মৃতদেহের কোনো নাম পরিচয় নেই, দেহ গ্রহণ করতেও আসেনি কোনো আত্মীয়স্বজন—সেই মৃতদেহের সৎকার করতে একমাত্র ভরসা আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম। বছর দুই আগে একটি প্রতিবেদন তৈরির কাজে প্রতিষ্ঠানটির গেন্ডারিয়া কার্যালয়ে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। বেওয়ারিশ লাশ দাফনের চিরচেনা প্রতিষ্ঠানটি আরও যে কত রকম সামাজিক উদ্যোগের সঙ্গে জড়িত, তার কিছুটা আঁচ পাওয়া গিয়েছিল গেন্ডারিয়ার অক্ষয় দাস লেনে যাওয়ার পর।
এখানেই রয়েছে ছেলেমেয়েদের জন্য দুটি এতিমখানা, নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়, কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে মাধ্যমিক বিদ্যালয়। এতিমখানায় কয়েক শ এতিম শিশু-কিশোর যেমন বেঁচে থাকার ভরসা পেয়েছে, তেমনি আঞ্জুমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ার সুযোগ পেয়ে সুন্দর আগামীর স্বপ্ন দেখছে এই সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা।
অনেকেই মনে করেন, আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম কোনো ব্যক্তির নামে একটি সেবা সংস্থা। আসলে তা নয়। আঞ্জুমান অর্থ সংগঠন, মুফিদুল হচ্ছে জনসেবা আর ইসলাম অর্থ শান্তি। আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের অর্থ দাঁড়ায়—ইসলামি জনসেবামূলক সংস্থা।
গত ২২ অক্টোবর ফকিরাপুলে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের অস্থায়ী কার্যালয়ে কথা হলো নির্বাহী পরিচালক ইলিয়াস আহমেদের সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘জনসাধারণের দানের অর্থে পরিচালিত হয় আঞ্জুমানের সব উদ্যোগ। একটি ইসলামি জনকল্যাণমূলক উদ্যোগ হিসেবে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের যাত্রা শুরু হয়েছিল। শুরুর সে লক্ষ্য থেকে প্রতিষ্ঠানটি আজও
সরে যায়নি। সুবিধাবঞ্চিত মুসলিম শিশুদের মূলধারায় প্রতিষ্ঠা করাসহ অসহায় মানুষের পাশে থাকাই আঞ্জুমানের লক্ষ্য।’
১১২ বছর ধরে মানুষের সেবায় কাজ করে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের গোড়াপত্তন হয়েছিল কলকাতায়, ১৯০৫ সালে। ইসলামি জনকল্যাণমূলক সংস্থাটি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ছিল পিছিয়ে পড়া মুসলিম ছেলেমেয়েদের শিক্ষা–সামাজিক–সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে এগিয়ে নেওয়া। এসব কাজের সঙ্গে সরকারের কাছ থেকে একটি বাড়তি দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছিল আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম, সেটা বেওয়ারিশ লাশ দাফনের। দিনে দিনে এই বেওয়ারিশ লাশ দাফনের কাজটিই মানুষের কাছে তাদের পরিচিতি এনে দেয়।
জনকল্যাণমূলক এই সংগঠনের প্রথম সভাপতি ছিলেন ভারতের গুজরাট রাজ্যের সুরাটের শেঠ ইব্রাহীম মোহাম্মদ ডুপ্লে। গত ১১২ বছরে প্রতিষ্ঠানটিতে সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন সমাজের অনেক খ্যতিমান মানুষ। তাঁদের মধ্যে ছিলেন শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, নবাব স্যার সলিমুল্লাহ বাহাদুর, নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরীর মতো ব্যক্তিত্ব।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর ঢাকায় আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের কার্যক্রম শুরু হয়। সে সময় গেন্ডারিয়ায় তাদের কার্যক্রম পরিচালিত হতো কলকাতার শাখা হিসেবে। ১৯৫০ সালে ঢাকা আঞ্জুমানের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হয়। কাজ শুরু করে স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে। ঢাকায় প্রথম কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী হাবিবুল্লাহ বাহার চৌধুরী।
স্বাধীনতার পর আঞ্জুমানের প্রধান কার্যালয় চলে আসে কাকরাইলে। রাজধানীতে গেন্ডারিয়া ও কাকরাইল বাদে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের আরেকটি কার্যালয় উত্তর মুগদাপাড়ায়। ঢাকায় এই তিনটি কার্যালয়ের মাধ্যমেই রোগী ও লাশ পরিবহনের জন্য অ্যাম্বুলেন্স সেবা, বেওয়ারিশ লাশ দাফনের সেবা দিয়ে থাকে আঞ্জুমান। মুগদাপাড়ার কার্যালয়টিকে বলা হয় আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের সেবাকেন্দ্র। এ ছাড়া এখানে রয়েছে দাফন সেবাকেন্দ্র। লাশ বহনের জন্য ফ্রিজিং গাড়ি, অ্যাম্বুলেন্সসহ প্রতিষ্ঠানটির বাহনসংখ্যা ৪০।
বর্তমানে কাকরাইল কার্যালয় বন্ধ রয়েছে। পুরোনো জায়গায় কাজ চলছে বহুতল ভবন নির্মাণের। নতুন ভবনে, নতুন স্বপ্ন নিয়ে আরও বড় পরিসরে কাজ করতে পারবে বলে জানালেন নির্বাহী পরিচালক। রাজধানীর তিনটি কার্যালয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, এতিমখানা ও প্রধান কার্যালয় মিলে আঞ্জুমানের মোট কর্মীর সংখ্যা ১৯৬।
নীরবে, নিভৃতে বছরের পর বছর মানব কল্যাণে কাজ করে চলছে সংগঠনটি। রোগী পরিবহন, বেওয়ারিশ লাশ দাফন, এতিমদের শিক্ষা–সহায়তা, অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো—নিষ্ঠা আর আন্তরিকতা দিয়ে করে চলেছে এসব সেবাকাজ। অথচ আত্মপ্রচার নেই, নেই আত্মশ্লাঘাও। এ এক বিরল উদাহরণ।
শিক্ষার আলো ছড়িয়ে এতিমদের পাশে
আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের চারটি এতিমখানা রয়েছে। এই এতিমখানাগুলোর মধ্যে একটি ছেলেদের, বাকি তিনটি মেয়েদের জন্য। গেন্ডারিয়ায় দুটি, নারায়ণগঞ্জ ও সাভারের পাথালিয়ায় আছে একটি করে। এই এতিমখানায় আছে প্রায় ৩০০ জন এতিম শিশু।
এতিমখানার শিশুদের শিক্ষার জন্যই প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে গেন্ডারিয়া ও মগবাজারে দুটি নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়, গোপীবাগ ও মগবাজারে দুটি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং আদাবরে একটি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট। এসব প্রতিষ্ঠানে গরিব ও দুস্থ পরিবারের সন্তানেরাও পড়াশোনার সুযোগ পায়।
ইলিয়াস আহমেদ বলেন, ‘নিম্নমাধ্যমিক পাসের পর এতিম শিশুদের কারিগরি বিষয়ে পড়ানো হয়। কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ানোর লক্ষ্য কর্মমুখী শিক্ষায় গড়ে তোলা। এতিমখানা থেকে বেরিয়ে গিয়ে যেন এতিমরা মূলধারায় কাজের সুযোগ পায়, সে পথই তৈরি করার চেষ্টা।’
তবে কেউ যদি সাধারণ শিক্ষায় আগ্রহী হয়, তবে তা নিজের ব্যয়ভার বহন করে পড়াশোনা করতে পারে।
অসহায় মানুষের জন্য আরও উদ্যোগ
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য ত্রাণ কার্যক্রম হাতে নিয়েছে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম। সে কাজটি ভালোভাবেই করছে প্রতিষ্ঠানটি। শুধু এই মানবিক বিপর্যয়ে নয়, আঞ্জুমান মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে সব সময়। দরিদ্র মানুষকে কর্মমুখী করার জন্য আঞ্জুমানের রয়েছে দারিদ্র্য বিমোচন প্রকল্প। রয়েছে দুস্থ বয়স্ক ও অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ভাতার ব্যবস্থা। দুর্যোগের সময় সরকারকে সহায়তা ও গরিব-নিঃস্ব পরিবারের সদস্যদের মধ্যে শীতবস্ত্র বিতরণ ও ত্রাণ বিতরণের কাজও নিয়মিত করে প্রতিষ্ঠানটি। সঙ্গে চিকিৎসাসেবা ও পুনর্বাসনের কাজেও তাদের ভূমিকা প্রশংসনীয়। বছরের বিভিন্ন সময় ভ্রাম্যমাণ মেডিকেল ইউনিটের মাধ্যমে করা হয় সুন্নতে খতনা ক্যাম্প। এ ছাড়া বিশ্ব ইজতেমার সময় মুসল্লিদের চিকিৎসাসেবাও দেয় আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম।
আদর্শ ছড়িয়েছে সারা দেশে
আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের কার্যক্রম পরিচালিত হয় ব্যবস্থাপনা পরিষদের মাধ্যমে। চার বছর মেয়াদি ৬৯ জনের এই ব্যবস্থাপনা পরিষদ গঠিত হয় ৩০০ সদস্যের মধ্য থেকে। এ ছাড়া রয়েছে ট্রাস্টি বোর্ড।
আধুনিক আঞ্জুমানের রূপকার মনে করা হয় এর সাবেক সভাপতি এ বি এম জি কিবরিয়াকে। বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক এই মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ১৯৯৩ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত সভাপতির দায়িত্ব পালনের সময় প্রতিষ্ঠানটির আধুনিকায়ন করেন।
তাঁর অবসরের পর এখন সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন বাংলাদেশ সরকারের সাবেক সচিব শামসুল হক চিশতী।
প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি কার্যক্রম পরিচালিত হয় আলাদা কমিটির মাধ্যমে। শিক্ষা কার্যক্রমের দায়িত্বে রয়েছে যেমন একটি কমিটি, তেমনি বেওয়ারিশ লাশ দাফনের জন্যও রয়েছে আলাদা কমিটি। তাদের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানেই রাজধানীর কার্যক্রমগুলো পরিচালিত হয়।
আঞ্জুমানের জনসেবামূলক কাজ ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। ৪৭টি জেলায় রয়েছে শাখা। এর মধ্যে ২৭টি জেলায় সক্রিয়ভাবে পরিচালিত হয়। এই শাখাগুলো পরিচালনা হয় স্থানীয় মানুষের উদ্যোগে। তবে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের নিয়মনীতি অনুসরণ করেই তাদের কাজ করতে হয়।
আঞ্জুমান চলে দানের টাকায়
আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের আয়ের প্রধান উৎস দুটি—জাকাত ও সাদকা। এ ছাড়া এককালীন অনুদান হিসেবে রয়েছে ‘ট্রাস্ট ফান্ড’। যে কেউ চার লাখ টাকার বেশি দান করে ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করতে পারেন। এ অর্থ ব্যাংকে স্থায়ী আমানত হিসাবে রাখা হয়। যার লভ্যাংশ থেকে ২০ শতাংশ মূলধনের সঙ্গে যোগ হয় আর বাকি ৮০ শতাংশ দাতার ইচ্ছা অনুযায়ী খরচ করা হয়। বর্তমানে আঞ্জুমানের ১১১টি ট্রাস্ট ফান্ড রয়েছে। প্রতিষ্ঠানের কিছু দোকান রয়েছে, সেখান থেকে ভাড়া বাবদ আয়ের টাকাও খরচ হয় নানা উদ্যোগে।
এ ছাড়া লাশ দাফনের জন্য সরকারি অনুদান পেয়ে থাকে প্রতিষ্ঠানটি। ২০১৭–১৮ অর্থবছরে বেওয়ারিশ লাশ দাফনের জন্য আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম পেয়েছে ৫৮ লাখ ৮০ হাজার টাকা।
জনহিতৈষী কাজের জন্য প্রতিষ্ঠানটি ১৯৯৬ সালে পেয়েছে স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার। ১৯৮৪ সালে ইসলামিক ফাউন্ডেশন পুরস্কার, ২০০৪ সালে ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিম স্মৃতি স্বর্ণপদক, ২০০৫ সালে ঢাকা সিটি করপোরেশনের নগর পদকসহ নানা পুরস্কার ও সম্মাননা।
এসব পুরস্কার ও সম্মাননা আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের উদ্যোক্তাদের হয়তো অনুপ্রাণিত করে।
তবে মানবিক সেবার আদর্শ হয়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানটির সুনাম কাজের মাধ্যমে প্রজন্মের পর প্রজন্মে বয়ে নিতে চান তঁারা।
সজীব মিয়া: সাংবাদিক।