মাহবুব তালুকদারের বক্তব্যে ক্ষোভ ঝাড়লেন সিইসি
নির্বাচনে সবার জন্য সমান সুযোগ (লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড) থাকছে না। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রার্থী জয়ী হয়ে যাচ্ছেন। আগের রাতে ভোট হয়ে যায়। এমন নানা অসংগতি তুলে ধরে আজ মঙ্গলবার এক আলোচনা সভায় বক্তৃতা করেন নির্বাচন কমিশনার (ইসি) মাহবুব তালুকদার।
ইসি মাহবুব তালুকদারের এমন বক্তব্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা। পাল্টা হিসেবে সিইসি বলেছেন, মাহবুব তালুকদার কমিশনকে হেয়, অপদস্থ ও নিচে নামানোর জন্য যা করা দরকার সবই করে চলেছেন। তিনি (মাহবুব তালুকদার) ব্যক্তিগত স্বার্থে ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কমিশনকে হেয় করছেন।
আজ মঙ্গলবার ‘জাতীয় ভোটার দিবস’ উপলক্ষে নির্বাচন ভবনে ওই আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। সভায় এমন পাল্টাপাল্টি বক্তব্য উঠে আসে। এর আগেও নির্বাচনে অনিয়ম নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন মাহবুব তালুকদার। কমিশন থেকেও যথাসম্ভব ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু একই মঞ্চে বসে কে এম নূরুল হুদা ও মাহবুব তালুকদারের মধ্যে পাল্টাপাল্টি এমন বক্তব্য খুব একটা দেখা যায়নি। এ সময় নির্বাচন কমিশনের কমিশনার ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
ভোটার দিবস উপলক্ষে মাহবুব তালুকদার প্রথমে লিখিত বক্তব্যে বিভিন্ন অনিয়ম তুলে ধরেন। শেষে সিইসি তাঁর বক্তব্যের জবাব দেন।
মাহবুব তালুকদারের কঠোর সমালোচনা করে সিইসি বলেন, ‘মাহবুব তালুকদার সাহেব অভ্যাস গতভাবে সারা জীবন আমাদের এ নির্বাচন কমিশনে যোগ দেওয়ার পরদিন থেকে যা কিছু ইসির নেগেটিভ দিক তা পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে পাঠ করতেন। আজকেও এর ব্যতিক্রম হয়নি।’
সিইসি বলেন, ‘দেশের নির্বাচন কমিশনের স্বার্থে তিনি কাজ করেন না। ব্যক্তিস্বার্থে ও একটা উদ্দেশ্য সাধন করার জন্য এ কমিশনকে অপদস্থ করার জন্য যতটুকু করা দরকার, ততটুকু করেছেন উনি।’
সিইসি আরও বলেন, ভেবেছিলাম ভোটার দিবস হিসেবে তিনি কিছু বলবেন। কিন্তু তিনি রাজনৈতিক বক্তব্য রাখলেন। ইসিকে কতখানি হেয় করা যায়, কতখানি নিচে নামানো যায়, অপদস্থ করা যায় তা তিনি করে চলেছেন।
এর আগে মাহবুব তালুকদার বলেন, স্থানীয় নির্বাচনগুলোর গতিপ্রকৃতি দেখে আমার ধারণা হচ্ছে, বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচনের যে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ ও ভারসাম্য রক্ষিত হওয়ার প্রয়োজন ছিল, তা হচ্ছে না। এক কেন্দ্রীয় নির্বাচনে স্থানীয় নির্বাচনের তেমন গুরুত্ব নেই, নির্বাচনে মনোনয়ন লাভই এখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। স্থানীয় নির্বাচনেও হানাহানি, মারামারি, কেন্দ্র দখল, ইভিএম ভাঙচুর ইত্যাদি মিলে এখন একটা অনিয়মের মডেল তৈরি হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে সংগঠিত এসব ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলা হলেও অসংখ্য বিচ্ছিন্ন ঘটনা বা দুর্ঘটনা মিলে এক ধরনের অবিছিন্নতা তৈরি হয়, যা নির্বাচনের অনুষঙ্গ হিসেবে রূপ লাভ করে।
সম্প্রতি চট্টগ্রামের রাউজান পৌরসভার ভোটের উদাহরণ দিয়ে মাহবুব তালুকদার বলেন, বাংলাদেশে সবচেয়ে চমক সৃষ্টিকারী পৌরসভা নির্বাচন হয়েছে চট্টগ্রামের রাউজানে। মেয়র ও ১২ জন কাউন্সিলর বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। ফলে রাউজান থেকে নির্বাচনসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও তখন তুলে নেওয়া হয়েছে। এর আগে উপজেলা নির্বাচনেও ঠিক এভাবে রাউজানে সবাই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। তবে এটা ‘নির্বাচন’ না বলে ‘মনোনয়ন’ বলাই সম্ভবত অধিকতর সংগত। সারা দেশে যদি এই মডেলে সবাই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জনপ্রতিনিধি হতে পারেন, তাহলে নির্বাচনে অনেক আর্থিক সাশ্রয় হয় এবং সহিংসতা ও হানাহানি থেকে রেহাই পাওয়া যায়। এতে নির্বাচন কমিশনের দায়-দায়িত্ব তেমন থাকবে না। এ অবস্থায় নির্বাচন কমিশনের আর প্রয়োজন হবে কি না, সেটা এক বড় প্রশ্ন।
নির্বাচন প্রক্রিয়ার সংস্কার না হলে সুষ্ঠু অবাধ নিরপেক্ষ গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব নয় উল্লেখ করে মাহবুব তালুকদার বলেন, সংস্কার না হলে নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা প্রায় অকার্যকর হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে সংশ্লিষ্ট সব মহলের ইতিবাচক উদ্যোগ গ্রহণ প্রয়োজন। নির্বাচন প্রক্রিয়ার সংস্কার না হলে এখন যে ধরনের নির্বাচন হচ্ছে, তার মান আরও নিম্নগামী হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।