মেয়েদের কাছে রাখতে ইমরান–এরিকোর পাল্টাপাল্টি যত যুক্তি

তিন মেয়ের সঙ্গে বাবা ইমরান শরীফ ও মা এরিকো নাকানো
ফাইল ছবি

জাপানি নাগরিক এরিকো নাকানো ও বাংলাদেশের ইমরান শরীফ দম্পতির সন্তানেরা কার হেফাজতে যাবেন, সে সম্পর্কে হাইকোর্টের সিদ্ধান্ত দেওয়ার কথা রয়েছে রোববার। টানা দুই মাসের আইনি লড়াই ও সমঝোতা চেষ্টার পরও নিজেদের অবস্থান থেকে একচুল নড়েননি কেউ। দুই পক্ষের আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এসব তথ্য।  

এরিকো নাকানো জাপানি নাগরিক। তিনি টোকিওর সেইন্ট লিউকস ইন্টারন্যাশনাল হসপিটালের ক্যানসার বিশেষজ্ঞ। ইমরান শরীফ বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। ভার্জিনিয়া টেক থেকে তড়িৎ কৌশলে পাস করে এইচপিতে চাকরি নেন। এইচপি থেকে জাপানে বদলির পর এরিকোর সঙ্গে পরিচয়, প্রেম ও বিয়ে।

এই দম্পতি তিন মেয়ের মা–বাবা। এরিকো টোকিওর ব্যয়বহুল এলাকায় তাঁর বাবার নামে বাড়ি কেনেন ও ঋণের কিস্তি ইমরানকে শোধ করতে বলেন—এ নিয়ে তাঁদের বিরোধ চরমে পৌঁছায়।

জাপানের পারিবারিক আদালতে মামলা চলার সময় ইমরান দুই মেয়েকে নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। গত ১৯ আগস্ট এই দুই সন্তানের জিম্মা চেয়ে হাইকোর্টে রিট করেছেন এরিকো নাকানো।

অন্যদিকে ইমরান শরীফ জাপানে থাকা তৃতীয় সন্তানকে চেয়ে পাল্টা একটি রিট করেছেন হাইকোর্টে। ইমরান বাংলাদেশের পারিবারিক আদালতেও সন্তানদের জিম্মা চেয়ে মামলা করেছেন।

দুই মাসের আইনি লড়াইয়ের পর এই দম্পতি শেষ পর্যন্ত আদালতকে কী বললেন, সে সম্পর্কে তাঁদের আইনজীবীরা প্রথম আলোকে জানিয়েছেন। এরিকো নাকানোর পক্ষে আদালতে যুক্তি স্থাপন করেছেন শিশির মনির।

ইমরান শরীফ সন্তানদের ঢাকায় এনে মগজ ধোলাই করছেন

এরিকো বলছেন, টোকিওর পারিবারিক আদালত বলেছেন, এরিকোর যে আবেদন তাতে কোনো ত্রুটি নেই এবং সম্পূর্ণ যৌক্তিক। তিনি বলেছেন, স্বামীর কাছ থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ার আগে শিশুরা যেভাবে ছিল, সেভাবেই থাকবে। তারা একই বাসায় থাকবে, সেই একই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করবে, এরিকোর মা তাদের দেখাশোনা করবেন এবং ফিলিপিনো গৃহকর্মীও থাকবে। প্রাত্যহিক জীবনে ঝামেলা না করলে ইমরান শরীফ সন্তানদের দেখার সুযোগ পাবেন।

কিন্তু ইমরান তাঁর সন্তানদের অপহরণ করে ঢাকায় নিয়ে এসেছেন এবং তাঁকে নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছেন। বেশ কিছু উদাহরণ দিয়েছেন তিনি। সন্তানদের মতের ভিত্তিতে যেন আদালত সিদ্ধান্ত না দেয়, সে বিষয়ে এরিকো জোর দিয়েছেন।

দেশটির পারিবারিক আদালত সন্তানদের এরিকোর জিম্মায় দেওয়ার সিদ্ধান্ত দেন। সিদ্ধান্তে আসার আগে তাঁদের প্রতিনিধি এরিকো ও তাঁর তৃতীয় সন্তানের সাক্ষাৎকার নেন। পাশাপাশি আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল স্কুল জাপানের সঙ্গেও কথা বলেন।

ওই প্রতিনিধি বলেন, ইমরান শরীফ প্রতিদিনই এরিকো নাকানোর সঙ্গে উচ্চস্বরে ঝগড়া করতেন। এতে সন্তানেরা ভয় পেত। তাঁদের তৃতীয় সন্তান বলেছে, দুই বোনের জন্য তার মন খারাপ করে।

এরিকো নাকানোর যুক্তি
* সন্তানদের ইচ্ছেমাফিক রায় হলে বিপর্যয় হতে পারে, তারা পরিণত নয়
* ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘন করেছেন ইমরান
* সন্তানদের অপহরণ করেছেন

আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল স্কুল বলেছে, ‘এই দম্পতির মধ্যে যে সম্পর্ক তা সত্যিকার অর্থেই “চ্যালেঞ্জিং”। আমরা আশা করি দ্রুত এই সমস্যার সমাধান হবে এবং এই তিনটি শিশু আবারও এক পরিবারে একত্র হতে পারবে।’

অন্যদিকে হাইকোর্টের নির্দেশে বাংলাদেশে সমাজসেবা অধিদপ্তর দুই শিশুর সঙ্গে বাবা-মায়ের সম্পর্ক কেমন, তা পর্যবেক্ষণ করেছে। সেই প্রতিবেদনে অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা উল্টো কথা বলেছেন। তাঁরা বরং বলছেন, বাবার সঙ্গেই মেয়েদের সম্পর্ক বেশি ভালো। সে কারণে এরিকো মনে করছেন তাদের মগজ ধোলাই করা হয়েছে।

এরিকো মনে করেন তাঁর সন্তানেরা সিদ্ধান্ত দেওয়ার মতো যথেষ্ট পরিণত নয়।অপ্রাপ্তবয়স্কদের মতামতের ওপর সিদ্ধান্ত নেওয়া বিপজ্জনক হতে পারে।

এরিকো নাকানোর অভিযোগ ইমরান শরীফ তাঁর সন্তানদের অপহরণকারী। তিনি গত ২১ জানুয়ারি আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল স্কুল থেকে ফেরার পথে তাঁদের দুই সন্তানকে অপহরণ করেছেন।

দিন সাতেক পর এরিকো টোকিওর পারিবারিক আদালতে সন্তানদের জিম্মা চেয়ে আবেদন করেন। আদালত তিনটি তারিখে বৈঠক করার সিদ্ধান্ত দেন। প্রথম বৈঠকের সময় ইমরান তাঁদের মেজ মেয়েকে ইম্পেরিয়াল হোটেলে দেড় ঘণ্টার জন্য কথা বলার সুযোগ দেন। পরের বৈঠকগুলোয় তিনি আসেননি। সন্তানদের অপহরণ করে ঢাকায় চলে এসেছেন।

গত ৯ ফেব্রুয়ারি আবর্জনার মধ্যে সন্তানদের পাসপোর্ট ভুলবশত ফেলে দিয়েছেন এই তথ্য দিয়ে ইমরান শরীফ নতুন পাসপোর্ট করান। ১৭ ফেব্রুয়ারি নতুন পাসপোর্ট হাতে পেয়েই মেয়েদের নিয়ে দুবাই হয়ে ঢাকায় চলে আসেন।

সন্তানদের জিম্মায় রাখতে পারবেন জাপানি আদালতের এমন রায় পেয়ে এরিকো নাকানো শ্রীলঙ্কা হয়ে ঢাকায় আসেন জুলাইয়ের মাঝামাঝি।

এরিকো বলেছেন, ঢাকার আসার পর তাঁকে একটি গাড়িতে তুলে চোখ বেঁধে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যান ইমরান শরীফ। সেখানে তাঁর সঙ্গে সন্তানদের দেখা হয়। তিনি বলেছেন, জাপানে তাঁর সন্তানদের জন্ম ও বেড়ে ওঠা। তাদের স্কুলও সেখানে। মেয়েদের ঢাকায় থাকতে কষ্ট হচ্ছে। বড় মেয়ে নির্যাতনের শিকার ও মেজ মেয়ের চামড়ায় ফুসকুড়ি। তারা এই পরিবেশে মানিয়ে নিতে পারছে না।

রিটকারী তাঁর আবেদনে চিকিৎসক আয়ুকো ইয়ামানের বিবৃতি যুক্ত হয়েছে। তিনি ওই বিবৃতিতে উল্লেখ করেছেন, একজন অভিভাবকের জিম্মায় থাকা এবং মগজ ধোলাইয়ের কারণে শিশুরা পুরো বিষয়টি বুঝতে পারছে না। মগজ ধোলাইয়ের কারণে মেয়েরা বাবার সঙ্গে ঢাকায় আসতে পেরেছেন। ইমরান শরীফ তিন বোনের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটিয়েছেন। অপহরণের এই অপরাধকে ছোট করে দেখার মানে হলো এতে করে যে মানসিক যন্ত্রণা সেটাকে বড় করা। এই শিশুরা স্টকহোম সিনড্রোমে ভুগছে।

ইমরানের বিরুদ্ধে এরিকো তাঁর ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘনের অভিযোগ এনেছেন। ইমরান তাঁর ই–মেইল হ্যাক করিয়েছেন এবং সারাক্ষণ তাঁর ওপর নজরদারি করছেন।

এমনকি দূতাবাসের সঙ্গে তাঁর যে যোগাযোগ, তা–ও হ্যাক করিয়েছেন। এ ব্যাপারে জাপান দূতাবাস আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে।

বাংলাদেশে আসার পর থেকে একটি ডায়েরিতে প্রাত্যহিক ঘটনা লিখে রাখছেন এরিকো নাকানো। সেটির প্রাসঙ্গিক কিছু অংশ হলফ করে আদালতে তিনি জমা দিয়েছেন। ইমরান শরীফ কীভাবে তাঁকে মানসিক নির্যাতন করছেন, তার উল্লেখ আছে এতে।

এরিকো টোকিওর আদালতের রায় বাস্তবায়ন করা উচিত বলে মনে করেন।

এরিকো নাকানো ভূরি ভূরি মিথ্যা বলেছেন

ইমরানের পক্ষে হাইকোর্টে প্রতিনিধিত্ব করছেন ফিদা এম কামাল ও ফওজিয়া করিম ফিরোজ।

ইমরান শরীফ বলেন এরিকো নাকানো রিট আবেদনে ভূরি ভূরি মিথ্যা বলেছেন। আদালতে তিনি সন্তানদের ইচ্ছার ওপর সিদ্ধান্ত নেওয়ার পক্ষে যুক্তি দিয়েছেন।

বাংলাদেশে অনুসৃত দ্য গার্ডিয়ান অ্যান্ড ওয়ার্ডস অ্যাক্ট, ১৮৯০ অনুযায়ী কোনো অভিভাবকের জিম্মায় অস্থায়ী কিংবা স্থায়ীভাবে হস্তান্তরের আগে শিশুরা কী চায়, সেটি বিবেচনায় নিতে হবে। আদালত শিশুর সর্বোত্তম কল্যাণের কথা বিবেচনায় নিয়ে এ সম্পর্কে রায় দেবেন।

আইনজীবীরা ইসলামিক আইনবিদ্যা ও কনভেনশন অন দ্য রাইটস অব দ্য চাইল্ড–এর ১২ ধারার উদাহরণ দিয়েছেন। দুই ক্ষেত্রেই বিচারিক ও প্রশাসনিক যেকোনো ব্যবস্থায় শিশুর বয়স এবং পরিপক্বতার পরিপ্রেক্ষিতে শিশুর কথা শুনতে হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

আইনজীবীরা বলেছেন, সন্তানদের জাপানে নিয়ে গেলে ইমরান শরীফ আর সন্তানদের দেখতে পাবেন না। বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ হলে শিশুকে একজনের জিম্মায় দেওয়ার পক্ষে জাপানের আদালত। ফলে শিশুকে দুই অভিভাবকের একজনই শুধু দেখতে পান, অন্যজন পান না। এটাকে বলা হয় হোস্টেস জাস্টিস সিস্টেম।

ইমরান অপ্রাপ্তবয়স্ক দুই শিশুকে বাংলাদেশি বলে দাবি করেছেন। উদ্ধৃতি দিয়েছেন বাংলাদেশ নাগরিকত্ব অধ্যাদেশ থেকে। তিনি বলেছেন, মা যেখানে থাকেন সেখানে সন্তানেরা যেতে চায় না। কারণ, তিনি নিরপেক্ষ কোনো জায়গায় থাকেন না। তারপরও বয়স এবং জেন্ডার বিবেচনায় মা যেখানে থাকেন, সন্তানদের মায়ের ও মায়েরও সন্তানদের সান্নিধ্য পাওয়া উচিত বলে মনে করেন ইমরান শরীফ।

এর আগে হাইকোর্ট ডিভিশনের পর্যবেক্ষণ ছিল, সন্তানদের জিম্মার সিদ্ধান্ত পারিবারিক আদালতে হবে। ইমরান শরীফও তা–ই মনে করেন।

ইমরান শরীফ যা বলছেন
* এরিকো নন, মেয়েদের দেখাশোনা ইমরান করেছেন
* সন্তানদের ইচ্ছাকে গুরুত্ব দেওয়ার আবেদন
* সন্তানদের নিরাপত্তার কথা ভেবে বাসায় সিসি ক্যামেরা বসান
* সন্তানদের দেশে নিয়ে আসায় আইন লঙ্ঘন হয়নি

জাপানের পারিবারিক আদালতের রায় ইমরান মানেননি, এই যুক্তির বিপরীতে ইমরান বলেছেন, জাপানের আদালত বাংলাদেশের আদালতের অবস্থানকে অগ্রাহ্য করেছেন।

জিম্মা প্রসঙ্গে জাপানের আইনে বলা আছে, অভিভাবকত্ব আছে এমন ব্যক্তি আদালতের অনুমতি ছাড়া শিশুদের বিদেশে নিতে পারেন। তাই সন্তানদের নিয়ে দেশে আসাকে অপহরণ হিসেবে গণ্য করা যাবে না।

তা ছাড়া বিদেশি কোনো আদালতের রায়ের প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন সম্পর্কে বলা আছে ‘দ্য কোড অব সিভিল প্রসিডিউর,১৯০৮’–এ। পারস্পরিক কোনো চুক্তি না থাকলে এটির প্রয়োগ বা বাস্তবায়নের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। জাহিদা আহমেদ লিজা বনাম সৈয়দ নূর উদ্দিন আহমেদ ও অন্যান্য মোকদ্দমা বাংলাদেশের বাইরের একটি দেশের আদেশ থাকা সত্ত্বেও অভিভাবকত্বের বিষয় বাংলাদেশের আদালতে ফয়সালার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।

বিভিন্ন পর্যায়ে এরিকো নাকানো মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন। তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং টোকিওর মসজিদে তাঁদের বিয়ে হয়েছিল এই তথ্য তিনি প্রথমে চেপে যান। পরে স্বীকার করেন। চোখ বেঁধে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে গিয়ে সন্তানদের সঙ্গে দেখা করানোর কথা বলেছেন, এ তথ্য সত্য নয়। শিশুরা এখন যে স্কুলে যাচ্ছে, সেই স্কুল সম্পর্কে বিকৃত তথ্য দিয়েছেন। তা ছাড়া কানাডিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে অসম্মানজনক একটি চিঠি দিয়েছেন।

ইমরান শরীফ জাপানের আদালতের রায়ে প্রাসঙ্গিক কিছু তথ্য আছে বলে উল্লেখ করেছেন। যেমন, বড় মেয়ে বলেছে, গ্রীষ্মের ছুটিতে যখন তারা নানাবাড়িতে বেড়াতে যায়, তখন তাদের মা স্থানীয় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠায়। তাদের কোনো কথা শোনেন না। তারা বরং বাবার কাছে ভালো থাকে।

মেজ মেয়ে বলেছে, সে স্কুলে ফিরতে চায় এবং পরিবারের সবাইকে নিয়ে থাকতে চায়। তারা আরও বলেছে, জাপানের বাসাগুলো ছোট। এখানে ব্যক্তিগত গোপনীয়তার সুযোগ নেই। মা তাদের কখনো ঘুম পাড়ায়নি। তাদের বাবাকে বাসা থেকে বের করে দিয়েছে।

তারা বাবার সঙ্গে থাকতে চায়। ছোট মেয়ে মা, দুই বোন ও নানির সঙ্গে থাকতে ভালোবাসে বলে জানিয়েছে আদালতকে। বাবার কথা উঠলে চুপ করে থেকেছে।
বাংলাদেশে সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে বিষয়টি দেখভালের জন্য একজন প্রবেশন কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়েছে। তিনি লিখেছেন, ‘এরিকো নাকানোর মেজাজ, ধৈর্য এবং মেয়েদের ‘পালস’ বুঝে চলার ক্ষেত্রে যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে মর্মে পরিলক্ষিত হয়।...বাবা ইমরান শরীফের ওপর মেয়েরা অনেকাংশে নির্ভরশীল।