মাছ উৎপাদন বৃদ্ধিতে শীর্ষ চার দেশের একটি বাংলাদেশ
জনসংখ্যা বৃদ্ধি আর দূষণের কারণে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশে স্বাদুপানির মাছের উৎপাদন কমছে। চাষের মাছের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা চলছে। এর মধ্যে উজ্জ্বল ব্যতিক্রম হিসেবে চারটি দেশ উৎপাদন বৃদ্ধির ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছে। বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার ও উগান্ডা হলো সেই চার দেশ। আর সামগ্রিকভাবে স্বাদুপানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এবারও ভারত ও চীনের পর তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে। চাষের মাছ উৎপাদনেও বাংলাদেশ একই অবস্থানে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) প্রকাশিত বিশ্বের সামগ্রিক মৎস্যসম্পদবিষয়ক প্রতিবেদনে এই চিত্র উঠে এসেছে। দুই বছর পরপর এ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। ‘দ্য স্টেট অব ওয়ার্ল্ড ফিশারিজ অ্যান্ড অ্যাকুয়াকালচার-২০২২’ শিরোনামে গত শুক্রবার প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, নানা প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও চাষের মাছ উৎপাদনে তিনটি দেশ বিশ্বের জন্য উদাহরণ সৃষ্টি করছে। এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ ও ভিয়েতনাম এবং আফ্রিকায় মিসর এই সাফল্য দেখিয়েছে। বলা হয়েছে, বিশ্বে স্বাদুপানির মাছের ১১ শতাংশ এখন বাংলাদেশে উৎপাদিত হচ্ছে। যার মোট পরিমাণ প্রায় ১৩ লাখ টন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, স্বাদুপানির পাখনাযুক্ত মাছ (ফিনফিশ) উৎপাদনের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। এসব মাছের মধ্যে ইলিশও রয়েছে। বাংলাদেশে মুক্ত জলাশয় থেকে মোট ১৩ লাখ টন মাছ আহরণ করা হয়। এর মধ্যে ইলিশ প্রায় ছয় লাখ টন। ইলিশ মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে ১ নম্বর অবস্থানে রয়েছে। পাখনাযুক্ত অন্য প্রধান সাতটি মাছ হচ্ছে রুই, কাতলা, পাঙাশ, তেলাপিয়া, গ্রাসকার্প ও সিলভার কার্প। বিশ্বজুড়ে চাষের ক্ষেত্রে এই সাত মাছকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
এফএওর প্রতিবেদনে অবশ্য বাংলাদেশের সামুদ্রিক মৎস্য আহরণে খুব বেশি সাফল্যের চিত্র উঠে আসেনি। এই খাতে বাংলাদেশ ২৮তম অবস্থানে রয়েছে। সামুদ্রিক মাছের উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষ পাঁচটি দেশ হচ্ছে চীন, ইন্দোনেশিয়া, পেরু, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশ সমুদ্র থেকে ৬ লাখ ৭০ হাজার টন মাছ সংগ্রহ করে। আর শীর্ষ অবস্থানে থাকা চীন ১ কোটি ১৭ লাখ ৭০ হাজার টন সামুদ্রিক মাছ আহরণ করে।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের মুক্ত জলাশয়ের মাছ উৎপাদনে সফলতার ক্ষেত্রে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে। আর চাষের মাছের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মৎস্যবিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত মাছের জাতগুলো চাষিদের কাছে দ্রুত জনপ্রিয় ও লাভজনক হয়েছে। ফলে তাতে উৎপাদনও বেড়েছে।
এ বিষয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে সরকার গবেষণার ওপর বেশি নজর দিচ্ছে। একই সঙ্গে নতুন উদ্ভাবিত জাতগুলোকে চাষিদের হাতে পৌঁছে দিতে মাছের রেণু ও পোনা উৎপাদন বাড়ানো হচ্ছে। জলাশয় ও নদ–নদীর দূষণ কমাতে পারলে উৎপাদন আরও বাড়বে।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট-বিএফআরআই সূত্রে জানা গেছে, দেশে মোট যে পরিমাণ মাছ উৎপাদিত হয়, তার মধ্যে কার্প, অর্থাৎ রুইজাতীয় মাছ ২১ শতাংশ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি হয় রুই মাছ, ১১ শতাংশ। এরপরে রয়েছে পাঙাশ (১১ দশমিক ৫৫ শতাংশ), তেলাপিয়া (৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ), কাতলা (পৌনে ৭ শতাংশ) ও সিলভার কার্প (৭ দশমিক ৩ শতাংশ)।
বিএফআরআইয়ের তথ্যমতে, গত এক যুগে দেশি ৩৬ প্রজাতির ছোট মাছের চাষ পদ্ধতি উদ্ভাবন করা হয়েছে। এর ফলে এ সময়ে চাষের মাছ উৎপাদন ৬৭ হাজার মেট্রিক টন থেকে বেড়ে প্রায় আড়াই লাখ মেট্রিক টন হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, দেশে স্বাদুপানির ২৬০ প্রজাতির মাছ রয়েছে। তার মধ্যে মাত্র ৩০টি প্রজাতির চাষ বেশি হচ্ছে। বাকিগুলোর চাষ বাড়লে বাংলাদেশের মাছ উৎপাদন ৫০ লাখ টনে পৌঁছাবে।
বিএফআরআইয়ের মহাপরিচালক মোহাম্মদু ইয়াহিয়া মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা দেশের বেশির ভাগ মাছের জাত সংগ্রহ করে একটি জীবন্ত জিন ব্যাংক তৈরি করেছি। সেগুলো থেকে জনপ্রিয় জাতগুলোর চাষ পদ্ধতি উদ্ভাবন করে কৃষকের মধ্যে ছড়িয়ে দিচ্ছি। আশা করি, আগামী কয়েক বছরে দেশের মাছের উৎপাদন আরও বাড়ানো যাবে।’
তবে মাছের উৎপাদন ধরে রাখার জন্য নদী ও জলাশয়গুলোকে দূষণমুক্ত করতে হবে বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড ফিশের ইকোফিশ কার্যক্রমের দলনেতা অধ্যাপক আবদুল ওয়াহাব। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নদ–নদী দূষণমুক্ত না রাখলে ইলিশের উৎপাদন ধরে রাখা সম্ভব হবে না।