‘মাকে ভর্তি করাতে পারছি না, অথচ মা কাতরাচ্ছেন’

তিন দিন ধরে সামছুন নাহারের শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। বুকে চাপ অনুভব করছেন। কিন্ত হাসপাতালে সিট খালি নেই।
ছবি: দীপু মালাকার

পঞ্চাশোর্ধ্ব সামছুন নাহার মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে ট্রলিতে শুয়ে আছেন। পাশে দাঁড়ানো ছেলে আলামিনকে কিছুক্ষণ পরপর বলছিলেন, ‘বাবারে, আমার নিশ্বাস নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে।’

মায়ের এমন কষ্ট দেখে আলামিন আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন। কিন্তু অসহায় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করার নেই তাঁর। কারণ, মুগদা মেডিকেলের জরুরি বিভাগের সামনে নোটিশ ঝুলছে, কোনো সিট খালি নেই।

সামছুন্নাহারের গ্রামের বাড়ি নোয়াখালী। আগে থেকেই তাঁর হৃদ্‌রোগ রয়েছে। তবে তিন দিন ধরে তাঁর শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। বুকে চাপ অনুভব করছেন। এর সঙ্গে আছে হালকা জ্বর। গতকাল মঙ্গলবার আলামিন তাঁর মাকে কুমিল্লার হাসপাতালে ভর্তি করানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু সেখানে সিট খালি নেই। তাই আজ বুধবার ভোরে অ্যাম্বুলেন্সে করে মাকে নিয়ে আসেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানেও তাঁর মাকে ভর্তি করাতে পারেননি। কারণ, সিট খালি নেই।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বহির্বিভাগ কর্তৃপক্ষ সিট খালি না থাকার তথ্য জানিয়ে সামছুন নাহারকে মুগদা হাসপাতাল কিংবা ডিএনসিসি করোনা হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। এরপর আলামিন তাঁর মাকে নিয়ে বেলা ১১টার দিকে আসেন মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে। জরুরি বিভাগের দায়িত্বে থাকা চিকিৎসকেরা আলামিনকে জানান, সিট খালি নেই।

আলামিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘মাকে ভর্তি করাতে পারছি না, অথচ মা আমার কাতরাচ্ছেন। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে মায়ের। ঢাকা মেডিকেল হাসপাতাল বলে দিয়েছে, সিট খালি নেই। মুগদায় মেডিকেলে সিট খালি নেই। তাহলে আমি মাকে কোথায় ভর্তি করাব?’

কেবল সামছুন নাহার নন, তাঁর মতো আরও অনেকে আজ মুগদা মেডিকেলে ভর্তি হতে এসেছিলেন। কিন্তু সিট খালি না থাকায় অন্যত্র চলে গেছেন। কেউ কেউ এখনো অপেক্ষা করছেন হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে।

তাঁদেরই একজন খিলগাঁও এলাকার বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব হাফিজুর রহমান। তাঁর শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা কমে দাঁড়িয়েছে ৮৫। নিশ্বাস নিতে প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছিল তাঁর। শরীরে জ্বর। সঙ্গে ঠান্ডা–কাশি।

অক্সিজেনের মাত্রা বারবার কমে আসছে হাফিজুর রহমানের। কিন্তু হাসপাতালে সিট খালি নেই। তাঁর জীবন ঝুঁকির মুখে। কখন সিট খালি হবে সেই আশায় অপেক্ষায় আছেন স্ত্রী ও ছেলে
ছবি: দীপু মালাকার

ছেলে মোহাম্মদ ফারুক কিছুক্ষণ পরপরই অক্সিমিটার দিয়ে বারবার রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা মাপছিলেন। দেখা যাচ্ছিল শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা বারবার কমে আসছে। তবু বাবাকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে পারছেন না। কারণ সিট খালি নেই। তারপরও আশায় বুক বেঁধে বাবাকে নিয়ে জরুরি বিভাগের সামনে পড়ে আছেন ফারুক। যদি সিট খালি হয়, তখন বাবাকে ভর্তি করাতে পারবেন।

বাবাকে ভর্তি করাতে না পারা মোহাম্মদ ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি এখন যে পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, সেটি কাউকে বোঝানো যাবে না। আমার বাবার শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যাচ্ছে। আমি জানি, শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা ৯০–এর নিচে নেমে গেলে জীবন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। আমার বাবারও এমন অবস্থা। তবু বাবাকে আমি ভর্তি করাতে পারছি না। সিট খালি নেই।’

আর রোগী ভর্তি করলে অন্যরা ঠিকমতো অক্সিজেন পাবেন না

রোনা ইউনিটে সিট খালি থাকছেই না। কিছুক্ষণ পরপরই রোগী আসছেন। সিট খালি থাকা সাপেক্ষে রোগী ভর্তি নেওয়া হচ্ছে।
ছবি: দীপু মালাকার

সিট খালি না থাকায় করোনা রোগীরা ফিরে যাচ্ছেন, সেটি স্বীকার করেন মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক অসীম কুমার নাথ। আজ দুপুরে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালে পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, আমরা নতুন রোগী ভর্তি নিতে পারছি না। কারণ, ইতিমধ্যে আমাদের হাসপাতালে ৩২০ করোনা রোগী ভর্তি আছেন। আমরা যদি এ মুহূর্তে আরও ৫ থেকে ১০ জনকে ভর্তি করি, তাহলে আমাদের হাসপাতালে যেসব রোগী ভর্তি আছেন, তাঁদের অনেকে ঠিকমতো অক্সিজেন পাবেন না। ফলে বাধ্য হয়ে এ মুহূর্তে নতুন করে রোগী ভর্তি করানো যাচ্ছে না। তবে পুরোনো রোগী হাসপাতাল থেকে রিলিজ হলে আবার নতুন রোগী ভর্তি করানো সম্ভব হবে।’

মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক জানান, বেশ কিছুদিন ধরে করোনা রোগীর চাপ অনেক বেড়ে গেছে। গতকাল থেকে নতুন রোগী ভর্তি করানো কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছেন।

কেবল সামছুন নাহার নন, তাঁর মতো আরও অনেকে আজ মুগদা মেডিকেলে ভর্তি হতে এসেছিলেন। কিন্তু সিট খালি না থাকায় অন্যত্র চলে গেছেন। কেউ কেউ এখনো অপেক্ষা করছেন হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে।

প্রায় একই কথা জানালেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক। আজ দুপুরে মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালেও সিট খালি নেই। এ মুহূর্তে হাসপাতালে ৭৬২ করোনা রোগী ভর্তি আছেন। অবস্থা এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে, করোনা ইউনিটে সিট খালি থাকছেই না। কিছুক্ষণ পরপরই রোগী আসছেন। সিট খালি থাকা সাপেক্ষে রোগী ভর্তি নেওয়া হচ্ছে। আর যাঁদের ভর্তি করা সম্ভব হচ্ছে না, তাঁদের মুগদাসহ ঢাকার অন্য করোনা হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।’