১৭ মে ২০২১। রোজকার মতো সংবাদ সংগ্রহের জন্য সচিবালয়ে যান রোজিনা ইসলাম। কিন্তু সেখান থেকে আর স্বাভাবিক নিয়মে ফিরতে পারেননি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে ওই দিন বেলা তিনটা থেকে প্রায় ছয় ঘণ্টা তাঁকে আটকে রেখে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়। পরে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় শাহবাগ থানায়। সেখানে প্রায় ১১ ঘণ্টা পুলিশি হেফাজতে ছিলেন। এর মধ্যেই থানায় তাঁর বিরুদ্ধে অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টে মামলা দেওয়া হয়। সেই মামলায় পরদিন তাঁকে পাঠানো হয় কারাগারে।
প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রোজিনা ইসলামকে এভাবে আটকে রেখে হেনস্তা করা এবং মামলা দিয়ে কারাগারে পাঠানোর ঘটনায় দেশজুড়ে সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পেশাজীবী মহলে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।
রোজিনা ইসলাম নিয়োগ–বাণিজ্যসহ করোনাকালে স্বাস্থ্য খাতের নানা অনিয়ম-দুর্নীতি এবং করোনার টিকার বিষয়ে একের পর এক প্রতিবেদন লিখেছেন। যার কারণে তাঁর ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ ব্যক্তিরা। রোজিনা যে আক্রোশের শিকার হয়েছিলেন, সেটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে তাঁকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে দীর্ঘ সময় আটকে রেখে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের মধ্য দিয়ে। আক্রোশটা আরও স্পষ্ট হয় ১০০ বছরের পুরোনো অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টে মামলার মধ্য দিয়ে। ১৯২৩ সালের এই আইনে এর আগে কোনো সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে কি না, জানা যায়নি। স্বাধীন দেশে এই আইনের সর্বশেষ ব্যবহারও স্মরণাতীত।
রোজিনাকে গ্রেপ্তারের পরপরই পুরো সাংবাদিক সমাজ প্রতিবাদে, বিক্ষোভে রাস্তায় নামে। রোজিনার মুক্তি ও মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে জাতীয় প্রেসক্লাব, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি, বাংলাদেশ সেক্রেটারিয়েট রিপোর্টারস ফোরাম, বাংলাদেশ হেলথ রিপোর্টার্স ফোরামসহ দলমত-নির্বিশেষে রাজধানীর ও সারা দেশের সাংবাদিক সংগঠনগুলো সোচ্চার হয়। উদ্বেগ ও নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে সম্পাদক পরিষদ, এডিটরস গিল্ড ও সংবাদপত্র মালিকদের সংগঠন নোয়াব। নিন্দা, ক্ষোভ ও প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন বুদ্ধিজীবী, মানবাধিকারকর্মী, আইনজীবী, শিল্পী ও সংস্কৃতিসেবীরা। শিক্ষক, পেশাজীবী, নাগরিক সংগঠন এবং অনেক রাজনৈতিক দলও এই সময়ের আলোচিত এই নারী সাংবাদিকের মুক্তির আন্দোলনে শামিল ছিল। পাশাপাশি জাতিসংঘ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে), ইন্টারন্যাশনাল প্রেস ইনস্টিটিউট, রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ), গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম নেটওয়ার্ক (জিআইজেএন), পিইএন বাংলাদেশ, সাউথ এশিয়ান উইমেন ইন মিডিয়াসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান রোজিনার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তাঁর মুক্তি ও মামলা প্রত্যাহার চেয়েছে। ওয়াশিংটন পোস্ট, আল-জাজিরাসহ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমও এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রচার করেছে। অনেক সাধারণ নাগরিকও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্ষোভ জানিয়েছেন। সবাই এ ঘটনাকে মুক্ত সাংবাদিকতার ওপর আঘাত বলে বর্ণনা করেছেন।
সর্বশেষ নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডামভিত্তিক ফ্রি প্রেস আনলিমিটেড রোজিনা ইসলামকে ‘সাহসী সাংবাদিক’ হিসেবে পুরস্কারে ভূষিত করেছে। ২ নভেম্বর দিবাগত রাত ১২টায় তাঁকে এ পুরস্কার দেওয়া হয়।
ক্ষোভ-বিক্ষোভ এবং আন্দোলন-প্রতিবাদের মধ্যেই আদালতের আদেশে পাঁচ দিন পর কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পান রোজিনা ইসলাম। সেখান থেকে তাঁকে ভর্তি করানো হয় হাসপাতালে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে আটক ও নিগ্রহের সময়ই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তাঁকে চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এক সপ্তাহ পর হাসপাতাল থেকে বাসায় ফেরেন তিনি।
রোজিনাকে নিগ্রহ, নির্যাতন ও মামলা দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি সরকারি মহল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা রকম অপপ্রচার চালিয়ে তাঁর সম্মানহানির চেষ্টা চলে। তবে এসব অপচেষ্টা শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি, বরং সাহসী ও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জন্য রোজিনার সুনাম-সম্মান দেশের গণ্ডির বাইরেও ছড়িয়েছে।
৫০ দিন পর, ৭ জুলাই নিজ কর্মক্ষেত্র প্রথম আলো কার্যালয়ে ফেরেন রোজিনা। সহকর্মীরা তাঁকে ফুল দিয়ে বরণ করেন। কাজে ফিরলেও এখনো স্বস্তিতে নেই রোজিনা। মামলার খড়্গ এখনো রয়ে গেছে। তাঁর পেশাগত কাজের জন্য সচিবালয়ে যাওয়ার পাস বা অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড এখনো জব্দ রয়েছে। তাঁর পাসপোর্টও জব্দ। সাংবাদিকের ওপর মামলার খড়্গ রেখে কেবল অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় বাধার সৃষ্টিই করা হচ্ছে না, মানুষের তথ্য জানার অধিকারকে সংকুচিত করা হচ্ছে।
রোজিনা ইসলাম সাংবাদিক পেশায় নিজ কাজের জন্য গত দেড় যুগে অনেকগুলো পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি ডিআরইউ সেরা প্রতিবেদক পুরস্কার পেয়েছেন চারবার (২০১১, ২০১৪, ২০১৭ ও ২০২১ সালে)। প্রথম আলোর বছরের সেরা প্রতিবেদক নির্বাচিত হয়েছেন একাধিকবার।
রোজিনা ইসলাম আরও পেয়েছেন ২০০৩ সালে শিশু অধিকার সপ্তাহ পুরস্কার, ২০০৫ সালে বিসিডিজেসির সেরা নারী অর্থনৈতিক প্রতিবেদক পুরস্কার, ২০০৬ সালে ইউনেসকো ক্লাব সাংবাদিক পুরস্কার, ২০১১ সালে কানাডিয়ান অ্যাওয়ার্ড ফর এক্সিলেন্স ইন বাংলাদেশি জার্নালিস্ট, ইউনেসকো পুরস্কার ২০১১, অ্যাসিড সারভাইভরস ফাউন্ডেশন মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড ২০১২, অনন্যা পুরস্কার ২০১৩, মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড অন করাপশন প্রিভেনশন ইন বাংলাদেশ (২০১৪), টিআইবি অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা পুরস্কার ২০১৫, বেঙ্গল সি ফেস্ট অ্যাওয়ার্ড ২০১৬, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ পুরস্কার, মাদকবিরোধী রিপোর্টিং পুরস্কার ২০১৭ ও নিটোল আইয়াত-নিউজ নাও বেঙ্গল এক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ড ২০১৮।
সর্বশেষ নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডামভিত্তিক ফ্রি প্রেস আনলিমিটেড রোজিনা ইসলামকে ‘সাহসী সাংবাদিক’ হিসেবে পুরস্কারে ভূষিত করেছে। গতকাল ২ নভেম্বর দিবাগত রাত ১২টায় তাঁকে এ পুরস্কার দেওয়া হয়।
টিপু সুলতান: হেড অব রিপোর্টিং