২৩তম বর্ষপূর্তি
মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই আমাদের চেতনা
ক্রোড়পত্রগুলোর মধ্য দিয়ে তুলে এনেছি একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের বড় বড় সম্মুখসমরের কাহিনি, মুক্তিযুদ্ধে দেশ–বিদেশের সামনের সারির নেতাদের ভূমিকা, জাতিসংঘসহ বিভিন্ন দেশের কর্মকাণ্ড ইত্যাদি।
প্রথম আলো প্রকাশ উপলক্ষে পত্রিকাটি বের হওয়ার এক মাস আগে, ৩ অক্টোবর ১৯৯৮, বাংলাদেশের সুধী সমাজের সদস্যদের নিয়ে একটি প্রীতি সমাবেশ হয়েছিল। সেখানে প্রকাশিতব্য প্রথম আলোর পক্ষ থেকে একটি সবার কাছে অঙ্গীকারপত্র বিলি করা হয়েছিল। সেটির অন্যতম বিষয় ছিল প্রথম আলোর সম্পাদকীয় নীতি ও অবস্থানটি তাঁদের জানানো। খুব স্পষ্ট করে সেখানে বলা ছিল, প্রথম আলোর সম্পাদকীয় নীতি থাকবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে। ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ কথাটিকে আরও ভেঙে বলা হয়েছিল, প্রথম আলো গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা, আপামর মানুষের অধিকার আর দেশের বিকাশের পক্ষে সাংবাদিকতা করবে।
এই অবস্থান নেওয়ার সোজাসাপটা কারণ একটাই। প্রথম আলোর নেতৃত্বের মানুষেরা গভীরভাবে এ কথাটি উপলব্ধি করেছিলেন যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর বাংলাদেশে সাংবাদিকতা করার মূল চেতনা বস্তুত অভিন্ন। তাই প্রকাশের শুরু থেকেই প্রথম আলো মুক্তযুদ্ধ নিয়ে নতুন নতুন তথ্য উদ্ঘাটন, এর নানা মাত্রার বিশ্লেষণ ও তাৎপর্য তুলে ধরা এবং দীর্ঘ স্মৃতিকথা বা সাক্ষাৎকারে এর সঙ্গে জড়িত সামরিক ও বেসামরিক মানুষদের অভিজ্ঞতা ধরে রাখার কর্তব্যনিষ্ঠার সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে প্রথম আলো করে গেছে।
বিনীতভাবে একটি কথা বলাই যায়। অতীতে এমন কিছু কিছু দায়িত্ব এ ক্ষেত্রে প্রথম আলো পালন করেছে, যা হয়তো কোনো গবেষণা প্রতিষ্ঠানেরই সাধ্য ছিল। যেমন খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা কিংবা সারা দেশ থেকে খুঁজে বের করে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পরিচয় দেশবাসীর সামনে ধারাবাহিকভাবে হাজির করা।
এ বছর মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তী, তাই এ কাজে আমরা আরও গভীরভাবে লিপ্ত হয়েছিলাম। এটি ছিল আগের কাজেরই ধারাবাহিকতা, তবে আরও সুসংগঠিতভাবে। ধরা যাক শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পরিচয়। আগেও একবার আমরা তাঁদের পরিচয় খুঁজে বের করেছিলাম। এ বছর আমরা কাজটি আরও ব্যাপকভাবে করে চলেছি।
আমরা যে স্বাধীনতা দিবস বা বিজয় দিবসে বিশেষ ক্রোড়পত্র করেছি, সেটা আলাদা করে বলার বিষয় নয়। এই কথাটা বলতে হয় যে ক্রোড়পত্রগুলোতে আমরা মুক্তিযুদ্ধকে গভীরভাবে অনুসন্ধান করেছি। এসব ক্রোড়পত্রের মধ্য দিয়েই তুলে এনেছি একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের বড় বড় সম্মুখসমরের কাহিনি, মুক্তিযুদ্ধে দেশ–বিদেশের সামনের সারির নেতাদের ভূমিকা, জাতিসংঘসহ বিভিন্ন দেশের কর্মকাণ্ড ইত্যাদি।
নথি প্রসঙ্গে বলতে হয় আমাদের প্রয়াত সাংবাদিক মিজানুর রহমান খানের অনুসন্ধানের কথা। প্রথম আলোর উদ্যোগে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আনা দলিল মন্থন করে তিনি মুক্তিযুদ্ধে দেশটি এবং এর গোয়েন্দা সংস্থার নেপথ্য কীর্তির বহু অজানা তথ্য প্রকাশ করেছিলেন। প্রকাশ করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্মম হত্যাকাণ্ড নিয়েও প্রচুর অজানা তথ্য।
বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, যুক্তরাষ্ট্রসহ নানা দেশে যাঁরা ছিলেন প্রকাশ্যে বা অন্তরালে মুক্তিযুদ্ধের তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী বা নিবিড় প্রত্যক্ষদর্শী, তাঁদের দীর্ঘ বয়ান ও সাক্ষাৎকার আমরা পাঠকদের সামনে হাজির করেছি।
এসব বয়ান, ক্রোড়পত্রগুলোর লেখা, খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা, মিজানুর রহমান খানের অনুসন্ধান নিয়ে প্রথমা প্রকাশন যেসব বই প্রকাশ করেছে, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসচর্চায় সেগুলোর অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকবে।
মুক্তিযুদ্ধের এই সুবর্ণজয়ন্তীতে আমরা সারা বছরের জন্য দুটো বড় কর্তব্য নিজেদের জন্য স্থির করেছিলাম: ১. মুক্তিযুদ্ধের একটি দিনানুদৈনিক পঞ্জি নথিবদ্ধ করা; ২. সারা দেশে অনুসন্ধান চালিয়ে অজানা শহীদ বুদ্ধিজীবীদের খুঁজে বের করা। এ বছরে মার্চ থেকে কর্তব্যটি আমরা পালন করে চলেছি। একাত্তরে প্রকাশিত দেশি–বিদেশি পত্রপত্রিকা, নথি, অজস্র স্মৃতিকথা ঘেঁটে তৈরি করা হচ্ছে একাত্তরের দিনপঞ্জি। আর দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে বিস্মৃত শহীদের তথ্য সংগ্রহ ও যাচাই করে তুলে ধরা হচ্ছে তাঁদের পরিচয়।
প্রতিদিনের এই আয়োজনের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের বড় বড় দিনগুলোতে আমরা বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করেছি। সেগুলোতে ছিল বিশ্লেষণ, স্মৃতিকথা ও নথি। ক্রোড়পত্র বের করেছি ৭ মার্চ (‘স্বাধীনতার আহ্বান’), ২৬ মার্চ (স্বাধীনতার প্রহর’), ১৬ আগস্ট (‘অপারেশন জ্যাকপট’) এবং ২৮ সেপ্টেম্বর (‘মুক্তিযুদ্ধে কিলোফ্লাইট’)। তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা নামে আলাদা করে প্রকাশ করেছি একটি ম্যাগাজিন।
এসবের বাইরে বিশিষ্ট গবেষক ও লেখকদের নিবিড় স্মৃতিচারণধর্মী এবং গভীর বিশ্লেষণমূলক একাধিক লেখা ছাপা হয়েছে। ধারাবাহিকভাবে ছাপা হয়েছে জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ নূরুল ইসলাম ও রেহমান সোবহানের আত্মস্মৃতি, একাধিক পর্বে মঈদুল হাসানের বিশেষ বিশ্লেষণী রচনা এবং নতুন নথির ভিত্তিতে জি সি দেব ও জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার হত্যাকাণ্ড এবং যুদ্ধকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রথম মা হওয়ার অভিজ্ঞতা নিয়ে শাহাদুজ্জামান ও খায়রুল ইসলামের লেখা।
স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষেও প্রথম আলো সারা বছর ধরে একাধিক বিশেষ ক্রোড়পত্র করেছে। প্রথম পৃষ্ঠা ও সম্পাদকীয় পাতায় ছেপেছে তাঁকে নিয়ে দেশের সেরা লেখক–গবেষকদের বিশ্লেষণধর্মী লেখা।
তবে এ বছর প্রথম আলোর সবচেয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রকল্প বোধ করি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটি ডিজিটাল মহাফেজখানা উদ্বোধন করা। আমাদের স্বপ্ন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিচিত্রধর্মী তথ্য, অজস্র ছবি, অডিও–ভিডিও সাক্ষাৎকার, প্রামাণ্যচিত্র, দলিলপত্রের সমাহারে একে একটি ডিজিটাল জাদুঘরে উন্নীত করা।
অনুসন্ধানীদের জন্য সহজে ব্যবহারোপযোগী এই মহাফেজখানা হবে আমাদের পক্ষ থেকে জাতির জন্য উপহার; কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের প্রতি প্রথম আলোর বিনীত ঋণ স্বীকার। কারণ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই যে প্রথম আলোর ধমনিতে প্রবাহিত চেতনা।
লাজ্জাত এনাব মহছি: উপসম্পাদক