মা-বাবার পা ধুইয়ে দেওয়া সন্তান জঙ্গিবাদে জড়ায় না
জীবনে প্রথম বাবাকে কোলে নিলাম। ছোটবেলায় যেভাবে আমাকে কোলে নিত বাবা! বেঁচে থাক বাবা হাজার বছর। প্রায় পাঁচ হাজার মানুষের সামনে মনে হচ্ছিল, আমার বাচ্চাটা আমার কোলে ছিল। এমন কিছু কথা লিখে বাবাকে কোলে নেওয়া ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করেছেন ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির (ডিআইইউ) শিক্ষার্থী হাবিবুর রহমান সবুজ। কেউ মা–বাবাকে চুমু খাচ্ছে! কেউবা জড়িয়ে ধরেছে, এমনকি পা ধুয়ে দিচ্ছে—এ ধরনের অসংখ্য হৃদয় স্পর্শ করা ছবি ঘুরছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
১৮ অক্টোবর ডিআইইউর স্থায়ী ক্যাম্পাস আশুলিয়ায় আর্ট অব লিভিং কোর্সের আয়োজনে হয়ে গেল প্যারেন্টস ডে। প্রায় দুই হাজার অভিভাবকের সঙ্গে দিনটি উদ্যাপন করেন বিশ্ববিদ্যালয়টির অসংখ্য শিক্ষার্থী।
দিনব্যাপী এই অনুষ্ঠানে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে উপস্থিত হয়েছিলেন শিক্ষার্থীদের মা–বাবারা। জাতীয় সংগীত ও পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়। এরপর প্রত্যেক শিক্ষার্থী মা–বাবাকে পা ধুইয়ে দেন। তারপর শুরু হয় মিলনায়তনের ভেতর মূল অনুষ্ঠান। মিলনায়তন ভর্তি মা–বাবাসহ শিক্ষার্থীরা অধিকাংশ সময়ই কান্না করছিলেন। এ কান্না আনন্দের কান্না, ভালোবাসার কান্না, সুসম্পর্কের কান্না। এমন হাজারো শিক্ষার্থী আছে, হয়তো এই এক দিনই শুধু মা–বাবাকে জড়িয়ে ধরেছে, কপালে চুমু খেয়েছে।
দিনব্যাপী অনুষ্ঠানে মা–বাবাদের প্রত্যেক পর্বে ছিল স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। কেউ গেয়েছেন গান, কেউবা নাচ বা অভিনয়, আবার ফাঁকে ফাঁকে স্মৃতিচারণা। মা–বাবা ও সন্তান মিলে গলা মিলিয়েছেন অসংখ্য গানে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিরেক্টর অব স্টুডেন্ট অ্যাফেয়ার্সের পরিচালক সৈয়দ মিজানুর রহমানের সঞ্চালনার প্রত্যেক বাঁকে ছিল চমক ও আত্মিক বন্ধনের সুর।
দেশের শেষ প্রান্তের জেলা কুড়িগ্রাম থেকে আসা এক পিতা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলছিলেন, ‘আমি আজ অনেক খুশি, আমার জীবনে আর কোনো চাওয়া–পাওয়া নেই। আমার সন্তান দীর্ঘদিন ধরে আমার সঙ্গে কথা বলত না। বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অনুষ্ঠানে আসার পর আমার সন্তান শপথ নিয়েছে, মা-বাবাকে আর কোনো দিন কষ্ট দেবে না। এর চেয়ে বড় আনন্দ আর কী হতে পারে! আমি পৃথিবীর প্রত্যেক সন্তানকে বলব, তোমরা তোমাদের পিতা–মাতাকে সম্মান করো, শ্রদ্ধা করো।’
ঝালকাঠি জেলায় বাড়ি রোকেয়া বেগমের। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এসেছেন অনুষ্ঠানে, তিনি বলেন, ‘আমি খুবই অসুস্থ। তবে এই অনুষ্ঠানে এসে অনেকটাই সুস্থতা অনুভব করছি। আজ যেভাবে প্রত্যেক সন্তান তাঁর মা–বাবাকে সম্মান, ভক্তি, শ্রদ্ধা করল, এভাবে দেশের প্রত্যেক শিক্ষার্থী করলে দেশে কোনো সন্তান মাদকাসক্ত, ছিনতাইকারী, জঙ্গি হতো না। পরিবারের বন্ধনে আবদ্ধ কোনো সন্তান অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে না। পিতা–মাতাকে পা ধুয়ে দেওয়া কোনো সন্তান জঙ্গি হতে পারে না। এসব শিক্ষা এ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা একাডেমিকভাবে পাচ্ছে। এটা খুবই আশার কথা।’
প্যারেন্টস ডে–তে আসা প্রায় প্রত্যেক মা-বাবাই একই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন, প্রত্যেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমন শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা উচিত। এমন শিক্ষায় শিক্ষিত কোনো সন্তান তাঁর পিতা–মাতাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাতে পারেন না। অভিভাবককে সম্মান করা, ভক্তি করা সন্তান জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়তে পারে না। দেশে অনেক সন্তান খুন, ধর্ষণ, সন্ত্রাসবাদে জড়িয়ে পড়ছে। তবে আশার দিক হলো, কিছু সন্তান তো পিতা-মাতার পা ধুয়ে দেওয়ার শিক্ষাও পাচ্ছে। তাই আশাবাদী, একটি সুন্দর দেশ গড়বে এ প্রজন্ম। দিনব্যাপী এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ডিআইইউর চেয়ারম্যান মো. সবুর খান।
লেখক: ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির আর্ট অব লিভিংয়ের শিক্ষক