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে। এদের অধিকাংশের লাইসেন্স ছিল না। তাদের তো সড়ক-মহাসড়কে যানবাহন চালানোরই কথা না। সড়ক পরিবহন আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে হেলমেট ব্যবহার করেনি, এক মোটরসাইকেলে তিনজন উঠেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নাকের ডগা দিয়ে উঠতি বয়সীরা বেপরোয়াভাবে মোটরসাইকেল চালিয়েছে। কিন্তু তারা আইনের প্রয়োগ করেনি। তা ছাড়া ঈদের সময় সড়ক ফাঁকা থাকে। ফাঁকা রাস্তায় বেপরোয়া গতিতে যানবাহন চলাচলে দুর্ঘটনা বাড়ে।
প্রশ্ন :
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য অনুযায়ী, এবারের ঈদে ২৫ লাখের বেশি মোটরসাইকেল চলেছে। এক জেলা থেকে অন্য জেলায় যাতায়াত হয়েছে মোটরসাইকেলে। দূরপাল্লার বাহন হিসেবে মোটরসাইকেল ব্যবহার কতটা উপযোগী?
হাদিউজ্জামান: দেশের গণপরিবহন ব্যবস্থাপনা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কথা হচ্ছে, নানা পরামর্শ-প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না। ঈদের সময় ট্রেনের টিকিট কাটায় হয়রানি, সড়কের যানজটের ভোগান্তির কারণে ঈদযাত্রায় মোটরসাইকেল বিকল্প বাহন হয়ে উঠেছে। মোটরসাইকেল গণপরিবহনের বিকল্প হওয়া দুঃখজনক। এটি গণপরিবহনের বিকল্প হতে পারে না। দূরপাল্লায় যাত্রায় মোটরসাইকেল ব্যবহার অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এবার অনেক মোটরসাইকেল বাণিজ্যিকভাবে দূরপাল্লার যাত্রী পরিবহন করেছে। যা দেশের বিদ্যমান রাইড শেয়ারিং নীতিমালার পরিপন্থী।
প্রশ্ন :
ঈদের আগের দিন সোমবার থেকে গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত চার দিনে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত আট শতাধিক রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন ঢাকার জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে (পঙ্গু হাসপাতাল)। তাঁদের অধিকাংশই ঢাকার বাইরে থেকে এসেছেন। এর একটি বড় অংশ বয়সে তরুণ, যাঁরা মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন। তরুণ-কিশোরেরা বেশি দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে কেন?
হাদিউজ্জামান: ঈদের সময় উঠতি বয়সীদের মোটরসাইকেলের বেপরোয়া গতি প্রাণ বেশি কেড়েছে। বিশেষ করে ঈদের দিন থেকে দুর্ঘটনায় কিশোর-তরুণদের প্রাণহানি বেশি হয়েছে। ঈদের সময় সড়ক-মহাসড়ক ফাঁকা ছিল, অন্যদিকে সড়ক-মহাসড়কে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যের উপস্থিতি কম ছিল। ফলে তরুণেরা বেপরোয়া গতিতে মোটরসাইকেল চালিয়েছে। অনেকটা ‘রেসিং ট্র্যাক’ হিসেবে মহাসড়ককে ব্যবহার করা হয়েছে। অথচ এই তরুণদের মহাসড়কে মোটরসাইকেল চালানোর দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও সক্ষমতা নেই। কীভাবে মহাসড়কে চালাতে হয় এই কিশোরদের অধিকাংশই তা জানে না।
প্রশ্ন :
কয়েক বছর ধরে দেশে মোটরসাইকেলের সংখ্যা বাড়ছে। সেই সঙ্গে দুর্ঘটনাও বাড়ছে। বাংলাদেশ রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ২০২১ সালে মোট ২ হাজার ৭৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটে। এতে মারা যান ২ হাজার ২১৪ জন, যা সড়ক দুর্ঘটনায় মোট মৃত্যুর ৩৫ শতাংশ। ২০২১ সালে আগের বছরের চেয়ে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ৫০ শতাংশ এবং এই দুর্ঘটনাগুলোতে মৃত্যুর সংখ্যা ৫১ শতাংশ বেড়েছে। ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরও খারাপের আশঙ্কা রয়েছে কি?
হাদিউজ্জামান: বিশ্বের অনেক উন্নত দেশ মোটরসাইকেল ব্যবহারকে নিরুৎসাহিত করছে। বাংলাদেশ পুরো বিপরীত পথে হাঁটছে। বাংলাদেশে মোটরসাইকেলকে সহজলভ্য করা হয়েছে। মোটরসাইকেল ব্যবহারকে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে মোটরসাইকেলের ইঞ্জিনক্ষমতা (সিসি) বাড়ানো হচ্ছে। এই দুটিই আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। এতে দুর্ঘটনার শঙ্কা আরও বাড়বে, সড়ক-মহাসড়ককে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলবে।
প্রশ্ন :
মহাসড়ক, আঞ্চলিক সড়ক ও গ্রামীণ সড়কে মোটরসাইকেল চালানোর ক্ষেত্রে অধিকাংশ চালক নিয়ম মানেন না। চালক ও আরোহীরা হেলমেট পরেন না। এক মোটরসাইকেলে দুজনের বেশি না ওঠার নিয়মটিও মানা হয় না। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে অনিবন্ধিত মোটরসাইকেলও অহরহ চলে। অনেক চালকের লাইসেন্সও নেই।
হাদিউজ্জামান: গবেষণায় দেখা গেছে, গুণগত মানসম্পন্ন হেলমেট সঠিকভাবে ব্যবহার করলে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত হওয়ার ঝুঁকি ৭০ শতাংশ এবং মারা যাওয়ার ঝুঁকি ৪০ শতাংশ কমে। বাজারে যেসব হেলমেট পাওয়া যায়, সেগুলোর মান যাচাইয়ের কোনো ব্যবস্থা নেই। নিম্নমানের হেলমেট পরলে ঝুঁকি থেকেই যায়। ঝুঁকি কমাতে হেলমেটের মান ও হেলমেট পরা নিশ্চিত করতে হবে। এবার মহাসড়কে লাইসেন্স ছাড়া অনেকেই মোটরসাইকেল চালিয়েছেন। আইনের প্রয়োগ হলে এটি সম্ভব হতো না।
প্রশ্ন :
সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর ভূমিকা কীভাবে দেখেন?
হাদিউজ্জামান: দেশের জেলা শহর ও গ্রামীণ এলাকায় অনিবন্ধিত অন্তত ১৫ লাখ মোটরসাইকেল চলে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) মোটরসাইকেলের ব্যবহারকে সহজলভ্য না করে দুর্ঘটনা কমাতে ভূমিকা রাখতে পারে। মোটরসাইকেলের সিসি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করে বিআরটিএ মোটরসাইকেলের যন্ত্রাংশ আমদানিতে শুল্ক আরোপ করতে পারে। হাইওয়ে পুলিশকে আইনের প্রয়োগে কঠোর হতে হবে। বাণিজ্যিকভাবে দূরপাল্লার মোটরসাইকেল চালানো যায় না। হাইওয়ে পুলিশের সুযোগ ছিল এমন বাণিজ্যিক চালকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার। কিন্তু তারা সেটি করেনি।
প্রশ্ন :
প্রতিবছর দেশে সড়কে প্রাণহানি বাড়ছে। গণমাধ্যমে সব দুর্ঘটনার খবর আসে না। অনেক পঙ্গুত্বের খবর চাপা পড়ে থাকে। সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে করণীয় কী?
হাদিউজ্জামান: দেশের সড়ক পরিবহন আইনে সড়ক দুর্ঘটনা রোধের বিভিন্ন বিষয় বলা আছে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো হচ্ছে। মানবিক দিক বিবেচনায় অনেক ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া হচ্ছে। দুর্ঘটনা রোধ করতে হলে আইনের প্রয়োগে মানবিক দিক থেকে দেখার সুযোগ নেই। উচ্চ আদালতের নির্দেশনার পরেও মহাসড়কে স্বল্পগতির যান চলাচল বন্ধ হচ্ছে না। সড়ক পরিবহন আইনের যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন ছাড়া দুর্ঘটনা কমানো ও সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো সম্ভব হবে না। পাশাপাশি অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। উঠতি বয়সী কিশোর-তরুণদের মোটরসাইকেল দেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের নিরাপত্তার কথাও অভিভাবকদের চিন্তা করতে হবে।