মামলা নিয়েই ভয় বিএনপির

>

• ৬০ প্রার্থীর হলফনামা
• ছয় মহানগরে তিন প্রার্থীর প্রত্যেকে দুই শর বেশি মামলার আসামি।
• এক শর ওপরে দুজনের বিরুদ্ধে।
• ১৫ প্রার্থীর বিরুদ্ধে কোনো মামলা নেই।
• সর্বোচ্চ ২৬৭টি মামলা নিয়ে ঢাকা-১২ আসনে প্রার্থী হয়েছেন যুবদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাইফুল আলম ওরফে নীরব।
• যুবদলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর বিরুদ্ধে ২১২টি মামলা।
• যুবদলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মামুন হাসানের বিরুদ্ধে ঢাকায় ১৬৪টি মামলা রয়েছে।
• ঢাকা মহানগর যুবদলের (উত্তর) সভাপতি এস এম জাহাঙ্গীর। তিনি ১৩৮ মামলার আসামি। 

বিএনপির অন্তত পাঁচজন নেতা এক শর ওপর মামলা মাথায় নিয়ে এবারের সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন। আবার মামলায় দণ্ডিত হওয়ায় নির্বাচনে অযোগ্য হয়েছেন দলটির প্রধান খালেদা জিয়াসহ অর্ধশতাধিক নেতা।

ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, রংপুর ও সিলেট বিভাগীয় শহর এবং আশপাশের আসনে বিএনপির ৬০ জন প্রার্থীর হলফনামা বিশ্লেষণ করে এ তথ্য পাওয়া গেছে। দুই শর ওপরে মামলা রয়েছে তিনজনের বিরুদ্ধে, এক শর ওপর দুজনের বিরুদ্ধে। আর ৫০ টির ওপর মামলা আছে এমন প্রার্থীর সংখ্যা চার। ১৫ জন রয়েছেন যাঁদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা নেই।

বেশির ভাগ মামলাই হয়েছে নাশকতা, সরকারি কাজে বাধা, পুলিশের ওপর হামলা ইত্যাদি অভিযোগে। মামলাগুলোতে বিশেষ ক্ষমতা আইন, সন্ত্রাসবিরোধী আইন ও বিস্ফোরকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের পাশাপাশি দণ্ডবিধির বিভিন্ন ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়ের করা মামলার আসামি হয়েছেন বেশ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতা। কয়েকজনের বিরুদ্ধে হত্যা, অর্থ পাচারের মতো অভিযোগও আছে।

দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিরুদ্ধে রয়েছে ৪৬টি মামলা। এর মধ্যে ১৬টি চলমান, ২০ টির কার্যক্রম স্থগিত করেছেন আদালত। তাঁর বিরুদ্ধে ২০১৩ সালে সর্বাধিক ১৩টি এবং ২০১২ সালে ১২টি মামলা হয়েছে। নাশকতা, বিস্ফোরণ, ভাঙচুর, সহিংসতা ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগে এসব মামলা হয়েছে।

বিএনপির দাবি, এসব মামলা রাজনৈতিকভাবে হয়রানির উদ্দেশ্যে করা। পুলিশ ফৌজদারি মামলার আসামিদের গ্রেপ্তারের ঘোষণা দিয়ে রেখেছে। এর মধ্যে একাধিক প্রার্থী গ্রেপ্তারও হয়েছেন। দলটির নেতারা বলছেন, মামলার ভয় আর বোঝা নিয়েই তাঁরা নির্বাচনে নেমেছেন। কিন্তু এখন প্রার্থীদের গ্রেপ্তার করা হলে ভোট করা কঠিন হয়ে পড়বে।

সর্বোচ্চ ২৬৭টি মামলা নিয়ে ঢাকা-১২ আসনে প্রার্থী হয়েছেন যুবদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাইফুল আলম ওরফে নীরব। রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে জমা দেওয়া তাঁর ২২ পাতা হলফনামার ১৮ পাতাই মামলার তালিকা। সব কটি মামলাই হয়েছে ২০১০ সালের পরে। বিভিন্ন ধরনের নাশকতার অভিযোগে বিশেষ ক্ষমতা আইন, সন্ত্রাসবিরোধী আইন ও বিস্ফোরক আইনে দায়ের হওয়া মামলার সংখ্যাই বেশি। ঢাকার পল্টন, মতিঝিল থানায় মামলা সবচেয়ে বেশি। এ ছাড়া শাহবাগ, তেজগাঁও, রমনা, শাহজাহানপুর, মিরপুর, শেরেবাংলা নগর ও যাত্রাবাড়ী থানাতেও মামলা রয়েছে সাইফুলের বিরুদ্ধে। কিছু মামলার কার্যক্রম স্থগিত থাকলেও বেশির ভাগ মামলারই বিচার বা তদন্ত চলছে।

সাইফুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এসবই রাজনৈতিক মামলা। আওয়ামী লীগ সরকার আমাকে একটু বেশিই ভালোবাসে, তো তাই এতগুলো দিয়েছে! এগুলো নিয়েই মাঠে থাকব আমরা।’ তিনি বলেন, ‘আমি সব খবরাখবর নিয়ে ২৬৭টি মামলার তথ্য পেয়েছি। আরও মামলা থাকতে পারে।’

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের সূত্রের দাবি, সাইফুল আলম বিশাল একটা নাশকতাকারী দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও আশ্রয়দাতা। ঢাকায় গাড়ি পোড়ানো, বাসে আগুন, ককটেল বিস্ফোরণ-এসবের পেছনের ব্যক্তিটি তিনি। ককটেল তৈরি করে নিক্ষেপকারীদের হাতে পৌঁছে দেওয়া, নাশকতাকারীদের টাকাপয়সা দেওয়া, ধরা পড়লে সহায়তা দেওয়া-পর্দার আড়ালে থেকে এসব করেছেন সাইফুল।

তবে বিএনপি বলছে, যুবদলের সভাপতি হিসেবে ঢাকায় নাশকতা হলেই পুলিশ সাইফুলের বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছে। ঢাকার পল্টন, মতিঝিল, বিশ্ববিদ্যালয়, শাহবাগ এলাকায় কোনো ঘটনা ঘটামাত্রই পুলিশ বাদী হয়ে যে মামলাগুলো হয়েছে, সেগুলোর ‘কমন আসামি’ সাইফুল। বিশেষ করে ২০১৩ ও ২০১৪ সালে বিএনপির ডাকা অবরোধের সময় ঢাকায় প্রচুর মামলার আসামি হয়েছেন তিনি।

সাইফুল আলমের পরে আছেন ঢাকা-৫ আসনে প্রার্থী নবী উল্লাহ। তিনি ২২১টি মামলার আসামি। মামলাগুলো হয়েছে যাত্রাবাড়ী, পল্টন, মতিঝিল, শাহবাগ ও রমনা থানায়। কিছু মামলা হয়েছে ডেমরা, ওয়ারী ও কদমতলী থানায়। বেশির ভাগ মামলাতেই তিনি জামিনে রয়েছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে হলফনামায়। আবার অনেকগুলো মামলার কার্যক্রম স্থগিত আছে।

যুবদলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর বিরুদ্ধে আছে ২১২টি মামলা। তিনি কারাগারে আছেন। প্রার্থী হয়েছেন টাঙ্গাইল-২ আসনে। যুবদলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মামুন হাসান ঢাকা-১৫ আসনের প্রার্থী। তাঁর বিরুদ্ধে ঢাকায় ১৬৪টি মামলা রয়েছে। ঢাকা-১৮ থেকে প্রার্থী হয়েছেন মহানগর যুবদলের (উত্তর) সভাপতি এস এম জাহাঙ্গীর। তিনি ১৩৮ মামলার আসামি।

ঢাকা-৯ আসনে প্রার্থী হয়েছেন ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রশীদ। তাঁর বিরুদ্ধে মামলা আছে ৮০টি। ঢাকা-৪-এর প্রার্থী সাবেক সাংসদ সালাহ উদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে ৮০টি মামলা আছে। এ ছাড়া পুরোনো ১৪টি মামলা থেকে তিনি খালাস পেয়েছেন। একই আসনে প্রার্থী হওয়া সালাহ উদ্দিনের ছেলে তানভীর আহমেদের বিরুদ্ধে রয়েছে ৭৫টি মামলা। বাবা-ছেলে সব মামলাতেই জামিনে রয়েছেন বলে হলফনামায় জানানো হয়। বেশির ভাগ মামলাই হয়েছে তাঁদের নির্বাচনী এলাকায় শ্যামপুর, যাত্রাবাড়ী, ডেমরা ও কদমতলী থানা এলাকায়। এ ছাড়া রমনা ও শাহবাগ থানায় দায়ের হওয়া কয়েকটি মামলারও আসামি তানভীর। ঢাকা-১২ (তেজগাঁও)-এর প্রার্থী আনোয়ারুজ্জামানের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে ৭২টি। সব কটিই দায়ের হয়েছে ২০১২ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে। এগুলোর মধ্যে ২৪টি তদন্তাধীন, বাকিগুলোর বিচার চলছে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের বিরুদ্ধে এখনো ৪২টি মামলা আছে। তিনি লড়ছেন ঢাকা-৮ আসন থেকে। সর্বশেষ গত ১৪ নভেম্বর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে দলের মনোনয়ন ফরম বিক্রির সময় সংঘাতের ঘটনায় দায়ের করা তিনটি মামলাতেও তাঁকে আসামি করা হয়েছে। তাঁর ১২টি মামলার কার্যক্রম হাইকোর্টের আদেশে স্থগিত হয়েছে। পাঁচটি মামলা এখনো তদন্তাধীন। বাকিগুলো বিচারাধীন।

৪১টি মামলার আসামি হয়ে নির্বাচনে আছেন ঢাকা-৬ আসনের প্রার্থী কাজী আবুল বাশার। এর মধ্যে ১৪টি মামলা বিচারাধীন। বাকিগুলোর তদন্ত চলছে।
চট্টগ্রাম নগর বিএনপির সভাপতি শাহাদাত হোসেন চট্টগ্রাম-৯ আসনে প্রার্থী হয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে ৪০টি। চট্টগ্রাম-১১ আসনে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর বিরুদ্ধে ১৪টি মামলা রয়েছে।

রাজশাহী-১ আসনের প্রার্থী আমিনুল হকের বিরুদ্ধে ১৯টি মামলা আছে, সব কটিই বিচারাধীন। রাজশাহী-৫ আসনে নাদিম মোস্তফা ১৮টি মামলার আসামি। রাজশাহীর সাবেক মেয়র মিজানুর রহমান মিনুর নামে আছে ১৫টি মামলা। এর মধ্যে ১০টি বিচারাধীন, ৪ টির কার্যক্রম স্থগিত ও ১টি মামলায় তিনি খালাস পেয়েছেন বলে হলফনামায় উল্লেখ করেছেন।

মামলা নেই ছয় বিভাগীয় শহরে বিএনপির এমন প্রার্থী আছেন ১৫ জন। তাঁরা হলেন ঢাকা-১০ আসনে আবদুর মান্নান, ঢাকা-৭ আসনে মীর নেওয়াজ আলী, সিলেট-৩ আসনে আবদুস সালাম, শফি আহমেদ চৌধুরী, সিলেট-১ আসনে ইনাম আহমদ চৌধুরী, সিলেট-২ আসনে তাহসিনা রুশদীর ও আবরার ইলিয়াস (বিএনপির নিখোঁজ নেতা ইলিয়াস আলীর স্ত্রী ও ছেলে), সিলেট-৫ আসনে শরীফ আহমেদ লস্কর, মামুনুর রশীদ, সিলেট-৬ আসনে ফয়সাল আহমেদ চৌধুরী, রংপুর-৩ আসনে রিটা রহমান, রংপুর-২ আসনে মোহাম্মদ আলী সরকার, রংপুর-১ আসনে ওয়াহেদুজ্জামান, খুলনা-৩ আসনে রকিবুল ইসলাম, খুলনা-৪ আসনে শরীফ শাহ কামাল।

খুলনা-৫ আসনে ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করছেন জামায়াত নেতা মিয়া গোলাম পরওয়ার। তাঁর বিরুদ্ধে কোনো মামলা নেই বলে হলফনামায়
উল্লেখ আছে।