ডেঙ্গুতে মারা গেছেন স্বামী, স্ত্রীও হাসপাতালে
হোসনেয়ারা হকের ৪৮ বছর বয়সী ছেলে মইনুল হক গত শুক্রবার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। মা হোসনেয়ারাও ডেঙ্গু আক্রান্ত। রোগ কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসায় তিনি গতকাল রোববার রাতে হাসপাতাল থেকে মেয়ে ফারজানা হকের বাসায় ফিরেছেন। এই মা জানেন, তাঁর ছেলে হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে আছেন। আর হোসনেয়ারার জানাকে সত্য বলে প্রমাণিত করতে পরিবারের সদস্যদের প্রতিনিয়ত অভিনয় ও মিথ্যার আশ্রয় নিতে হচ্ছে। কেননা, চিকিৎসক জানিয়েছেন, হোসনেয়ারার এখন যে শারীরিক অবস্থা, তাতে করে ছেলের মৃত্যুর খবর তিনি সহ্য করতে পারবেন না।
খারাপ খবরের এখানেই শেষ নয়। মৃত মইনুল হকের স্ত্রী সাবিনা শারমিন ডেঙ্গুর সঙ্গে লড়ছেন। তিনি রাজধানীর শ্যামলীতে একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তাঁর শারীরিক অবস্থাও বেশ খারাপ বলেছেন চিকিৎসকেরা।
গতকাল রাত ১০টার দিকে রাজধানী ঢাকার জিগাতলায় ফারজানা হকের বাসায় গিয়ে দেখা যায়, হোসনেয়ারা মশারির ভেতর শুয়ে আছেন। জানালেন, শরীরটা ভালো নেই। সাংবাদিক পরিচয়ে নয়, ফারজানা হকের বন্ধুর পরিচয়ে কথা হয় হোসনেয়ারার সঙ্গে।
ফারজানা হকের বাসা সাততলায়। নতুন ফ্ল্যাট। সিঁড়িতে রেলিং লাগানো হয়নি। লিফট বসানো হয়নি। হোসনেয়ারা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার আগে ছেলে মইনুল হকের বাসায় ছিলেন। হাসপাতাল থেকে সেখানেই ফিরতে চেয়েছিলেন। ফারজানা হকেরও ইচ্ছা ছিল লিফট লাগানোর পরেই মাকে নতুন ফ্ল্যাট দেখানোর জন্য নিয়ে আসবেন। কিন্তু মাকে তো এখন আর কিছুতেই ছেলের বাসায় নেওয়া যাবে না। ফারজানা বললেন, ‘মাকে বলেছি, ভাইয়া-ভাবি হাসপাতালে। সেখানে গেলে তোমাকে কে দেখবে? কিন্তু মায়ের মন, তাই একটু পরপর বিভিন্ন প্রশ্ন করেন। প্রতিনিয়ত মিথ্যা বলতে হচ্ছে। ভাইয়া বেঁচে আছে, ভালো হয়ে যাবে, সে ধরনের অভিনয় করতে হচ্ছে। অভিনয় না করেও উপায় নেই, গত বছরেই ৫২ বছর বয়সী আরেক বড় ভাই হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। এখন এই ছেলেও নেই। তা মা সহ্য করবেন কীভাবে?’
ফারজানা হক জানালেন, মা, ভাই (মইনুল হক), ভাবি (মইনুলের স্ত্রী) ও তাঁদের কলেজপড়ুয়া একমাত্র ছেলে ছাড়াও তাঁদের পরিবারে বড় ভাবি (গত বছর মারা যাওয়া ভাইয়ের স্ত্রী), ভাবির মেয়েসহ পরিবারের মোট ছয়জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। একজন মারা গেলেন। এক ভাবি এখনো হাসপাতালে। অন্যরা বাসায় ফিরেছেন। এর মধ্যে খরচ হয়ে গেছে ১০ লাখ টাকার বেশি। যে ভাবি হাসপাতালে আছেন, তাঁর বিল কত আসবে, তা এখনো জানার উপায় নেই। বলতে গেলে সবাই অসুস্থ হওয়া এবং এত বিশাল খরচের ধাক্কা সব হয়েছে এক মাসের মধ্যে।
ফারজানা হক জানালেন, তাঁর তিন ভাইয়ের মধ্যে দুই ভাই মারা গেলেন। এক ভাই থাকেন বাগেরহাট। মইনুল ভাই মারা যাওয়ার পর বাগেরহাট থেকে এসে ওই ভাই ও পরিবারের দু-একজন লাশ গ্রামে গিয়ে দাফন করেছেন। এখন হোসনেয়ারা সারাক্ষণ জানতে চান, ‘ওই ছেলে কোথায়? বাড়িতে কেন গিয়েছেন?’
ফারজানা বললেন, ‘আমরা ভাইয়ের জন্য একটু যে কাঁদব, তারও উপায় নেই। মায়ের কাছে প্রায় হাসিমুখেই থাকতে হচ্ছে। যাতে কোনো সন্দেহ না হয়।’
ফারজানার বাবা মারা গেছেন। ফারজানা জানালেন, তাঁরা তিন বোন। দুই বোন ঢাকায় থাকেন, আরেক বোন দেশের বাইরে। দেশের বাইরে যে বোন, সেই বোন ১২ বছর পরে প্রথম সন্তানের মা হতে যাচ্ছেন। তাঁরও শারীরিক অবস্থা খারাপ। তাই তাঁর কাছ থেকেও অনেক তথ্য লুকিয়ে রাখতে হচ্ছে।
ফারজানা জানালেন, তাঁর ভাই মইনুল হককে দুবার ডেঙ্গু আক্রমণ করে। একবার ভালো হয়ে হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরেছিলেন। এর মধ্যে মা ও ভাবির ডেঙ্গু ধরা পড়ার পর সেই ভাই–ই হাসপাতালে নিতে বলেন। কোরবানির ঈদের পরের দিন ভাই তাঁর বাসায় সবাইকে দাওয়াত দেন। ঈদের বাজার করেন। ছেলের সঙ্গে ঈদের নামাজ পড়েন।
ফারজানা বললেন, ‘আমাদের ওপর দিয়ে কী যে যাচ্ছে, তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। একজন এক হাসপাতালে তো আরেকজনকে অন্য হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে। একজনের রক্ত জোগাড় করতে করতে আরেকজনের অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। বলতে গেলে পুরো পরিবারটি ধ্বংস হয়ে গেছে। আর খরচের যে ধাক্কা তা তো আছেই। তারপরও ভাইটা যদি বেঁচে থাকত, আমাদের কষ্ট থাকত না। বাবা নেই। বড় ভাই মারা যাওয়ার পর মা ও এই ভাই আমাদের অভিভাবক ছিলেন। এখন তো সব শেষ।’
ভাই মারা যাওয়ার পেছনে চিকিৎসকদের গাফিলতি ছিল বলেও অভিযোগ করলেন ফারজানা। মইনুল হকের ডেঙ্গু ধরা পড়ার পর মাইল্ড স্ট্রোক হয়। মা ও ভাবির ডেঙ্গু ধরা পড়ার পর মইনুল হক হাসপাতালে থাকতে চাইছিলেন না। ১৮ আগস্ট রাতে চিকিৎসকেরা তাঁকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেন। ডেঙ্গুর কারণে মইনুল হকের দুটি গুরুত্বপূর্ণ ওষুধ বন্ধ ছিল। সে বিষয়ে চিকিৎসকেরা কিছুই বলে দেননি। পরে ১৯ আগস্ট আবার হাসপাতালে ভর্তি করার পর লাইফ সাপোর্টে রাখতে হয়। পরে ২৩ আগস্ট মারা গেলেন।
ফারজানা বলেন, ‘ভাই এক হাসপাতালে মারা গেলেন। আরেক হাসপাতালে তখন মায়ের ব্লিডিং শুরু হয়েছে। ভাইয়ের লাশের কাছে থাকব না মায়ের কাছে থাকব? কী যে অবস্থা গেছে আমাদের। এক ভাইয়ের পেছনেই দুই দফায় খরচ করতে হয়েছে আট লাখ টাকা।’