মন্দিরকে কেন্দ্র করে একটি সভ্যতা গড়ে উঠেছিল, এই কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে সেই সভ্যতা সম্পর্কে জানার আগ্রহ বহু গুণ বেড়ে যায়। বলছি জঙ্গল রাজ্য অ্যাংকর ওয়াতের কথা!
মধ্যযুগে জঙ্গল কেটে গড়ে উঠেছিল এক বিস্ময়কর স্থাপনা অ্যাংকর ওয়াত। মন্দিরকে ঘিরে সভ্যতা গড়ে ওঠার এক অপূর্ব নিদর্শন অ্যাংকর ওয়াত।
কম্বোডিয়া ভ্রমণের মূল উদ্দেশ্য ছিল অ্যাংকর ওয়াত দেখা, যদিও ভ্রমণ শুরু করেছিলাম কম্বোডিয়ার রাজধানী শহর নমপেন দিয়ে।
অ্যাংকর ওয়াত দেখার জন্য সিয়াম রিপ প্রদেশের সিয়াম রিপ শহরে যেতে হবে। নমপেন থেকে সিয়াম রিপ যাওয়ার দুটি উপায় আছে—বাই রোড অথবা বাই এয়ার। আমি গিয়েছিলাম বাই রোডে, সময় লেগেছিল প্রায় ৮ ঘণ্টা। কম্বোডিয়ার ২৫টি প্রদেশের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও জনপ্রিয় প্রদেশ সিয়াম রিপ। বলার অপেক্ষা রাখে না সেটি অ্যাংকর ওয়াতের জন্যই।
অ্যাংকর ওয়াত চত্বরে ঢুকতে হলে টিকিট কাটতে হয়। ট্যুরিস্টের ছবি সংযুক্ত থাকে টিকিটের গায়ে। টিকিট কাউন্টারে গেলেই আপনার ছবি তোলা হবে। পুরো চত্বর ঘুরে দেখার জন্য অনেকগুলো অপশন আছে—১ দিনের টিকিট, ৩ দিনের ও ৭ দিনের। আমি করেছিলাম ৩ দিনের টিকিট।
চত্বরটি এত বড় যে হেঁটে দেখা প্রায় অসম্ভব। তাই টুকটুক একটি উপযোগী বাহন এখানে ঘুরে বেড়ানোর জন্য। সিয়াম রিপ শহরে গণপরিবহন হিসেবে টুকটুক বেশ জনপ্রিয়। পরিবহনটি অনেকটা আমাদের দেশের অটোরিকশার মতো।
অ্যাংকর ওয়াত এলাকাটি পাঁচ ভাগে বিভক্ত—পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ ও সেন্ট্রাল অ্যাংকর। পুরো চত্বরে মোট মন্দিরের সংখ্যা প্রায় ৪৫। আমি দেখেছি শুধু সেন্ট্রাল অ্যাংকরের ৫টি মন্দির। সেন্ট্রাল অ্যাংকরে মন্দির আছে ১৮টি। এই চত্বরের আয়তন প্রায় ৫০০ একর, কিন্তু পুরো আয়তন নিয়ে এখনো সন্দেহ আছে গবেষকদের মধ্য।
মন্দিরগুলোর কথা বলার আগে অ্যাংকর ওয়াত গড়ে ওঠার গল্পটা একটু করে নিতে চাই।
জানা যায় , খ্রিষ্টীয় প্রথম শতকে এই অঞ্চলে খেমার জাতির বাস ছিল। ৮ম শতকে জয়বর্ধন নামের এক রাজা এই অঞ্চল শাসন শুরু করেন। এই সাম্রাজ্যের সীমানা ছিল দক্ষিণ ভিয়েতনাম থেকে লাওস ও মেকং নদী থেকে পূর্ব বার্মা পর্যন্ত। প্রায় ৩৮ জন রাজা এই সাম্রাজ্য পরিচালনা করেন। ১১ থেকে ১৫ শতকের মধ্যে অ্যাংকর ছিল পৃথিবীর অন্যতম বড় শহর। ৮ম থেকে ১২ শতক পর্যন্ত এই সভ্যতার স্বর্ণযুগ ছিল বলে মনে করা হয়। এই মন্দিরগুলো কেবল উপাসনালয় হিসেবে ব্যবহৃত হতো না, এগুলো ছিল দেবতাদের বাসস্থান। অ্যাংকর ওয়াতের রাজাদের দেবতাই মনে করা হতো।
ইউরোপের যেকোনো শহরের তুলনায় এই নগরী অনেক বড় আর আধুনিক ছিল। বাস্তুশাস্ত্র আর নগর পরিকল্পনায় খেমার রাজাদের দক্ষতা আজও বিস্ময় জাগায়। এই জঙ্গল রাজ্য পরিবেষ্টিত ছিল পরিখা বা খাল দিয়ে, যা একদিকে বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করত, অন্যদিকে এই জলপথ ব্যবহৃত হতো পরিবহন আর বাণিজ্যিক কাজে।
খেমাররা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে যুক্ত ছিল। কৃষিকাজের পাশাপাশি তারা ব্রোঞ্জের মূর্তি, হাতির দাঁত ও কাঠ রপ্তানি করত। পুরো এলাকায় আমি দেখেছি বিশাল বিশাল ওকগাছ। খেমাররা মূলত চীনাদের সঙ্গে ব্যবসা করত। ১২৯৬ সালে জো ডাং ওয়াং নামের একজন চীনা ব্যবসায়ী অ্যাংকর ওয়াত ভ্রমণ করেন। তাঁর ভ্রমণের গল্পতেই মূলত অ্যাংকর ওয়াত সম্পর্কে তথ্যগুলো জানা যায়।
২য় শতক থেকে ৭ম শতক পর্যন্ত খেমাররা ছিল হিন্দুধর্মের অনুসারী। রাজা ৭ম জয়বর্ধন বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হন। এই ধর্মীয় রাজনীতির বদল হওয়ার কারণে সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হয় ও ধীরে ধীরে এই সভ্যতা বিলীন হতে থাকে। জঙ্গল থেকে যে রাজ্যের শুরু হয় আবার জঙ্গলেই ঢেকে যায়।
অ্যাংকর ওয়াত
এই সভ্যতার মূল আকর্ষণ হলো এর কেন্দ্রীয় মন্দির। এই মন্দির কম্বোডিয়ানদের কাছে এতই পবিত্র আর সম্মানিত যে, এই মন্দির তাদের জাতীয় পতাকায় স্থান পেয়েছে। কোনো দেশের জাতীয় পতাকায় স্থান পাওয়া পৃথিবীর একমাত্র স্থাপনা এই অ্যাংকর ওয়াত।
মন্দিরটি দুই ভাগে বিভক্ত। একটি অংশ পাহাড়ের মতো উঁচু। আর অন্য অংশটি গ্যালারির মতো। মন্দিরের চারদিকে রয়েছে পরিখা। এই মন্দিরের নকশা হিন্দুধর্মের পৌরাণিক কাহিনির দেবতাদের আবাসস্থলের অনুরূপে বানানো হয়েছে। হিন্দু দেবতা বিষ্ণুকে উৎসর্গ করে এই মন্দির নির্মাণ করা হয়।
আয়তনের বিচারে এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মন্দির। প্রতিবছর ১০ লাখ পর্যটক এই মন্দির দেখতে আসেন। এটি কম্বোডিয়ার প্রধান পর্যটনকেন্দ্র। ১৯৯২ সালে মন্দিরটি ইউনেসকো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
রাজা দ্বিতীয় সূর্যবর্মণ ছিলেন দেবতা বিষ্ণুর ভক্ত। তিনি সব সময় বিষ্ণু দেবের পূজা করতেন। তাই এই অ্যাংকর ওয়াতের কেন্দ্রীয় মন্দিরে একটি বিষ্ণুমূর্তি স্থাপন করা হয়। খেমার রাজারা নিজেদের দেবতা মনে করতেন, তাই এই মন্দিরগুলোতেই বসবাস করতেন। রাজার মৃত্যুর পর সেই মন্দির স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এভাবে প্রতিটি রাজাই নিজস্ব মন্দির গড়ে তোলেন।
কেন্দ্রীয় মন্দিরে ১২ হাজার লোক বাস করতেন। পুরোহিতেরা ছিলেন ধর্মচর্চার জন্য আর অপ্সরারা ছিলেন সংস্কৃতিচর্চার জন্য।
অ্যাংকর থম ও অন্যান্য মন্দির
সেন্ট্রাল অ্যাংকর ওয়াতে আমি আরও দেখেছি অ্যাকর থম মন্দির, বাপুন, ব্যয়ন, ফিমেন আকাশ মন্দির। নির্মাণশৈলীতে প্রতিটি টেম্পলই বিস্ময়কর।
অ্যাংকর থমও একটি শহর। অ্যাংকর অর্থ শহর আর থম অর্থ বড়। অর্থাৎ এটিও একটি বড় শহর। অ্যাংকর থমের প্রতিষ্ঠাতা রাজা ৭ম জয়বর্ধন। অ্যাংকর থমের শহরে সবচেয়ে বিস্ময়কর লেগেছে এর গেট বা প্রদেশদ্বার। দেবতাদের বিশাল মূর্তিগুলো যেন এখনো পাহারা দিচ্ছে এই শহর। এ রকম নাকি ৫টি গেট আছে। আমি খুঁজে পাইনি। ভেতরে ঢুকলে আসলে ধাঁধার মতো লাগে। এত বিশাল পরিসরে নিজেকে পথভ্রষ্ট মনে হয়। অবশ্য এই চত্বরের মজাই এটা।
এই অ্যাংকর থমের ভেতরেই আছে টেরাস অব দ্য এলিফেন্ট, টেরাস অব দ্য লেপার কিং, প্রিচ ফিলাই। প্রতিটি নাম উচ্চারণ করতে আমার প্রথম কষ্ট হচ্ছিল। সবকিছুই আসলে নোট ডাউন করতে হয়েছে। সেই ডায়েরি ধরেই লিখছি এখন।
দেয়ালে আঁকানো অপ্সরা, বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি, খেমার দেবতাদের নিয়ে কথা উপকথাগুলো পাথরে লিপিবদ্ধ করার প্রথাগুলো দেখে কোনো অংশেই বিষয়গুলোকে আমার মিসরীয় সভ্যতার থেকে কম কিছু মনে হয়নি। আর এই সভ্যতাকে জঙ্গল রাজ্য বলা খুবই যথার্থ মনে হয়েছে আমার কাছে। কারণ একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে আমি কিছুটা হলেও সেই জঙ্গল রাজ্যের আভাস পাচ্ছিলাম এবং পাথর খোদাইয়ের কাজে খেমারদের পারদর্শিতার কথা চিন্তা করে বিস্মিত হচ্ছিলাম।
অ্যাংকর ওয়াত ও অ্যাংকর থম চত্বরে বিচিত্র সব উদ্ভিদ রয়েছে। মন্দিরগুলোর জন্য একে আর্কিওলজিক্যাল পার্ক আর উদ্ভিদের জন্য একে বোটানিক্যাল গার্ডেন বললে ভুল হবে না। সব উদ্ভিদের নাম জানা হয়নি, সেটি সম্ভবও নয় একবার ভ্রমণ করে। ওকগাছের কথা আগেই বলেছি। আর একটি অদ্ভুত গাছের কথা বলছি স্পুংগাছ।
স্পুংগাছ
স্পুংগাছ দেখতে পেয়েছি টেম্পলজুড়ে। এই গাছ আর শিকড় ও কাণ্ড দিয়ে পুরো টেম্পলকে ঢেকে রেখেছে। পুরোনো টেম্পলের গায়ে রুপালি শাখা-প্রশাখা এক অন্য রকম মাত্রা তৈরি করেছে।
সত্যি কথা বলতে স্পুংগাছ অ্যাংকর ওয়াতের জনপ্রিয়তা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। আরও একটি কারণ অবশ্য আছে। হলিউডের সিনেমা ‘টুম্ব রাইডার’ ছবির শুটিং হয়েছিল ২০০১ সালে এখানে। সেই মুভি স্পুংগাছকে বিশ্ব পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয় করেছে। স্পুংগাছের উচ্চতা ১০ ফুট থেকে ৭০ ফুট পর্যন্ত হয়। স্পুংগাছ পর্যটকদের মধ্যে এতই জনপ্রিয় হয়েছে যে ছবি তোলার জন্য আলাদা কর্নার তৈরি হয়েছে। সেখানে রীতিমতো লাইনে দাঁড়াতে হয় ছবি তোলার জন্য।
ফ্রান্স কম্বোডিয়া শাসন শুরু করলে ১৮৬০ সালে ফ্রান্সের একদল উদ্ভিদবিজ্ঞানী জঙ্গলে খুঁজে পান এই নগরী। এই সভ্যতার পুরো স্বাদ সেখানে ভ্রমণ করলেই শুধু পাওয়া যাবে।
* লেখক: পর্যটক ও শিক্ষক