মুক্তিযুদ্ধে কত শরণার্থী মারা গেছে তার হিসাব নেই
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় শরণার্থী জীবনের স্মৃতিচারণা করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য কালিপদ হালদার বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা হিসাব করা হয়। কিন্তু কত মানুষ শরণার্থী অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছে, তার কোনো হিসাব নেই।
আন্তর্জাতিক শরণার্থী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় গতকাল শনিবার কালিপদ হালদার এ কথা বলেন। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর রাজধানীর সেগুনবাগিচায় নিজস্ব মিলনায়তনে এ আলোচনা সভার আয়োজন করে।
একাত্তরে কালিপদ হালদার ছিলেন ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। বাগেরহাট পৌরসভার পেছনে তাঁর পৈতৃক বাড়ি। একাত্তরের ২৪ এপ্রিল বাগেরহাটে পাকিস্তানি সেনাদের হামলার পর তাঁরা সপরিবারে উদ্বাস্তু হন। গতকাল সেই উদ্বাস্তু জীবনের স্মৃতিচারণা করে কালিপদ বলেন, ‘একেক দিন একেকজনের বাড়িতে আশ্রয় নিতাম। ওই সময় আমাদের প্রতিটি রাত আসত আতঙ্কের মধ্য দিয়ে। একসময় আমরা সবাই ভারতে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। দিন-তারিখের কোনো হিসাব আমাদের কাছে ছিল না। টানা চার দিন কোনো খাবার না খেয়ে কখনো হেঁটে, কখনো লঞ্চে চড়ে পশ্চিম বাংলার হাসনাবাদে পৌঁছাই। সেখানে কিছুদিন স্বজনদের বাসায় ছিলাম। একপর্যায়ে শরণার্থী শিবিরে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন আমার বাবা।’
স্মৃতি হাতড়ে কালিপদ হালদার জানান, পশ্চিম বাংলার বারাসাত জংশন থেকে চার-পাঁচ দিনে রেলযাত্রা শেষে তাঁরা পৌঁছান রায়পুর জংশন। সেখান থেকে শরণার্থী ক্যাম্পে। তাঁরা যে ক্যাম্পটিতে থাকতেন, সেটির নাম ছিল নওগাঁ। ওই ক্যাম্পে প্রায় ৬৬ হাজার শরণার্থী ছিল। একাত্তরের ১৩ আগস্ট তাঁরা সেই শিবিরে পৌঁছান।
শরণার্থী শিবিরে দুর্বিষহ জীবনের বিবরণ দিয়ে কালিপদ বলেন, ছিল পানির সংকট, শৌচাগার সংকট। শীত আসার আগে আগে শিবিরে রোগবালাই শুরু হয়ে যায়, এতে শিশু ও বৃদ্ধরা আক্রান্ত হয় বেশি। শিবিরের বাইরে চিতা জ্বালানোই থাকত, প্রতিদিন রাতে কেউ না কেউ মারা যেতেন আর তাঁকে চিতায় দাহ করা হতো। তাঁদের পরিবারের সাত সদস্যের মধ্যে তাঁর ঠাকুরমা ওই শিবিরেই মারা যান। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের বেশ পরে দেশে ফিরে আসেন কালিপদ ও তাঁর পরিবার। তিনি জানান, ওই সময়ে ক্যাম্পের জনসংখ্যা প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছিল। কালিপদ বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রায় এক কোটি মানুষ ভারতে শরণার্থী হিসাবে আশ্রয় নিয়েছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তারা একটি বিকলাঙ্গ মন নিয়ে দেশে ফিরে এসেছে।
আলোচনা সভায় আরও বক্তব্য দেন জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনের (ইউএনএইচসিআর) অ্যাসিসট্যান্ট প্রটেকশন অফিসার ফাহমিদা করিম ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি জিয়াউদ্দিন তারিক আলী। তাঁরা বলেন, বিশ্বে প্রতিদিন এক হাজার মানুষ শরণার্থী হিসাবে আশ্রয় খুঁজছেন। বিশ্বজুড়ে শরণার্থীর সংখ্যা পাঁচ কোটি। গৃহযুদ্ধ, সহিংসতা ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতায় প্রতিবছর শরণার্থীর সংখ্যা বাড়ছে। তাই মানবিক কারণে প্রত্যেক দেশের শরণার্থীদের পাশে দাঁড়ানো উচিত।