মাদক নির্মূলে কাউকে ছাড় দিলে চলবে না
চলমান অভিযান প্রসঙ্গে বলব, সরকারের দৃশ্যমান কাজ হলো মাদক কারবারিদের আত্মসমর্পণ ও কথিত ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধ। কিন্তু মাদক নির্মূলে সমস্যার একটি অদৃশ্য দিক আছে। সেটা হচ্ছে, লগ্নিকারী আর মাদক ব্যবসা প্রসারে সহায়তাকারীদের বড় অংশই ক্ষমতার রাজনীতির কাছের লোক। তাঁদের ছাড় দেওয়া হচ্ছে। এই অদৃশ্য দিকটাই আমার মতে বড় সমস্যা। আমরা দেখলাম কক্সবাজারে আত্মসমর্পণের সুযোগ দেওয়া হলো। কিন্তু সব গডফাদার সেই সুযোগ নিলেন না।
আর ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধ কোনো সমাধান নয়। অনেকে ফিলিপাইনের মাদকবিরোধী অভিযানের প্রসঙ্গ টানছেন। সেই অভিযানের সঙ্গে আমাদের চলমান অভিযানের মূল পার্থক্য হলো, ফিলিপাইনে ‘টপ অর্ডারের’ লোকজনকেও ছাড় দেওয়া হয়নি। আমাদের এখানে যাঁরা অভিযানে মারা পড়ছেন, তাঁদের বড় অংশই বাহক পর্যায়ের। তা ছাড়া স্থায়ীভাবে মাদক পাচার বন্ধে কথিত ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধ কখনোই কার্যকর কোনো উপায় নয়। এটা সাময়িক একটা প্রভাব ফেলে মাত্র।
অভিযানটা অনুরাগ-বিরাগের বশবর্তী হয়ে করলে চলবে না। যাঁরা যাঁরা সম্পৃক্ত, তাঁদের প্রত্যেককে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। তাঁরা যতই প্রভাবশালী বা ক্ষমতার কাছের লোক হন না কেন। প্রভাবশালী নেতাদের মতো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো কোনো সদস্যের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন আছে। টেকনাফে গডফাদারসহ বর্তমান বা সাবেক সব মাদক ব্যবসায়ীর সম্পদের অনুসন্ধান করা উচিত। একইভাবে বিভিন্ন সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যে সদস্যদের বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসার অভিযোগ উঠেছে, তাঁদের সম্পদেরও খোঁজখবর করা উচিত।
বহুবার শুদ্ধি অভিযানের কথা আলোচনায় এসেছে। সবাই যদি একসঙ্গে দায়িত্ব নিয়ে সব শক্তি দিয়ে আন্তরিকভাবে শুদ্ধি অভিযানটা চালায়, তাহলে সুফল পাওয়া যাবে। অভিযানের জন্য জমি তৈরি করাটা মূল কাজ। সমস্যা কী এবং ধাপে ধাপে করণীয় কী—যেমন তিন মাসে কী করা যায়, ছয় মাসে কী করা যায়—সেটা আগে নির্ধারণ করা উচিত।
বাংলাদেশে মাদকবিরোধী অভিযানকে সফল করতে হলে আরও কয়েকটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে। দেশে মাদকসেবীর সংখ্যা এখন প্রায় এক কোটি। তার মানে বাজারটা বিশাল এবং হাত বাড়ালেই মাদক পাওয়া যায়। চাহিদা যেমন ব্যাপক, জোগানেরও কমতি নেই।
চাহিদা ও জোগান কোনোটাই কমানো যাচ্ছে না বলে, একদিকে এর প্রবেশ ঠেকালে, অন্যদিক থেকে ঢুকছে, যেমনটা এখন শোনা যাচ্ছে। ইয়াবা কারবারিরা এখন ভারত সীমান্ত কিংবা সাগরপথে এসে শুধু জলপথ ধরে মূল ভূখণ্ডে ঢুকছে। অনেক সময় আসছে প্রচলিত পথ এড়িয়ে।
যেহেতু ইয়াবা দামি মাদক, মাদকের টাকা সংগ্রহ করতে গিয়ে অনেকে মাদক বিক্রেতা বনে যাচ্ছেন। মাদকসেবীদের সুচিকিৎসা ও পুনর্বাসনটা তাই খুব দরকার। মাদকসেবীদের কেউ বিশ্বাস করে না, তাদের প্রতি কারও আস্থাও নেই। শুধু পুনর্বাসনকেন্দ্রে পাঠালেই হবে না, তারা যেন সমাজ ও অর্থনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।
এম ইমদাদুল হক: মাদকবিষয়ক গবেষক ও অধ্যাপক, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়