মাদক আসছে কুরিয়ারে, রোধে যা করতে হবে
বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার কারণে আমাদের জীবন সুখকর ও আনন্দময় হয়েছে। ঠিক তেমনি আধুনিক সভ্যতার কিছু নেতিবাচক বৈশিষ্ট্য সমাজে তৈরি করেছে অসুস্থ প্রতিযোগিতা। এ প্রতিযোগিতায় নিজের অবস্থান ধরে রাখতে ছুটে চলছে সবাই। সমাজে এখন মানবিক মূল্যবোধের অধঃপতন, কাঙ্ক্ষিত সুস্থ-স্বাভাবিক সাংস্কৃতিক ও মানসিক পরিবেশের অভাব, প্রায়োগিক শিক্ষাব্যবস্থার স্বল্পতায় কর্মসংস্থানের অভাব প্রকট হয়ে উঠেছে। কিশোর, তরুণ ও যুবসমাজের অনেকের ভেতরে ভর করে আছে হতাশা, একাকিত্ব ও নিঃসঙ্গতা। আর এ কারণে যুবক ও তরুণদের একটি বড় অংশ মাদকের নেশায় জড়িয়ে পড়ছে। এই নেশা কেবল ব্যক্তির সম্ভাবনাময় জীবনকে ধ্বংস করছে না, পাশাপাশি পরিবার ও সমাজের ক্ষতি করছে। এটা দেশের ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধি ও উন্নতির পথে সবচেয়ে বড় অন্তরায়।
মাদক চোরাকারবারিরা ডার্ক ওয়েবসাইটে এখন ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহার করে এই অবৈধ ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা সম্প্রতি নতুন রুট হিসেবে দেশি-বিদেশি কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে বিদেশ থেকে ডিএমটি, এলএসডি, ডিওবি, স্কোপলোমিনসহ এনালজেসিক ড্রাগ, অক্সি মরফোন (মরফিনের এনালগ) মতো মাদক বাংলাদেশে নিয়ে এসেছে। তারা মধ্যপ্রাচ্যসহ যুক্তরাষ্ট্র, নেদারল্যান্ডস, কানাডা, পোল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়াসহ এশিয়ার বেশ কিছু দেশের জাতীয়-আন্তর্জাতিক পোস্টাল ও কুরিয়ার সার্ভিসগুলোকে মাদক পাচারের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছে।
দেশে নানা পথে প্রতিনিয়ত ঢুকছে মাদকদ্রব্য। মাদকদ্রব্য পাচার ও সরবরাহ রোধে কঠোর নজরদারির ব্যবস্থা করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সে কারণে মাদক চোরাকারবারিরাও তাদের কৌশল পরিবর্তনসহ মাদকদ্রব্যেও বৈচিত্র্য আনছে। মাদক চোরাকারবারিরা স্থল, নৌ, আকাশপথসহ সব রুটেই মাদক আনছে। সবচেয়ে ভয়ংকর হলো বর্তমানে মাদক পাচারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ছে দেশি ও বিদেশি কুরিয়ার সার্ভিস। কিছু নামসর্বস্ব কুরিয়ার সার্ভিসের এখন মূল কাজই হলো পার্সেলের আড়ালে মাদক পাচার করা। তাই এই কুরিয়ার সার্ভিসগুলো যদি এখনই কঠিন নজরদারির আওতায় না আনা যায়, তাহলে গ্রাম-পাড়া-মহল্লাসহ সবখানেই অনায়াসে মাদক পৌঁছে যাবে।
মাদকাসক্তির সামাজিক কারণ
মাদকাসক্তির সম্ভাব্য সামাজিক কারণ বিশ্লেষণ করলে মনে হয়, আমাদের সমাজই ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তরুণ-যুবকদের মাদকের নেশার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। একটা সময় ছিল যখন ছেলেমেয়েরা স্কুল-কলেজ থেকে ফিরে বিকেলে মাঠে নানা খেলায় মেতে উঠত। আর এখন প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে শিল্পায়নের কারণে গ্রাম ও শহরের মাঠগুলো প্রায় সব দখল হয়ে যাচ্ছে। গ্রাম ও শহরে পরিকল্পনাহীন অবকাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে। খেলার মাঠ দখল করে অবকাঠামো নির্মাণ করায় মাঠের অভাবে কোমলমতি ছেলেমেয়েরা শারীরিক ও মানসিক বিকাশ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এতে তারা একাকিত্বে ভুগছে। বিশ্বায়নের এই আধিপত্যের চরম কশাঘাতে হারিয়ে যাচ্ছে অনেক সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও মানবীয় গুণাবলি।
প্রচলিত সামাজিক রীতিনীতি ও মূল্যবোধের প্রতি অনাসক্তির কারণে অনেক কিশোর-তরুণ খারাপ কাজ, এমনকি মাদকের নেশায় জড়িয়ে পড়ছে দ্বিধাহীনভাবে। দেশে বর্তমানে প্রায় ৮০ লাখ মাদকসেবী আছে। এদের অধিকাংশই তরুণ ও যুবক। এই পরিসংখ্যান সমাজের তথা রাষ্ট্রের ভবিষ্যতের জন্য অবশ্যই একটি অশনিসংকেত। দেশে সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও মাদকের পেছনে বছরে খরচ এক লাখ কোটি টাকার বেশি বলেই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ধারণা। এ বিপুল পরিমাণ ধ্বংসাত্মক অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যয় আমাদের দেশের পক্ষে বহন করা যেমন অসম্ভব, তেমনি দিন দিন অকালে হারিয়ে যাচ্ছে সম্ভাবনাময় প্রজন্ম।
যেসব মাদক আসছে কুরিয়ারে
গত কয়েক মাস থেকেই দেশে মাদক প্রবেশের কৌশলে অনেক পরিবর্তন এসেছে। মাদক চোরাকারবারিরা ডার্ক ওয়েবসাইটে এখন ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহার করে এই অবৈধ ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা সম্প্রতি নতুন রুট হিসেবে দেশি-বিদেশি কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে বিদেশ থেকে ডিএমটি, এলএসডি, ডিওবি, স্কোপলোমিনসহ এনালজেসিক ড্রাগ, অক্সি মরফোন (মরফিনের এনালগ) মতো মাদক বাংলাদেশে নিয়ে এসেছে। তারা মধ্যপ্রাচ্যসহ যুক্তরাষ্ট্র, নেদারল্যান্ডস, কানাডা, পোল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়াসহ এশিয়ার বেশ কিছু দেশের জাতীয়-আন্তর্জাতিক পোস্টাল ও কুরিয়ার সার্ভিসগুলোকে মাদক পাচারের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছে। সম্প্রতি বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ বিদেশ থেকে কুরিয়ারে আসা মাদকের বেশ কয়েকটি বড় চালান আটক করেছে। এসব মাদকদ্রব্য ব্যয়বহুল ও ক্ষতির দিক থেকে ভয়ংকর। এসবের সঙ্গে জড়িত মূলত কুরিয়ার সার্ভিসের কিছু কর্মচারীসহ বিদেশে ও দেশের উচ্চশিক্ষিত বেশ কিছু শিক্ষার্থী।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর বলছে, করোনাভাইরাসের মতো বৈশ্বিক দুর্যোগেও থেমে নেই মাদক চোরাকারবারি চক্রের দৌরাত্ম্য। দেখা গেছে, এই মহামারিতে মাদক ব্যবহার যেমন বেড়েছে, তেমনি নতুন নতুন মাদকের চাহিদা বাড়ার সঙ্গে প্রতিনিয়ত পাচারের কৌশলও পরিবর্তিত হচ্ছে। করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। এ কারণে ভার্চ্যুয়াল জগতে অধিক সময় দেওয়ায় এক শ্রেণির তরুণ-যুবক মাদকের প্রতি ঝুঁকে পড়েছে। বিভিন্ন কৌশলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে ফাঁকি দিয়ে নতুন মাদক আনার জন্য তারাও কুরিয়ার সার্ভিসকে ব্যবহার করছে।
মাদক রোধে এখনই যা করতে হবে
মাদক চোরাচালানকারীরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে এখন সরাসরি রুটের পরিবর্তে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে মাদক বহনকে নিরাপদ মনে করেছে। এতে বিভিন্ন পণ্যের আড়ালে খুব সহজে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ছড়িয়ে পড়ছে মাদকদ্রব্য। তাই কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে মাদকের চোরাচালান যেন না হয়, সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে আন্তরিক হতে হবে। মাদক নির্মূলে আইনের কঠোর প্রয়োগ করতে হবে।
জাতীয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ কমিটির বিভিন্ন সভায় কুরিয়ার সার্ভিস সম্পর্কে যে মতামত পেশ করা হয়েছে, তা যথাযথ বাস্তবায়ন করে কুরিয়ার সার্ভিস বিধিমালা আধুনিকায়ন ও যুগোপযোগী করা জরুরি। কুরিয়ার সার্ভিসের পার্সেল ডেলিভারির ক্ষেত্রে প্রেরক ও প্রাপকের ঠিকানা, জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি রাখা, সক্রিয় সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন, উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন স্ক্যানিংয়ের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, সক্রিয় মুঠোফোন নম্বর সরাসরি চেক করা, যেসব কুরিয়ার সার্ভিসের নিবন্ধন নেই তাদের কার্যক্রম বন্ধ করা, ডাক বিভাগ ও কুরিয়ার সার্ভিস–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অবৈধ পার্সেল শনাক্তকরণে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, কুরিয়ার সার্ভিসে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পূর্ণাঙ্গ জীবনবৃত্তান্ত সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে সংরক্ষণ করা জরুরি বলে মনে করে কমিটি।
কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে মাদক পাচারের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে শত বছর আগের পুরোনো পোস্টাল আইন (১৮৯৮) দিয়ে চলা কুরিয়ার সার্ভিসের ধারা সংশোধন করে যুগোপযোগী করতে হবে। যদিও সরকার এ আইনের কিছু ধারা সংশোধন করে কুরিয়ার সার্ভিস বিধিমালা-২০১১ তৈরি করেছেন। আদালতের রিটের কারণে এখন তা স্থগিত হয়ে আছে।
বাড়ছে নজরদারি
ইতিমধ্যে জিপিওর বিদেশ শাখায়, বিমানবন্দরে ও রপ্তানি কার্গোতে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন স্ক্যানার বসানো হয়েছে। স্ক্যানার বসানোর কাজ চলমান। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে প্রায় ৮০০টি কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠান আছে। এর মধ্যে ৭০টি নিবন্ধিত। আর ১৪০টি প্রতিষ্ঠান কুরিয়ার সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের আওতাভুক্ত। বিভিন্ন সময় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সংশ্লিষ্ট অংশীদারদের নিয়ে বিভিন্ন কর্মশালায় লাইসেন্সবিহীন কুরিয়ার সার্ভিসের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছে, যা বাস্তবায়িত হলে মাদক পাচার হ্রাস পাবে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মতে, নিত্যপ্রয়োজনীয় ওষুধ ও চিঠির মোড়কে কুরিয়ারে যাচ্ছে মাদক। ওই পার্সেলে প্রেরক ও প্রাপকের ঠিকানা থাকলেও তা ভুল। প্রয়োজনে জাতীয় নিরাপত্তা বজায় রেখে ন্যাশনাল ডেটা সার্ভার ব্যবহারের অনুমতি মাদক অধিদপ্তরকে দিলে এ ব্যাপারে নজরদারি বাড়ানো যাবে। দেশের বিমানবন্দরসহ অন্যান্য স্থানে রক্ষিত স্ক্যানারগুলোতে নতুন মাদক স্ক্যান করার লাইব্রেরি রাখতে হবে। এ ছাড়া একটি স্ক্যানার নষ্ট হলে যেন বিকল্প থাকে, সেটা নিশ্চিত করাও জরুরি।
কুরিয়ার সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের (সিএসবি) সভাপতির মতে, সন্দেহ হলে পার্সেল যাচাই ও জাতীয় পরিচয়পত্র রাখার নির্দেশনা তাঁরা দিয়েছেন। তবে নতুন মাদক সম্পর্কে অনভিজ্ঞতা ও স্ক্যানার না থাকার সীমাবদ্ধতা তাঁদের আছে। তাই মাদক নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্টদের কঠোর নজরদারি ও গোয়েন্দা তথ্যই পারে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে পণ্য পরিবহনের আড়ালে মাদক পাচার বন্ধ করতে।