রোহিঙ্গা সংকট
মনোযোগ হারাচ্ছে প্রত্যাবাসন
আসিয়ানের বিশেষ সম্মেলনে যোগ দিতে প্রথমবারের মতো বিদেশে যাচ্ছেন জান্তা সরকারের প্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইং।
মিয়ানমারে জান্তার ক্ষমতা দখলের পর আড়াই মাস পেরিয়ে গেছে। সময় যত যাচ্ছে, রাজপথে জান্তাবিরোধী বিক্ষোভ আর এতে রক্তক্ষয়ও তত বাড়ছে। দেশটির এই সংকট নিয়ে আলোচনার জন্য আগামী শনিবার বিশেষ সম্মেলন ডেকেছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জোট (আসিয়ান)। ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় এই সম্মেলনে যোগ দিচ্ছেন মিয়ানমারের জান্তাপ্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইং। কিন্তু সেনা অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত এনএলডির নেতৃত্বে গঠিত জাতীয় ঐক্যের সরকার (এনএইজি) সামরিক শাসককে স্বীকৃতি না দিতে আসিয়ানের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের চলমান এই পরিস্থিতি আর তা নিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আলোচনা–সমালোচনার মধ্যে পড়ে সংকট আর অনিশ্চয়তা বাড়ছে বাংলাদেশের। কেননা এই ডামাডোলের মধ্যে পড়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে প্রত্যাবাসনের বিষয়টি বিশ্ব সম্প্রদায়ের মনোযোগ হারাচ্ছে।
-রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক সহায়তার বাজেট এ বছর এখনো চূড়ান্ত হয়নি।
–আগের চার বছরে মিলেছিল ৩৪৩ কোটি ডলারের প্রতিশ্রুতি, পাওয়া যায় ২২৯ কোটি।
–২০২১ সালের প্রস্তাবিত জেআরপিতেও ১০০ কোটি ডলারের কথা বলা হয়েছে।
মিয়ানমারের অস্থিতিশীল পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন গত রোববার তাঁর দপ্তরে প্রথম আলোকে বলেন, মিয়ানমারের পরিস্থিতি স্থিতিশীল না হলে তো প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনার সুযোগ নেই। কারণ, সামরিক শাসক এক রকম কথা বলছে আর এনএলডি নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যের সরকার অন্য রকম কথা বলছে। সব মিলিয়ে সেখানকার পরিস্থিতি এখনো ঘোলাটে। তাই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের স্বার্থেই বাংলাদেশ মিয়ানমারে স্থিতিশীলতা চায়।
মিয়ানমারের অস্থিতিশীলতায় নিরাপত্তাঝুঁকির বিষয়ে জানতে চাইলে মাসুদ বিন মোমেন বলেন, ‘বর্তমানে সেখানে যে পরিস্থিতি রয়েছে, তা যদি রাখাইনে ছড়িয়ে পড়ে, তবে নতুন করে ঢল নামতে পারে। এটা আমাদের জন্য উদ্বেগের। নতুন করে আরও রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেওয়ার মতো অবস্থায় আমরা নেই। যারা আছে, তাদের নিয়েই আমরা হিমশিম খাচ্ছি।’
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশ ও মিয়ানমার নেপিডোতে ২০১৭ সালের ২৩ নভেম্বর মূল চুক্তি সই করেছিল। রাখাইনে প্রত্যাবাসনের উপযোগী পরিবেশ তৈরি না করেই মিয়ানমার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশের সঙ্গে ২০১৮ ও ২০১৯ সালে দুই দফা দিনক্ষণ চূড়ান্ত করেছিল। কিন্তু রোহিঙ্গারা রাজি না হওয়ায় প্রত্যাবাসনের দুই দফা চেষ্টা ভেস্তে যায়।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, মিয়ানমারে অং সান সু চির নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে সেনাশাসনের কারণে সৃষ্ট চলমান রাজনৈতিক সংকটে রোহিঙ্গা সমস্যা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে অনেকটা চাপা পড়ে গেছে। বিশেষ করে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে মিয়ানমারের নাগরিকদের বিক্ষোভ অব্যাহত থাকায় শিগগিরই সেখানকার পরিস্থিতির উন্নতির কোনো লক্ষণ নেই। এই বিক্ষোভ রাজধানী নেপিডো বা অন্যতম শহরে ইয়াঙ্গুনে সীমাবদ্ধ নেই। বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী অধ্যুষিত শান, কাচিন ও কায়িন রাজ্যেও তা ছড়িয়ে পড়েছে। এই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনার কোনো সুযোগ আছে বলে মনে হয় না।
সব মিলিয়ে প্রত্যাবাসনের চিত্র যখন দিনে দিনে ঝাপসা হচ্ছে, তখন রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য বৈশ্বিক মানবিক সহায়তার বিষয়টিও কিছুটা অনিশ্চয়তার মধ্যে আছে।
২০১৭ সালের আগস্টে রোহিঙ্গা ঢলের পর থেকেই যৌথ সাড়াদান পরিকল্পনার (জেআরপি) আওতায় উন্নয়ন সহযোগীরা মানবিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের। জাতিসংঘের উদ্যোগে জেনেভায় একটি সম্মেলনের মাধ্যমে দাতারা আর্থিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছে। আর এই জেআরপিতে বাংলাদেশ সরকারও আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে। ২০১৭, ২০১৮, ২০১৯ ও ২০২০—এই চার বছরে জেআরপিতে প্রায় ৩৪৩ কোটি ডলারের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। এখন পর্যন্ত পাওয়া গেছে ২২৯ কোটি ডলার। অর্থাৎ প্রতিশ্রুত অর্থের ৬৭ শতাংশ দিয়েছে উন্নয়ন সহযোগীরা। এর মধ্যে সর্বশেষ বা ২০২০ সালের জেআরপিতে ১১০ কোটি ডলার প্রতিশ্রুতি থেকে সাড়ে ৬১ কোটি ডলার দিয়েছে দাতারা।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ২০২১ সালের প্রস্তাবিত জেআরপিতেও ১০০ কোটি ডলারের কথা বলা হয়েছে। দর–কষাকষির কিছু বিষয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে জাতিসংঘের ভিন্নতা থাকায় চলতি বছরের চার মাস চলে গেলেও এবার তা এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত হয়নি। আগামী মাসে এটি চূড়ান্ত হতে পারে।
সার্বিক জানতে চাইলে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব ও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউট ফর পলিসি অ্যান্ড গভার্ন্যান্সের জ্যেষ্ঠ ফেলো মো. শহীদুল হক গতকাল সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, মিয়ানমারে রাজনৈতিক সংকট অব্যাহত থাকায় রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের বিষয়টি আন্তর্জাতিকভাবে মনোযোগ হারিয়েছে।
তাই বিষয়টিতে আন্তর্জাতিক মনোযোগ ফিরিয়ে আনতে বাংলাদেশকে প্রতিটি বন্ধু দেশের সঙ্গে আলোচনা চালাতে হবে। যেমন আসিয়ান আগামী সপ্তাহে মিয়ানমারের জেনারেলকে বিশেষ সম্মেলনে ডেকেছে। প্রতিবেশী বাংলাদেশ হিসেবে আসিয়ানের সদস্যদেশগুলোকে বোঝাতে হবে, মিয়ানমারের অব্যাহত স্থিতিশীলতা আর রোহিঙ্গা সংকট দীর্ঘায়িত হওয়া চূড়ান্তভাবে এ অঞ্চলের জন্য দুশ্চিন্তা বাড়াবে।